ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে যা বললেন তারা

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ০৭:০৭, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে যা বললেন তারা

বিশ্বব‌্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ‌্যালয় বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম ব‌্যাহত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ‌্যে বাড়ছে অনলাইন গেমসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম আসক্তি। এতে পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একটি প্রজন্ম মেধাহীন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন‌্য অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্বাস্থ‌্যবিধি মেনে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত। 

এদিকে, চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি এডুকেশন ওয়াচের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৭৫ শতাংশ  শিক্ষার্থী চায় দ্রুত স্কুল খুলে দেওয়া হোক।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্বাস্থ‌্যবিধি মেনে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। এডুকেশন ওয়াচের গবেষণায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে শিক্ষাকার্যক্রম চালানোর পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৬ শতাংশ অভিভাবক। এছাড়া ৬২ শতাংশ শিক্ষক চলমান সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পক্ষে মত দিয়েছেন।

তৌহিদুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। বাচ্চারা ঠিকই মাঠে খেলছে, বাজারে যাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছে।  আমরাও সব করছি। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যৌক্তিক নয়। স্বাস্থ‌্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের মধ্যে স্কুল খুলে দেওয়া যেতে পারে।’

একই অভিমত জানালেন মমিন খন্দকার নামের এক অভিভাবক। তিনি বলেন, ‘স্কুলে গেদারিং বেশি। সে আশঙ্কা থেকে সরকার স্কুল খুলছে না।  তবে, এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে গাইডলাইনের আলোকে স্কুল খুলে দেওয়া উচিত।’

স্কুল-কলেজ খুলে দিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে বলে জানালেন শিক্ষকরাও।  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তানজিলা বেগম বলেন, ‘সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী স্কুলকে প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতিই নেওয়া হচ্ছে। পুরো বিদ্যালয়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছি। শিক্ষার্থীদের বসার বেঞ্চ থেকে শুরু করে বাগান, টয়লেটসহ সব কিছু পরিষ্কার করা হচ্ছে। প্রতি শিক্ষার্থীকে স্কুল থেকে দুটি করে মাস্ক দেওয়া হবে। আর ইনফ্রারেড থার্মোমিটার সেট করবো।’  
মারুফ হোসেন নামের এক সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘সেকেন্ড ওয়েবে যে আশঙ্কা ছিল, তা মোটামুটি কেটে গেছে। বলা চলে সবকিছু স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসছে। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাঠে ফিরিয়ে আনতে স্কুল খোলার বিকল্প নেই।’

এদিকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে আমরা নির্দ্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছি না। সরকারকে ধাপে ধাপে সক্ষমতা অর্জন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে। যেন পরবর্তী ধাপে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। সবার সুরক্ষা নিশ্চিতসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত কম এলাকায় সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে কোনো ধরনের দূরশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। তাই পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অনলাইনের অপর্যাপ্ত শিক্ষাদান, শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকা, সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পাঠ কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে শেষ না হওয়ার জের ধরে প্রথম শ্রেণি থেক শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সব জায়গায় বড় ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ক্লাসের বিষয় পুরোপুরি শেষ না করলে পরের ক্লাসে গিয়ে অনেক কিছুই বুঝবে না। না বুঝেই মুখস্থ করতে চাইবে। সব বিষয়ের মধ্যে আগের ক্লাস বা পাঠের সম্পর্ক থাকে। বলতে গেলে ২০২০ সালে যেই ক্লাসের যা শেখার কথা, তা সে শিখলো না, তো সে পরের বছর পরবর্তী ক্লাসে গিয়ে তো বুঝতে পারবে না। এক পর্যায়ে হয় ড্রপ আউট হবে, না হয় ফেল করবে।’

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলছেন, ‘ঘাটতি যেন কম হয়, সেজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামো কিংবা নানা কারণে শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেই সুবিধা নিতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ‘একটা সিলেবাস করা হয় সে লেভেলে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। পর্যালোচনা করে বিষয়গুলো সেখানে রাখা হয়, যেটা তাদের প্রয়োজন বা বয়সের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা ভিত তৈরি করবে ওপরের লেভেলে পড়াশোনা বা বোঝার জন্য। এটা তো বড় গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। স্কুল-কলেজ খুললে শিক্ষককে আগে বুঝতে হবে যে, শিক্ষার্থী আগের বছরে কোন বিষয়গুলো জানার সুযোগ পায়নি। তবে, এজন্য খুলতে হবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়।’

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর পদক্ষেপ অনুসরণ করার তাগিদ দেন শিক্ষাবিদ ড. আবদুস সালাম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরেই করোনা সংক্রমণের হার বেশ কমে এসেছে। ধারাবাহিকভাবেই এ হার নিম্নমুখী রয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন কার্যক্রম। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করে এখন দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শুরুতে ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। আর স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক বা দুদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

সরকারিভাবে স্কুলগুলোতে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানের সময় শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাইকে সবসময় মাস্ক পরতে হবে। শিক্ষার্থীদের তিন ফুট শারীরিক দূরত্বে রাখা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার কথাও আছে নির্দেশনায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রায় ৩৯ পাতার একটি গাইডলাইন তৈরি করে ইতোমধ্যেই স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। যার ১৪ নম্বর পাতায় শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।  সরকারের নির্দেশনা পেলে সবার জন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। কেবল এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজ খোলা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ খোলা হলে ক্লাসের ক্ষেত্রে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।  তাদের সপ্তাহে ৬ দিনই ক্লাস করানো হবে।’ অন্য শ্রেণির জন্য সপ্তাহে এক বা দুইদিন ক্লাস নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

ইয়ামিন/এনই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়