‘২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ৮-৯ জন ম্যাচ উইনার থাকবে’
ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম
পারিবারিক কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটিং কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন নিল ম্যাকেঞ্জি। ২০১৮ সাল থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার। গত বছর ভারত সফরে লাল দলের দায়িত্বও নিয়েছিলেন।
দায়িত্বে থাকাকালিন ড্রেসিংরুমের প্রিয় মুখ ছিলেন হাস্যোজ্জল এ কোচ। তার হঠাৎ বিদায়ে বিমূঢ় ক্রিকেটাররাও। দুই বছর লাল-সবুজের ড্রেসিংরুমে কেমন সময় কাটিয়েছেন ম্যাকেঞ্জি? স্বল্প সময়ের কাজের অভিজ্ঞতা, স্মরণীয় মুহূর্ত ও বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করে ম্যাকেঞ্জি কথার ঝাপি খুলেছেন রাইজিংবিডির সাক্ষাৎকারে। তার কথা শুনেছেন ইয়াসিন হাসান। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পড়ুন আজ।
রাইজিংবিডি: পারিবারিক কারণে দায়িত্ব ছেড়েছেন। পরিবার ছেড়ে আলাদা থাকতে চাইছেন না দীর্ঘ সময়ের জন্য। শুরুতেই জানতে চাইবো আপনার কাছে জীবনের সংজ্ঞা কী? পরিবার সেই জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে?
নিল ম্যাকেঞ্জি: আমার মনে হয়, উত্তর দেওয়ার জন্য এটা খুবই সহজ প্রশ্ন। প্রথমত, সবাই নিজের কাছে যেটাকে বেশি অগ্রাধিকার মনে করে, সেটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। আমার কাছে অগ্রাধিকারের তালিকায় পরিবার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়... বলা যায় চতুর্থ স্থান পর্যন্ত। আমি মনে করি বাকি সবকিছু এর পরে আসা উচিত।
আমার বয়স যখন ২০ বছর তখন থেকে আমি পরিবারের সিদ্ধান্তে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এরপর মাঝে মাঝে আমাদের বিদেশ সফরে যেতে হতো। শেষ দিকে কয়েক বছর ইংল্যান্ডেও খেলেছিলাম। এরপর সরাসরি দক্ষিণ আফ্রিকার কোচিং স্টাফে যোগ দেই।
দুই বছর ভ্রমণের পর কয়েকমাসের ছোট্ট একটা বিরতি পেয়েছিলাম। এরপর সোজা বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আসলে সব মিলিয়ে লম্বা সময় ধরে আমি পরিবারের কাছ থেকে দূরে। আমি এখন স্ত্রী ও বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের কাছাকাছি এবং তাদের উপস্থিতি উপভোগ করতে চাইছি।
এখনকার উঠতি তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে প্রচুর কোচ কাজ করছে। তাদের এখন থেকে একটা বার্তা দেওয়া যায়, জীবন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এর মাঝে তাদের অবশ্যই ভালো উপার্জন এবং ভালো জীবন নিশ্চিত করার জন্য ভারসাম্য করে চলতে হবে। আর এটা কেবল অল্প সময়ের জন্য নয়। বাকি জীবন চলার ক্ষেত্রেও পাথেয়।
আমাদের সময়কার জীবনের দিকে একবার ফিরে দেখুন। এখনকার উঠতি তরুণদের চেয়েও কিন্তু আমাদের জীবনে স্বাভাবিকতা কিছুটা হলেও বেশি ছিল। তবে আমি সবসময় আমার সব সিদ্ধান্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে নিয়েছিলাম, এখনও তাই।
রাইজিংবিডি: বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে দুই বছর কাটালেন। এখানেও নতুন একটি পরিবার তৈরি হয়েছিল নিশ্চয়ই। দুই বছর কেমন কাটলো?
