অন্য গ্রহে ফুটবল কীভাবে সম্ভব?
জাহাঙ্গীর সুর || রাইজিংবিডি.কম
ফিফা সভাপতি অন্য গ্রহেও ফুটবলের আসর বসাতে চান। কিন্তু অন্য কোনো গ্রহে ফুটবল খেলা কতটা সম্ভব। ছবি: ডেভিয়ান্ট আর্ট
জাহাঙ্গীর সুর : বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র একদিন আগে ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার রসিকতা করে বলেছেন, ভবিষ্যতে অন্যান্য গ্রহেও ফুটবল খেলার আয়োজন করা হবে! আদৌ কি পৃথিবী ভিন্ন অন্য কোনো গ্রহে ফুটবল খেলা সম্ভব? চলুন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
গত ১১ জুন ফিফা কংগ্রেসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার। ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই সংস্থাটির নামে দুর্নীতির যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। উল্টো সংস্থাটির সম্ভাব্য গৌরবময় ভবিষ্যতের কথা রসিকতা করে তিনি বলেন, আচ্ছা, একদিন যদি অন্য কোনো গ্রহে এই খেলার আয়োজন করা হয়, তাতে কি আমরা আশ্চর্য হবো? তখন শুধুমাত্র বিশ্বকাপের আয়োজন করলেই হবে না, আন্তঃগ্রহ ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজনও করতে হবে। এরকম কি হতে পারে না?
এর সরাসরি উত্তর হলো, এমন কখনও হতে পারে না। কেন হতে পারে না সে কারণটিই এবার ব্যাখ্যা করছি। এর আগে আমাদের অন্য একটা বল সম্পর্কে সামান্য হলেও জেনে নিতে হবে। এই বলের নাম মহাকর্ষ। একটা ফুটবল কিক করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার পরও ফুটবল যে মাটিতে ফিরে আসে, এর জন্য মহাকর্ষ বল দায়ী। আইজ্যাক নিউটন এই বলের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রায় চারশ’ বছর আগে। আপেল হোক আর ফুটবল, পৃথিবীপৃষ্ঠে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে যে কোনো বস্তুর উপর থেকে মাটিতে পড়ার হার যাকে আমরা অভিকর্ষজ ত্বরণ বলি, তা একই। বেশির ভাগ স্থানে এর গড় মান ৯.৮। গড় মান এজন্যই বলা যে, একেক স্থানে এর মান একেক রকম। পৃথিবীতে অঞ্চলভেদে অভিকর্ষজ ত্বরণের (একে ‘g’ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়) মান ভিন্ন হয়। ফলে সৌরজগতের একেক গ্রহে জি-এর মান যে একেক রকম হবে তা পরিস্কার। এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক।
সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধ। বুধ চাঁদের চেয়ে সামান্য বড়। পৃথিবীর বেলায় জি-এর মান যদি আলোচনার সুবিধার্থে ১ একক ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বুধে জি-এর মান ০.৩৭৮ একক; এর অর্থ পৃথিবীর জি-এর তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। অর্থাৎ মহাকর্ষ বল তুলনামূলক হালকা। ফলে বুধগ্রহে কোনো গোলরক্ষক ফুটবলে শট নিলে মাটিতে বলটি ফিরে আসতে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় লাগবে! এই সময়ে বলটি কত দূর ভেসে যাবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তার মানে, ফুটবল মাঠের পরিধি হতে হবে পৃথিবীর যে কোনো মাঠের চেয়ে কয়েকগুণ বড়। ওরকম বড় মাঠের গ্যালারিতে বসে ফুটবলই তো খালি চোখে দেখা যাবে না, দূরবীণ দিয়ে দেখতে হবে। বুধ গ্রহে দিনে তাপমাত্রা ৪২৭ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে, আর ওই একই স্থানে রাতে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ১৭৩ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। এবার আপনিই বলুন, এরকম সমীকরণে বুধের মতো গ্রহে কি ফুটবল খেলার আয়োজন করা সম্ভব? আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি, বুধ গ্রহে নাকি বায়ুমণ্ডল বলে কিছুই নেই!
