যশোরের চোঁই ঝালে আহা রে স্বাদ
আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
খাসির মাংসের সঙ্গে চোঁই
আমিনুল ইসলাম, যশোর থেকে : বৈচিত্রে ভরা আমাদের দেশ বাংলাদেশ। মানুষ, মানুষের ভাষা, আচার-আচরণ ও খাদ্যাভ্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলার রয়েছে কিছু নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ব্যতিক্রম নয় যশোর জেলাটিও। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভাষা ও খাদ্যাভাসে ওপার বাংলার কিছু প্রভাবও রয়েছে যশোরের মানুষের ওপর।
বৃহত্তর যশোর জেলায় রয়েছে কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার। এগুলোর নামও কম বিচিত্র নয়। অন্য জেলার মানুষ এখানে এলে যেগুলো চোখে লাগা স্বাভাবিক। তেমন কয়েকটি খাবারের নাম চোঁই ঝাল, চাপাতি, খাসি ও মুরগির মাংসের লটপটি।
যশোরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে যতটা জানতে পেরেছি, সে অনুযায়ী প্রথমে চোঁইয়ের একটি বর্ণনা দেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে করছি। চোঁই মশলা জাতীয় লতানো গাছ। দেখতে কিছুটা পান গাছের মতো। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর কাণ্ড বেশ মোটা হয়। এর পাতাও পান পাতার মতো। মোটা কাণ্ডওয়ালা যেকোনো গাছ, যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি গাছের সঙ্গে বেয়ে বেয়ে বেড়ে ওঠে। পাঁচ থেকে ১০ বছরের একটি চোঁই গাছের ওজন পাঁচ থেকে ২০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
চোঁইয়ের রয়েছে ঔষধি গুণ। বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও সুন্দরবন এলাকায় এর দেখা মেলে। আগে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না, চাষও সেভাবে হয় না। তবে এই অঞলের রেস্তোরাঁগুলো বর্তমানে চোঁইয়ের ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম খাবার তৈরি করছে। স্থানীয় ও বাইরে থাকা আসা মানুষ চোঁইয়ের ঝালের স্বাদে তৃপ্ত হচ্ছেন।
জানতে পেরেছি, চোঁই বেশি ব্যবহৃত হয় গরু ও খাসির মাংস রান্নায়। একটি মজার ব্যাপর হলো, যশোর-খুলনার মানুষ চোঁই ছাড়া নাকি গরু ও খাসির মাংস রান্নাই করে না। বাড়ির কর্তা ও গৃহিনীও এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক। মাংস কিনলে চোঁই কিনতে ভোলে না তারা। ছোট-বড় পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের খাবারেও থাকে চোঁই।
অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী খাদ্য উপাদান হলেও চোঁইয়ের দামে কিন্তু আগুন। এক কিলোগ্রাম চোঁইয়ের দাম পড়ে ক্ষেত্রবিশেষে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। এক কেজি গরুর মাংসের সঙ্গে ২৫ গ্রাম চোঁই টুকরো করে কেটে দিলেই হয়। খাবারে চোঁই মরিচের বিকল্প নয়, সহায়ক। চোঁইয়ের ঝাল স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা।
যশোরে এসেছি শুক্রবার সকালে। উপলক্ষ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা প্রীতি ফুলবল ম্যাচ কাভার করা। উঠেছি চিত্রমোড়ের একটি হোটেলে। খাওয়ার জন্য আশপাশের কয়েকটি হোটেলে যেতে হয়েছে। সেখান থেকেই চোঁই নিয়ে আমার কৌতূহলের শুরু।
দারুণ এক কাণ্ড ঘটে গেল। আমাদের মধ্যে একজন নাকি চোঁই খেতে পারেননি। বয়কে বিষয়টি জানানো হয়। তখন আমাদের খাওয়ার পালা শেষ। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েক পা এগোতে একজন বয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে রান্না চোঁই দিয়ে যায়। এ সুযোগে সবাই মজা করে খেতে লাগলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, আমাদের চোঁই খাওয়া দেখে স্থানীয় লোকজন হাসছে। মজা পেলাম।
তার আগে সকালে যশোরে পৌঁছে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যাই। গিয়েই একটি বিষয় শুনে ঘুম ঘুম ভাবটা উড়ে যায়। রেস্তোরাঁর বয় এসে বলল, ‘কী খাবেন?’ আমি বললাম কী আছে খাওয়ার? জানালো, ভাত, পরোটা ও চাপাতি আছে। ‘চাপাতি!’ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জানতে চাইলাম, ‘কী বললে? চাপাতি?’ সে ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘হু।’ কথা না বাড়িয়ে চাপাতি আনতে বললাম। আমি ভেবেছিলাম চাপাতি দিয়ে কেটে হয়তো কোনো খাবার বানানো হয়, যার কারণে এই নাম। কিন্তু টেবিলে এনে রাখল পেল্লাই সাইজের একটি পাতলা রুটি। আমি বললাম, ‘এটা কী?’ বয় জানালো এটাই নাকি চাপাতি। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটল। বলতে লজ্জা নেই, হয়তো অনেকেই চাপাতির সঙ্গে পরিচিত নন। জানতে পেরেছি, ভারতে চাপাতির সঙ্গে মাংস ও সবজি খুব জনপ্রিয় খাবার।
এটা কী দিয়ে খাওয়া যায়? বয় জানাল, চোঁই ঝাল, খাসি ও মুরগির মাংসের লটপটি এবং সবজির ভাজি দিয়ে। লটপটির নাম শুনে কৌতূহল নিয়ে অর্ডার দিলাম। খাসির মাংসের লটপটি দিয়ে চাপাতি খেলাম। বাহঃ বেশ তো। সময় থাকলে হয়তো আরো বিচিত্র খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা হতো।
আগে থেকেই জানি, ‘যশোরের যশ খেজুরের রশ’। আগ্রহ নিয়ে খোঁজ নিয়েছি, এখন রশ পাওয়া যায় কি না। না, রশ শীতকালে পাওয়া যায়। এখন গাছ তোলা শুরু হয়েছে মাত্র। শুনেছি আরো কিছু মজার খাবারের নাম। নারকেল দিয়ে তৈরি নানা রকম খাবারও নাকি খুবই সুস্বাদু। কিন্তু কী আর করা! সংক্ষিপ্ত সফর। ঘড়ির কাঁটা বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। যশোর থেকে আবার যেতে হবে রাজশাহীতে। অনেক অতৃপ্তি নিয়ে রওনা হচ্ছি আবার আসার বাসনা নিয়ে। সুযোগ পেলে ছুটে আসব যশোরের বিচিত্র খাবারের স্বাদ নিতে।
ফিরে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় বিচিত্র বাংলাদেশ নিয়ে মনের মধ্যে বেশ ভাবব্যঞ্জনা তৈরি হলো। যশোর শহরের চিত্রামোড় থেকে শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম পর্যন্ত এতটুকু পথের বিস্তারে এত বিচিত্রতা, না জানি রূপসি বাংলার কত শত বৈচিত্র্য আজও দেখা হয়নি।
রাইজিংবিডি/যশোর/২৫ অক্টোবর ২০১৪/রাসেল পারভেজ
রাইজিংবিডি.কম