ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার এবং একজন পিয়ারু সরদার

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার এবং একজন পিয়ারু সরদার

ঢাকার প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: ড. আব্দুল হাফিজ। ইনসেটে পিয়ারু সর্দারের ছবি।

বাঙালি জাতি আর বাংলাদেশের সঙ্গে একুশের প্রথম ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ পরবর্তী সময়ে ‘শহীদ মিনার’ গভীর এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে। যুগ যুগ ধরে এ মেলবন্ধন আমাদের মাতৃভাষা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ ধারা যতদিন থাকবে তার সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে থাকবে সে নামটি পুরনো ঢাকার ১৫, হোসনি দালানের বিখ্যাত সরদার পরিবারের অন্যতম পিয়ারু সরদার।

এই সাহসী ভাষা সৈনিক নিজের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শহীদদের স্মৃতি চির অম্লান করে রাখতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী দিয়ে সহায়তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। অথচ তার নাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। ১৯৫২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে- আমরা কজনই বা জানি এই বীরের অবদানের কথা। আর নতুন প্রজন্ম পিয়ারু সরদারকে কতটা জানে- সে প্রশ্ন থেকেই যায়?

এভাবেই আমরা ইতিহাস থেকে বিস্মৃত হতে বসেছি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আর কোটি কোটি মানুষের চেতনার মধ্য দিয়ে।

কবি সুফিয়া কামালের সুযোগ্যা কন্যা সুলতানা কামাল ‘পিয়ারু সরদারের জন্য সামান্য দুটি কথা’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন, ২০১৪ সালের ২০ মে একেবার হঠাৎ করেই একটা ছোট্ট খোলা জানালার সন্ধান পেলাম আমি। যে জানলা দিয়ে আবার নতুন করে বাংলাদেশের মানুষদের তাদের সত্যিকারের চেহারায় দেখার সুযোগ হলো। চেহারাটা দেখলাম পিয়ারু সরদারের কাহিনির মধ্যে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কুমিল্লার হোমনায় ঘটে-যাওয়া সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ওপর একটি সংবাদ সম্মেলন ছিল সেদিন। বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও- এর আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা সেই সম্মেলনের আগে একত্রিত হয়েছি জাদুঘরের অফিস কক্ষে। একজন মাঝ বয়সী ব্যক্তি শ্রদ্ধেয় আনিস ভাইয়ের সাথে কোনো একটি স্মারকগ্রন্থ বিষয়ে কথা বলছিলেন। নামটা কানে এলো পিয়ারু সরদার। খুবই চেনা নাম- কিন্তু দীর্ঘবিস্মৃত। হয়তো পঞ্চাশ কি যাটের দশকে কখনও কখনও নামটা উচ্চারিত হয়েছে কোনো কোনো আন্দোলনের প্রসঙ্গে। তারপরে আর কখনও পিয়ারু সরদারের নাম কেউ নিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। অথচ এই মানুষটি, পিয়ারু সরদার, যিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরের ২২ পঞ্চায়েত প্রধানের একজন ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে রেখেছিলেন এক অনন্য ভূমিকা।

তার ভূমিকা অনন্য বলছি এই কারণে, পিয়ারু সরদার তার প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালনের বাইরে সরকারি ঠিকাদারি করতেন। তখন ছিল পাকিস্তানি আমল, মুসলিম লীগের অধীনে দেশ। পিয়ারু সরদার তার পিতা মনু সরদারের মৃত্যুর পর ঢাকা শহরের সরদার হিসেবে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সরদারির দায়িত্ব প্রাপ্তিটা এবং সেই পদটা টিকিয়ে রাখা অনেকটাই নির্ভর করত ঢাকার নবাবদের নেক নজরে থাকার ওপর।

