ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘সবজি বিক্রেতাই আমার মা’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০০, ১০ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সবজি বিক্রেতাই আমার মা’

বাংলা চলচ্চিত্র বা নাটকে মায়ের ভূমিকার বেশ গুরুত্ব দেওয়া হতো এক সময়। ৮০/৯০ দশকে এমনও চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মিত হয়েছে যেখানে প্রধান চরিত্র ছিল মায়ের। এর কারণ ছিল মায়ের অবদানকে সমাজের সামনে তুলে ধরা।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাজলায় সবজি বিক্রেতা কল্পনা বেগমের সঙ্গে সে সময়ের কোনো নির্মাতার যদি দেখা কিংবা কথা হতো তাহলে তিনি হয়তো তার জীবন গল্প নিয়ে নির্মাণ করতে পারতেন একটি চলচ্চিত্র বা নাটক। চলচ্চিত্র বা নাটক নাই বা হলো- তার সন্তানদের কাছে তিনি সেই সময়কার সিনেমার মায়ের চরিত্রের মতই।

মা-বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে তরুণ বয়সে কল্পনা বেগমকে বিয়ে দেন এক মাছ ব্যবসায়ীর সাথে। সুখের ভেলায় শুরু হয় তার সংসার জীবন। সে সংসারে একে একে তিন সন্তানের জননী হন কল্পনা। মাত্র ১০ বছরেই সেই সংসারে নেমে আসে অমানিশার কালো অন্ধকার। ২০০৮ সালে হঠাৎ করেই কল্পনার স্বামী আমর আলী হোসেন স্ট্রোক করে মারা যান। তখন তার বড় মেয়ে আশুরা আক্তার আসমার বয়স ছিল মাত্র ছয়, মেঝ মেয়ে সানজিদা আক্তারের বয়স চার আর ছোট মেয়ে তনিমা আক্তারের বয়স ছিল দেড় বছর। সেই থেকে কল্পনা বেগমের সংগ্রাম শুরু।

স্বামীর মৃত্যুর পর কল্পনার জীবনে নেমে আসে সীমা হীন অন্ধকার। তাকে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। বাবাকে হারিয়েছেন আগেই। শ্বশুড়-শাশুড়িও ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে সন্তানদের জন্য নিজেই নেমে পড়লেন কাজে।

অনেকেই তার সন্তানদের দত্তক নিতে চেয়েছেন। তিনি দেননি। বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে কয়েকবার। কিন্তু মায়ের মন তো অন্য সবার মতন নয়। সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের সব স্বাদ-আহ্লাদকে দূরে সরিয়ে দেন। অবুঝ শিশুদের নিজের মত করেই মানুষ করার সংগ্রাম শুরু করেন। সেই সংগ্রামে অসহায় মাকেও সঙ্গে নিলেন কল্পনা।

কল্পনার মা বাচ্চাদের দেখভাল করতেন আর তিনি সারাদিন সবজি বিক্রি করতেন। সেই থেকে ক্লান্তিহীন কল্পনার সংগ্রাম আজও চলছে। দীর্ঘপথ চলায় নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন বারবার। মানুষের অবহেলা, অবজ্ঞা আর হিংস্রতার মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। বিপদে পড়েছেন, আবার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। হারিয়েছেন পুঁজি, তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যবসার স্থান, আবারও শুরু করেছেন নতুন করে। হয়তো তিনি টিকে আছেন অবুঝ শিশুদের জন্যই।

কল্পনার বয়স বেড়েছে। নানা রোগে শোকে কাহিল হয়ে পড়েছেন। বয়সের সাথে সাথে শক্তিও কমে গেছে। তবুও থেমে যাননি তিনি। করোনার মধ‌্যে সাধারণ ছুটি চলাকালে বেলা ৮ টায় নিজে গিয়ে যাত্রাবাড়ি আড়ত থেকে সবজি নিয়ে আসেন। এরপর সাজিয়ে গুছিয়ে বেচাবিক্রি শুরু করেন। চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এর আগে ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে সবজি আনতে যেতেন। বাসায় ফিরতেন রাত ১টায়।

কল্পনা বড় মেয়ে আশুরাকে বিয়ে দিয়েছেন। মেঝ মেয়ে সানজিদা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। আর ছোট মেয়ে তনিমা এখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সন্তানদের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাকেও দেখভাল করছেন কল্পনা। এ দীর্ঘ পথ চলায় নিজে একাকী লড়েছেন শুধুমাত্র তিন মেয়ের সুখের আশায়। কখনো খেয়েছেন কখনো বা খাবার পাননি। সব দুঃখ ভুলে যান মেয়েদের মুখে হাসি দেখলেই।

বড় মেয়ে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন। ছোট দুজনকে নিয়েও কল্পনা স্বপ্ন দেখছেন ভালো ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার। আর নিজের মায়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের জল মুছলেন কল্পনা আক্তার।

তিনি বলেন, ‘আমার মাও খুব অসহায়। তার মুখে কখনো হাসি দেখিনি। কষ্টে কষ্টে থেকে তিনি হাসিটাও ভুলে গেছেন। তাই আমি তাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি। এখনও মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নেন, সান্তনা দেন। আমার জন্য কাঁদেন, দোয়াও করেন। আমার বিশ্বাস মায়ের দোয়াতেই আমি এখনো টিকে আছি।’

কল্পনার একটা অপূর্ণতা রয়েই গেলো। তার ইচ্ছে ছিল পুত্র সন্তানের মা হওয়ার। অনেকে বলেছিল আবার বিয়ে কর তাহলে হতেও পারে। তখন তার মাও সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। ছেলে হলে যে মেয়েগুলোর প্রতি অবহেলা হতে পারে- এ আশঙ্কায় তিনি আর সেদিকে পা বাড়াননি।

তারপরও আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছেলে থাকলে তো আমাকে একটু সাহায্য করতে পারতো। একা একা আর কত। দোকান চালাতে তিন জন লোক লাগে, অথচ একই চালাতে হচ্ছে।’

মা প্রসঙ্গে কল্পনা বেগমের ছোট মেয়ে তনিমা আক্তার বলে, ‘স্কুলে যখন যাই তখন কত জনের বাবা-মা আসেন। কিন্তু আমার তো বাবা নেই, মাও যেতে পারেন না। বাবা যে কি তাও বুঝতে পারি না। সবকিছু মায়ের কাছেই চাই। মা ই বাবা, মা ই সব। অনেক সময় সহপাঠীরা মাকে নিয়ে কটূক্তি করেন। বলে, তুই তো সবজি বিক্রেতার মেয়ে, আমাদের সাথে চলে না। তখন আমি বলি, ‘সবজি বিক্রেতা কল্পনার মেয়েই আমি। এটাই আমার পরিচয়। মায়ের পরিচয়ে গর্ববোধ করি।’

 

ঢাকা/মামুন খান/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়