নিল ম্যাকেঞ্জি: বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে দুই বছর কাজ করতে পারায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মানি। বাংলাদেশে থাকা পুরোটা সময় আমি অনেক বেশি উপভোগ করেছি। এখানে আমার দারুণ কিছু স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি, অসাধারণ কিছু সময় কেটেছে এবং বন্ধু পেয়েছি।
আমি এখানে দুইজন কোচিং স্টাফের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের সঙ্গ আমি দারুণ উপভোগ করেছি। প্রথমে ছিলেন স্টিভ রোডস এবং পরে আমার পুরোনো বন্ধু রাসেল ডমিঙ্গো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার কারো সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কাজ করা হয়ে উঠলো না। কারণ, আমি পারিবারিক কারণে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে সরে এসেছি।
কিন্তু ভাবনা এবং মন-মানসিকতার জায়গা থেকে আমি তাদের কাছাকাছি আছি বলেই বিশ্বাস করি। সবার সঙ্গে কাজ করাটাই বিশেষ কিছু ছিল। আমি অবশ্যই যেখানে থাকি না কেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজ নিবো। এমনকি সুযোগ পেলে যেকোন অবস্থায় তাদের সঙ্গে কাজ করবো। আমাকে ভালোভাবে গ্রহণের জন্য সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাই; এবং আবারও বলছি, বাংলাদেশের সময়টা আমি অনেক উপভোগ করেছি।
রাইজিংবিডি: যে লক্ষ্য ঠিক করে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেই লক্ষ্য কতোটুকু পূরণ হয়েছে?
নিল ম্যাকেঞ্জি: আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, আমি বাংলাদেশের কোচিং প্যানেলে যুক্ত হতে যাচ্ছি। আমি তখন মাত্রই আফ্রিকা জাতীয় দলের হয়ে দায়িত্ব পালন শেষ করেছিলাম। এমন সময় বাংলাদেশ থেকে ব্যাটিং পরামর্শক হওয়ার প্রস্তাব পাই। এটা আমার জন্য সহজ কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ তখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ একদম কাছাকাছি ছিল। আর আমি বাংলাদেশের প্রতিভা সম্পর্কে তেমন অবগতও ছিলাম না। আপনারাও নিশ্চয়ই কিছুটা অবাক হয়েছিলেন আমাকে দেখে। তবে এখানে দারুণ সব প্রতিভা আছে। আমি এখানে সিনিয়র ক্রিকেটারদের পাশাপাশি উঠতি ক্রিকেটারদের সঙ্গে কাজ করে বেশ মজা পেয়েছি।
রাইজিংবিডি: আপনাকে ছেলেরা খুব পছন্দ করেছে। লিটন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে, আপনাকে সে খুব মিস করবে। সৌম্য সরকারও তাই। তাদের আপন হওয়ার কাজটা মোটেও সহজ ছিল না...
নিল ম্যাকেঞ্জি: বাংলাদেশে কাজ করাটা আমার জন্য বিশেষ কিছু ছিল। আমি এখানে নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে চেয়েছি কেবল। খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিশে তাদের গড়ে তুলতে চেয়েছি। এটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। তাদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ।
আমি এখন হয়ত পারিবারিক কারণে বিদায় নিচ্ছি। তবে এখানে আমার যে বন্ধু বা কাছের মানুষ হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো। টাইগার ক্রিকেটের খোঁজ নিবো। এখানে অসাধারণ সব ক্রিকেটার রয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ আসন্ন সময়ে নিজেদের ক্রিকেটকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাবে।
রাইজিংবিডি: সৌম্য, লিটন, নাঈমদের মতো তরুণদের নিয়ে বেশ কাজ করেছেন? তাদের স্বাধীনভাবে খেলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন আপনি ওদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পেরেছেন?