পাকিস্তানি আমলের পুলিশের গোয়েন্দাবাহিনী ও সরকারের নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির কোনোরকম বিচ্যুতি ক্ষমার চোখে দেখত না। পিয়ারু সরদার না ছিলেন ছাত্র না রাজনীতিক, না সুশীল সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি তার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ভাষাসৈনিক বলে আমরা যাদের অভিহিত করি- তাদের দলের কেউ নন। তিনি, যতটুকু জেনেছি তার সম্পর্কে, ছিলেন এক উদারমনা সামাজিক নেতা। যিনি নানাভাবে সমাজের কল্যাণ ও প্রগতির জন্য কাজ করেছেন।

১৯৫২ সালে তিনি সরকারি ঠিকাদার হিসেবে মেডিক্যাল কলেজের কিছু নির্মাণ কাজের দায়িত্বে ছিলেন। আন্দোলনকারী ছাত্ররা নূরুল আমিন সরকারের পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদদের স্মরণে যখন প্রথম শহীদ মিনারটি বানানোর সিদ্ধান্ত নিল, পিয়ারু সরদারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তারা তার কাছে পরম আস্থাভরে নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করতে যায়। তিনি তার ঠিকাদারি কাজের জন্য যে ইট বালু এনে রেখেছিলেন, সেগুলো খোলা জায়গাতেই ছিল। শুধু সিমেন্ট ছিল গুদামের ভিতরে। ছাত্ররা তার কাছে সিমেন্ট চাওয়া মাত্র তিনি ছাত্রদের হাতে তার গুদামের চাবি তুলে দেন, কোনো প্রশ্ন না করে।

তিনি সরকারের রোষাণলে পড়ার আশঙ্কার হিসাব না করেই শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষে যায় না এমন যেকোনো কাজের জন্য তার ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারত। শুধু সরকার কেন? নবাববাড়ির যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল উর্দুর পক্ষে, তাদের রোষাণলে পড়ার সম্ভাবনাও কি কম ভীতিকর ছিল? পিয়ারু সরদার কিছুরই ভয় না করে ভাষা সংগ্রামের জন্য তার বিবেক যা নির্দেশ দিয়েছে, দেশপ্রেম যে পথ দেখিয়েছে, সেই মতেই তার কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিলেন এবং তার নির্দিষ্ট ভূমিকাটি রেখেছিলেন। অথচ এই মানুষটাকে আমরা ভুলেই যেতে বসেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি। ছবি: রফিকুল ইসলাম

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের তীব্রতা টের পেয়ে বন্য হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন, স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের যে জায়গায় পুলিশ জনতার ওপর হামলা করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেখানেই এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ।

আন্দোলনকারীরা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহে বের হয়ে পড়েন। কিন্তু ঢাকাজুড়ে কারফিউ জারি থাকায় নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করা অতটা সহজ ছিল না। এই নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহের পেছনে কিছু কথা থেকে যায়। সেদিকে একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির মাতৃভাষা দিবস থেকে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পথটা খুব মসৃণ ছিল না। অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম আর আত্মবলিদানের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

পিয়ারু সরদার কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না। তবে রাজনৈতিক সচেতন, দেশপ্রেমিক, একজন দানশীল মানুষ হিসেবে পুরনো ঢাকায় তার আকাশ সমান গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সে সম্পর্কে জানালেন তার কন্যা জাহানারা বেগম। পিয়ারু সরদার সাত ছেলে এবং দুই মেয়েসহ নয় সন্তানের জনক। তার অষ্টম সন্তান হাজী আব্দুল সেলিমের সঙ্গে পূর্বপরিচিতি রেশ ধরে তার ভাতিজা সরদার তৌহিদ আহমদ এবং আমার ছোট বেলার বন্ধু আব্দুর রহিম বিভিন্নভাবে এ লেখার তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেছে। তার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

ঢাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা নগরীতে মুসলমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ লাভ করে, যা সরদারি প্রথা হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকার নবাবদের মাধ্যমে এই প্রথা গড়ে উঠেছিল, যা সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছিল। এ প্রথা অনুযায়ী ঢাকা নগরীর প্রতিটি মহল্লা বা পঞ্চায়েত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এবং এই পরিষদের নেতা হিসেবে যিনি নির্বাচিত হতেন, তাকেই সরদার বলে গণ্য করা হতো।

সরদারি প্রথার মূল উদ্দেশ্য ছিল মহল্লার অধিবাসীদের কর্তৃক মহল্লার সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বিরোধ নিষ্পত্তি, নির্দেশ কিংবা পরামর্শ প্রদান, সর্বোপরি ঢাকা নগরীর মুসলমানদের আনুগত্য অর্জন ও নবাবের আধিপত্য নিশ্চিতকরণ। ঠিক কবে থেকে এ প্রথা চালু হয় তা জানা না গেলেও, ১৮৭৬ সালে তৎকালীন নবাব আবদুল গণির আমলে সরদারি প্রথা জোরদার হয়ে ওঠে। পরে নবাব সলিমুল্লাহর হাত ধরে এ প্রথা পুনর্গঠিত হয়। তিনি ঢাকার বিদ্যমান ১২টি পঞ্চায়েতের সাথে আরো ২২টি পঞ্চায়েতের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন সরদারি প্রথা গড়ে তোলেন, এবং নবাব পরিবারের অন্যতম সদস্য খাজা মোহাম্মদ আজমকে ১৯০৭ সালে সরদারদের সরদার নিযুক্ত করেন। ওই সময়ে ঢাকা নগরীতে অন্তত ১৩৩টি পঞ্চায়েতে সমসংখ্যক সরদার ছিলেন।

প্রায় ৮০ বছর ধরে ঢাকায় সরদারি প্রথা কার্যকর ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর নবাবি প্রথার বিলুপ্তির পথ তৈরি হয়ে যায়। শেষমেষ ১৯৫০ সালে ঢাকায় নবাবি প্রথার অবসান ঘটলে, একই পরিণতি বরণ করে নিতে হয় সরদারি প্রথাকেও। তবে এরপরও বেশ কয়েক বছর এই সামাজিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া এই প্রথা বিলোপের আগে যে কয়জন ব্যক্তির সরদার হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যে মির্জা কাদের সরদার, জুম্মন সরদার, মোতি সরদার, মওলা বকশ সরদার, পিয়ারু সরদার, লতিফ খান সরদার ও মাজেদ সরকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার দাবিতে বুকের রক্ত ঢেকে রাজপথ রাঙিয়েছিলেন সালাম, রফিক, শফিউর, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির আগে-পরে এমন অনেকেই আছেন যারা হয়তো সরাসরি ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দেননি, সর্বসম্মুখেও আসেননি, কিন্তু অন্তরালে থেকে এই আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন, যথাসম্ভব অবদানের মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। সেরকমই একজন ছিলেন পিয়ারু সরদার।

১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে গোটা ঢাকা শহর যখন উত্তাল হয়ে ছিল, তখন পিয়ারু সরদার ছিলেন নগরীর ২২ পঞ্চায়েত প্রধানের মধ্যে একজন। তার বাড়ির অদূরেই ছিল রেললাইন। আর তার অপরপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমতলা। তার বাড়ির ছাদে উঠলেই টের পাওয়া যেত, আমতলায় কী হচ্ছে না হচ্ছে। যেহেতু তখনকার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী ছাত্র-ছাত্রীদের কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল ছিল আমতলা, তাই তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে চলমান আন্দোলনের হাল-হকিকতও বুঝে নেয়া যেত খুব সহজে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের আন্দোলন একসময় বিস্তার লাভ করে পিয়ারু সরদারের হোসনি দালান ও বকশিবাজার এলাকা পর্যন্তও। এই এলাকাগুলো আরো পরিণত হয় আন্দোলনরত ছাত্রদের আশ্রয় স্থলে। যখনই পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা চালাত, তারা চট করে রেললাইন পার হয়ে ঢুকে পড়ত হোসনি দালান মহল্লায়। পুলিশ তাদের পিছু নিয়ে ওই মহল্লায় ঢুকেও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করত, যা গোটা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। এমন অবস্থায় ছাত্রদের পানি সরবরাহ করে তাদের চোখের জ্বালা কমানোর উদ্দেশ্যে বাসায় বালতি করে পানির জোগাড় রাখতেন স্বয়ং পিয়ারু সরদার। তার দেখাদেখি এই কাজ করত মহল্লার আরো অনেকেই। এভাবে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পিয়ারু সরদারের মহল্লাবাসীরও।