এবার আমাদের নজর ফেরানো যাক এমন গ্রহে যেখানে জি-এর মান পৃথিবীর জি-এর সমান বা কাছাকাছি। এমন গ্রহ হচ্ছে শুক্র। সূর্যের থেকে দূরত্বের বিচারে গ্রহটি দ্বিতীয়। তবে এই গ্রহটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম, দূরত্বের দিক থেকে, আকারে, এমনকি জি-এর বেলাতেও। আকারে মিল ৯৫ ভাগ, জি-এর বেলায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ মোটামুটি পৃথিবীর মতোই। এই গ্রহে আবহাওয়া মণ্ডলও আছে। কিন্তু বায়ুমণ্ডল আমাদের মতো অক্সিজেন, নাইট্রোজেনে ভরা নয়। সেখানে আবহাওয়া শ্বাসরোধী, বিষাক্ত সালফারে সয়লাব। পৃথিবীতে বৃষ্টি হলে খেলা বন্ধ থাকে, আর শুক্রে তো সালফার বৃষ্টি হয়। সুতরাং সেই বৃষ্টিতে ভিজলে শরীরই ঝলসে যাবে, ফুটবল তো তুচ্ছ। তাপমাত্রার হিসাবটাও জেনে রাখুন, গড়ে ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা আপনার রান্নাঘরে ওভেনের তাপমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ! এবার আপনিই বলুন সেখানে ফুটবল খেলা সম্ভব?
মঙ্গল? লাল এই গ্রহ মানুষের মহাজাগতিক স্বপ্নকে সবচেয়ে বেশি লালন করেছে। মঙ্গলে বসতি স্থাপনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বুধের মতোই, মঙ্গলের জি-এর মান পৃথিবীর চেয়ে তিনগুণ কম। দ্বিতীয়ত, শ্বাস নেওয়ার সুযোগ নেই। পৃথিবীতে অ্যাথলেটরা অনেক সময় অল্প-অক্সিজেনের আবহাওয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন, তবু তো সেখানে বাতাস বলে কিছু থাকে। আর মঙ্গলে বাতাস বলতে তা শুধুমাত্র শ্বাস অযোগ্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড। ফলে, মঙ্গলে গিয়ে মানুষ আর যাই করুক, ফুটবল বোধকরি খেলতে পারবে না। পারবে কি?
আচ্ছা পৃথিবীর চেয়ে জি-এর মান বেশি এমন গ্রহ যদি হয়? আমাদের সৌরজগতে বাকি চারটা গ্রহের তিনটাই এই তালিকায় পড়বে। বৃহস্পতি, শনি ও নেপচুন। শনি ও নেপচুনে জি-এর মান পৃথিবীর তুলনায় যথাক্রমে ১.০৬ ও ১.১২ গুণ। সবচেয়ে বেশি বৃহস্পতিতে, পৃথিবীর ২.৩৬ গুণ। জি-এর মান বেশি মানে, মহাকর্ষ বল প্রবল। তাহলে ফুটবলে কিক করাই তো খুব কঠিন হবে। কারণ, ওখানে কিক করলে ফুটবলকে মনে হবে কংক্রিটের একটা পিণ্ড। পায়ে যে চোট লাগবে তা ম্যাজিক স্প্রেতে ভালো হবে না। বল হেড করলে মাথার খুলি যে ঠিকঠাক থাকবে না বুঝতেই পারছেন। বুক পেতে বল রিসিভ করা সে তো কল্পনাতীত! শরীরে বুলেট প্রুফ কিছু চাপালে হয়তো সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, বৃহস্পতি-শনি বা নেপচুন হলো গ্যাসীয় গোলক। পৃথিবীর মতো শক্ত নয় তাদের গা। হাওয়ায় বল ভাসতে পারে কিছুক্ষণ, কিন্তু জায়গামতো গোলপোস্ট দাঁড় করিয়ে রাখবেন কী করে? আর খেলোয়াড়রাই বা দৌড়াবে কী করে?
ইউরেনাসও গ্যাসীয় গ্রহ। তারওপর জি-এর মান কম। শুক্রের চেয়ে ১৪ গুণ বড় হওয়া সত্বেও ইউরেনাসের জি-এর মান শুক্রের মতোই পৃথিবীর চেয়ে ১০ ভাগ কম। অর্থাৎ শট নিতে পারলে ফুটবল হাওয়ায় তুলনামূলক বেশি উড়ে যাবে, কিন্তু বলের সঙ্গে গ্যাসীয় পৃষ্ঠে দৌড়ে সেই বল রিসিভ করা খেলোয়াড়ের পক্ষে সম্ভব হবে না।
অতএব, ফিফা সভাপতির স্বপ্ন সত্যি হবে না। ফুটবল খেলতে চাইলে পৃথিবীর মাটিতেই খেলতে হবে। প্রয়োজনে ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশের মাঠে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসানোর স্বপ্ন দেখতে পারে ফিফা, কিন্তু অন্য গ্রহে ফুটবল খেলা অসম্ভব। আন্তঃগ্রহ ফুটবল প্রতিযোগিতা পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রলাপমাত্র। অবৈজ্ঞানিক।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুন ২০১২/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম