করোনা-পরবর্তী শারীরিক-মানসিক উপসর্গ, করণীয় কী?
করোনাকে জয় করেছেন যারা, তাদের প্রায় সবার শারীরিক ও মানসিক কিছু কমন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। কথা ভুলে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, ঘুম না হওয়া, দুর্বলতা, মৃত্যুভয় এসব। নিয়মিত ওষুধ সেবন, খাদ্যাভাস, হালকা ব্যায়াম ও ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তারা এসব উপসর্গ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছেন বলে জানালেন বেশ কয়েকজন করোনাবিজয়ী।
ঢাকা খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা, গৃহিণী মাফরুহা অদ্বীতি করোনায় আক্রান্ত হন গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর প্রায় দুই মাস শরীর টেনে নিতে খুব কষ্ট হতো। কথা ভুলে যেতেন, ক্ষুধামন্দা আবার হঠাৎ হঠাৎ তীব্র ক্ষুধা, বুকে ব্যথা, ঘুম না হওয়া, মাথা ভার ইত্যাদি নানান উপসর্গও ছিল তার।
এখনো শরীরে আগের কর্মক্ষমতা খুঁজে পান না, একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। করোনার পর মেন্সট্রেশন বন্ধ ছিল তিন মাস, এখনো তা অনিয়মিত। গত মে মাসে সারা শরীরে র্যাশ উঠেছে। সেই যন্ত্রণা ভয়াবহ! সারা শরীর জ্বালাপোড়া করতো। অ্যালার্জি ভেবে ডাক্তারের পরামর্শে নানারকম ওষুধ খেয়ে অল্প কাজ হয়েছে। পরে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধে আস্তে আস্তে ভালো হয়েছেন বলে জানালেন এই গৃহিনী।
চট্টগ্রাম থেকে চাকরিজীবী আলা উদ্দিন খোকনের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। তিনি বলেন, ‘অদ্ভুত দিনরাত কাটিয়েছি! স্মৃতিগুলো সব কেটে কেটে যেতো। কোথা দিয়ে সকাল হচ্ছে, কোথা দিয়ে দিন পেরিয়ে রাত গড়াচ্ছে, টের পেতাম না। ভাবনা এলামেলো হয়ে ছন্দপতন ঘটাতো।’তিনি আরও বলেন, ‘কোমরের জয়েন্ট, মেরুদণ্ডের হাড়, দুই কান, সাইনাস দেখা দিয়েছে। ডাক্তারের অধীনে রয়েছি। নিয়মিত ওষুধ চলছে।’
মিরপুরের বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান বলেন, ‘করোনা আক্রান্তের পর থেকে তার ঘুম অনিয়মিত, প্রচণ্ড ক্ষুধা, মুড সুইং, মেমোরি লস, ডিপ্রেশন, দুর্বল লাগাসহ বিভিন্ন উপসর্গে ভুগছি। মাঝে মাঝে মন এত খারাপ লাগে যে, খালি কাঁদতে ইচ্ছে করে।’
একটি নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মুরাদ হাফিজ বলেন, ‘শরীর দুর্বল। ঘুমের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সারা শরীরের
হাড়ে ব্যথা। হালকা কাশি আছে। করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসার পরও কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছি না।’
একটি জাতীয় দৈনিকের বিজনেস এডিটরের দায়িত্ব পালন করছেন শওকত হোসেন মাসুম। তিনি বলেন, ‘ঘুমের অভাব, অবসাদ, দ্রুত টায়ার্ড হয়ে পড়ার মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এছাড়া মাঝে মাঝে মনে হয়, মেমোরি লস হয়ে গেছে বা যাচ্ছে।’
আমেরিকা প্রবাসী মাহমুদ হাশেম রেজা বলেন, ‘মানসিক সমস্যা খুব একটা হচ্ছে না। তবে শারীরিক সমস্যার মধ্যে দুর্বলতার পাশাপাশি মাঝে মাঝে রুচির অভাব বোধ হচ্ছে। খাবারের পর হঠাৎ বমি বমি ভাব আসে।’
এসএসসি পরীক্ষার্থী নিশুতি ভক্ত কথার করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া সময়। করোনা পরবর্তী কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তার। ক্ষুধা বেড়ে যায়। নাচতে কষ্ট হয় ও ক্লান্তি লাগে। নাচতে গেলে প্রচুর শ্বাস কষ্ট হয়, মনে হয় দম আটকে আসছে। সময় কাটতে চায় না। পড়াশোনায় মন বসে না। তবে রাগ আগের চেয়ে কমে গেছে বলে জানান তিনি।
বায়িং হাউজের কর্মকর্তা সৈয়দ এহসানুল হক জানান, তার খুব দুর্বল লাগে, অস্থিরতার পাশাপাশি অল্পে অসহ্য ভাব জাগে। খিটখিটে মেজাজা, কাজ ও হাঁটাচলায় নিস্পৃহভাব এসেছে। ঘুম কমে গেছে। ঘনঘন ক্ষুধা লাগলেও খাবারে অরুচি দেখা দিয়েছে।
বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী হাসান মাহমুদ গুরু জানান, করোনা পরবর্তী দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা হচ্ছে তার। ঘুম কমে গেছে, দুর্বলতা ও অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। হাত-পায়ের আঙুল ঝিম ঝিম করে, শক্তি কমে আসে, চোখে ঝাপসা লাগে। নিশ্বাস ছোট হয়ে গেছে।
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ঘুম হয় না। রাতের পর রাত জেগে কাটাই। অস্বাভাবিক দুর্বলতা, শর্ট মেমোরি লস, একটু আগের কথাও মনে থাকে না। অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়। চরম বিষণ্নতা এসে ভর করে। পুরেনো স্মৃতি মনে পড়ে। মৃত্যু ভয়ও কাজ করে। এসব জটিলতার অনেক কিছু এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’
করোনাজয়ীদের এসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি থাকবে বলে জানালেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর রহমান গালিব। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে লম্বা সময় ধরে ওষুধ খেতে হবে। পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি হালকা ব্যায়াম করতে হবে। মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে হাসি আনন্দে থাকার চেষ্টা করতে হবে।’ তাহলে ধীরে ধীরে এসব জটিলতা কেটে যাবে বলেও তিনি জানান।
/এনই/
আরো পড়ুন