২১ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং আন্দোলনে মুখর হয়ে ওঠে, তখন তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। অনেকে তো নিহত হনই, এছাড়াও গুরুতর আহত হন বা বন্দি হন আরো শত শত আন্দোলনকারী। সব মিলিয়ে দেশ যখন এক মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন নিজ দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে এগিয়ে আসেন পিয়ারু সরদার।

২১ ফেব্রুয়ারির পরদিনই ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন, তারা ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবেন। ঠিক যে জায়গাটায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, সেখানেই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নামখচিত একটি স্মৃতির মিনার নির্মিত হবে। এ লক্ষ্যে সেদিনই বদরুল আলম তৈরি করেন মিনারটির নকশা। কিন্তু মিনার তৈরি করতে হয় নগদ অর্থ লাগবে, নয়তো লাগবে কাঁচামাল। ছাত্রদের কাছে সে সময়ে কিছুই ছিল না। তাহলে উপায়? ছাত্রদের মাথায় তখন প্রথম যে নামটি আসে, সেটি হলো পিয়ারু সরদার।

সে সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ভবনের সম্প্রসারণ ও নার্সিং হোস্টেল নির্মাণকাজ চলছিল, যার ঠিকাদারি করছিলেন পিয়ারু সরদার। সেখানে কাজের জন্য যে পরিমাণ বালু ও ইট মজুত ছিল, তা দিয়ে অনায়াসেই কাজ চলে যেত, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে সিমেন্ট, তা রাখা ছিল তালাবদ্ধ গুদামে। গুদামের চাবি ছিল কেবল পিয়ারু সরদারের কাছেই। ছাত্ররা ধরেই নিয়েছিল, পিয়ারু সরদারের কাছে সিমেন্টের আবদার করা হলেও তা রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে, কেননা সরকারি সিমেন্ট তিনি ‘সরকারবিরোধী’ কাজে দান করে দিয়েছেন, এ কথা জানাজানি হলে আর রক্ষে ছিল না।

পিয়ারু সর্দারের মেয়ে জাহানারা বেগমের সঙ্গে প্রতিবেদক।

এসব ভেবেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দুই ছাত্র দুরু দুরু বুকে হাজির হলেন পিয়ারু সরদারের কাছে, পেশ করলেন নিজেদের দাবি। তাদের কথা শুনে সহসাই কোনো জবাব দিলেন না তিনি। নিঃশব্দে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন। যখন ফিরে এলেন, তখন তার হাতে একটি চাবি। ছাত্রদের হাতে চাবিটি তুলে দিতে দিতে শুধু বললেন, ‘কাজ শেষ করে পরদিন অবশ্যই চাবিটি ফেরত দিয়ে যেও।’

এভাবেই বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও, সেসবের পরোয়া না করে ছাত্রদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন পিয়ারু সরদার। তার কল্যাণেই জোগাড় হয়ে যায় মিনার নির্মাণের ইট, বালু, সিমেন্ট। তখনো ঢাকায় কারফিউ জারি ছিল। সেই কারফিউয়ের ভেতরই যথা সম্ভব নীরবে, শত শত স্বেচ্ছাসেবীর পরিশ্রমে ২৩ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে নির্মিত হয় ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার। ৬ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উচ্চতার সেই মিনারটি ছিল শক্ত ভিতের ওপর নির্মিত। মিনারের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিল দুটি পোস্টার, মধ্যভাগে লেখা হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। আর নিচের দিকে লেখা হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এসে সেই শহীদ মিনারের স্মৃতিফলক উন্মোচন করলে, সেখানে ঢল নামে আবেগাপ্লুত হাজারো মানুষের। সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে থাকে ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের। মেয়েরা ফুলের পাশাপাশি নিজেদের শরীর থেকে গহনা খুলে নিবেদন করতে থাকে শহীদ মিনারের পাদদেশে। এছাড়া অনেকে নগদ টাকাও রাখে।

দুঃখের বিষয়, এত পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্মিত শহীদ মিনারটির স্থায়িত্বকাল খুব বেশিদিন ছিল না। ২৬ ফেব্রুয়ারিতেই পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয় শহীদ মিনারটি। পরে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর আবারো নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। এবারের শহীদ মিনারটির আকার ছিল আরো বড়। এবং সেটি নির্মিত হয়েছিল খোদ পিয়ারু সরদার ও তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধানে। পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও শুরতেই পাক হানাদার বাহিনী আবার কামান দাগিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শহীদ মিনারটি।

শেষ কথা
পিয়ারু সরদারের মেয়ে জাহানারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় তার ১৫, হোসনি দালানের পৈত্রিক বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার জন্ম ১৮৯৩ সালে। ১৯৪৪ সালে দাদা মুন্নু সরদারের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক রেওয়াজ অনুযায়ী তাকে পাগড়ি পরিয়ে সরদার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬১ সালে ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি সরদারি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন হোসনি দালান, বকশিবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, উর্দু রোড, নূরকাতা লেন, আজিমপুর, পলাশীসহ বিভিন্ন মহল্লার সরদার। দানশীল ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে তার খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। একবার তিনি ঢাকা পৌর করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে কমিশনার নির্বাচিত হন।’

জাহানার বেগম বলেন, ‘আমার বাবা সৎভাবে দুহাতে অর্থ উপার্জন এবং তা থেকে বড় একটি অংশ দুহাতে বিলিয়ে দিতেন। অনেক গরীব শিক্ষার্থী যারা গ্রাম এলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেখা করতে আসতো তাদের ঢাকা থাকার জায়গা থাকত না। বাবা তাদের থাকা-খাওয়াসহ কারো কারো পড়ালেখার ব্যয় নির্বাহ করতেন। এছাড়াও আগে প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হতো। অনেকের কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে যেত, তাদের সাহায্য করতেন। এই এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আমাদের অনেক জায়গা ছিল। সেসব অনেক জায়গা স্কুল নির্মাণসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে দান করে দিয়েছেন। বাবা বেঁচে থাকার সময় আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন বড় বড় হাঁড়িতে খাবার রান্না হতো গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য।’

তিনি বলেন, বাবা এসব করতেন খুবই নিরবে। কেউ কখনো তার কাছে এসে খালি হাতে যাননি। বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। এতদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাবার বলে যাওয়া অনেক কথা মনে আছে। তিনি বলেছিলেন কিভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ হয়। তবে কোনোদিন এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখিনি। তিনি মনে করতেন তিনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন বাঙালি হিসেবে এটা তার দায়িত্ব ছিল। তবে দুঃখের বিষয় ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু আমার বাবা সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ দেখে অনেক খুশি হতেন।

পিয়ারু সরদারের ছেলের ঘরের নাতি সরদার তৌহিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা তার উত্তরসূরী হিসেবে গর্ব অনুভব করি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমার দাদার অবদানের কথা শুনে। আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ দীর্ঘদিন পরে হলেও ২০১৫ সালে আমার দাদা পেয়ারু সরদারকে একুশে পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করেছেন এবং তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন।’


ঢাকা/হাসনাত/সাইফ/নাসিম 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়