নিল ম্যাকেঞ্জি: এখানে এমন অনেক ক্রিকেটার রয়েছে, যারা কেবল জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। তারা নিজেদের আরও সম্মানের জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। তারা জাতীয় দলে খেলে বিশ্ব ক্রিকেটে আলাদা জায়গা করে নিতে চায়। এটা-ই বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং সেই ক্রিকেটারের জন্য অনেক ভালো খবর। তারা এখন আর ৩০ গড়ে রান করে খুশি নয়। তারা সেই গড়কে ৪৫-৫০ এর মাঝে নিতে চায়। আর দলের মধ্যে এখন এই সুস্থ প্রতিযোগিতাই চলছে। যা দলের জন্য অনেক ভালো। তারা এখন কেবল ম্যান অব দ্য ম্যাচ বা সিরিজে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না।
গত দুই বছরে লিটন দাস নিজের অনেক উন্নতি করেছে আর এটাই তার সত্যিকারের প্রতিভা। আগামী পাঁচ-ছয় বছর পর বাংলাদেশ কোন অবস্থায় থাকে সেটি দেখার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব। বোর্ড এখন সৌম্য, শান্ত এবং ফিজের (মুস্তাফিজ) প্রতি আস্থা রাখতে চাইছে। তবে এখানে অন্যরাও দারুণ প্রতিভাবান। তারা এখন অভিনব উপায়ে অনুশীলন করছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য সামনের পাঁচ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ।
রাইজিংবিডি: তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের মতো সিনিয়রদের নিয়ে কাজ করেছেন। আবার একেবারে তরুণ একজনকে নিয়েও ঘাম ঝরিয়েছেন। কার সঙ্গে কাজ করা ছিল সবচেয়ে সহজ?
নিল ম্যাকেঞ্জি: এখানে ক্রিকেটাররা এসে নিজ থেকে তাদের সমস্যার কথা বলে। ক্রিকেট নিয়ে তাদের ভাবনার কথা বলে। এটা আসলে শেখার সবচেয়ে ভালো উপায়। আমি তাই এই বিষয়টি অনেক গুরুত্বের সহকারে দেখি। আমি ভাগ্যবান এমন ক্রিকেটারদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে। তরুণ থেকে সিনিয়র সবাই খুব সহযোগিতা করেছে।
আমাকে যেটা মুগ্ধ করেছে, সেটা হলো, দলের কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারের ওয়ার্ক এথিকস। মুশির কথাই ধরুন। সে সবসময় তার অনুশীলন এবং ম্যাচ প্রস্তুতি নিয়ে ফোকাস থাকে। সে অনুশীলনে সবসময় মেরে খেলতে পছন্দ করে না। এছাড়াও সে অনুশীলনে কিছু না কিছু কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। আমরা তাকে বলি, রিল্যাক্স হতে। তবে সে নিজের সবসময় উন্নতি করতে চায়। সে প্রতিবারই নেটে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যায়। তরুণরা তার থেকে এই শিক্ষাটা নিতে পারে।
অপরদিকে তামিম ম্যাচে নামার আগে অনুশীলনে মারমুখী থাকে। তবে সে ম্যাচে কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, এটা নিয়ে অনেক ভাবতে থাকে। দুইজনই কিন্তু ক্রিকেট এবং নিজেদের খেলা নিয়ে খুব ফোকাস থাকে। তরুণরা তাদের থেকে আসলে শিখতে পারে। কে কেমন ভাবছে, একজন এত বল খেলছে তো অপরজন কেন খেলছে না? এসব ধারণা নিতে পারে।
আপনি যখন এমন স্কোয়াড নিয়ে অনুশীলনে নামেন, যারা আগের চেয়ে এক শতাংশ হলেও নিজেদের উন্নতি করতে চায়, তখন দেখবেন অনুশীলনের পরিবেশ দারুণ এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন এই পরিবেশ বিরাজ করছে। আর সিনিয়র-জুনিয়ররা সবাই তাদের অবসরের আগে পর্যন্ত এটা ধরে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। এটা টাইগার ক্রিকেটের জন্য ইতিবাচক এবং আমি খুশি যে, তারা আমার কাজকে সহজ করে দিয়েছে।
সবাই আমার কাছে জানতে আসতো। কে কিভাবে কেমন প্রস্তুতি নিতে পারে, জানতে চাইতো। আসলে কারো হয়ত এক কাপ কফিই সমাধান, তো কারো প্রয়োজন টেকনিক্যাল পরামর্শ। আসলে সবাই নিজেকে সেরা অবস্থানে দেখার জন্য নিজের মতো করে পরামর্শ নিতো। আর এটা কেবল তার জন্যই উপকারী নয়, বাংলাদেশের জন্যও বটে।
রাইজিংবিডি: বাংলাদেশে থাকাকালিন আপনার সেরা মুহূর্ত?
নিল ম্যাকেঞ্জি: আপনি যদি সেরা মুহূর্তের কথা বলতে বলেন আমি অবশ্যই বলবো বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফ, খেলোয়াড়দের কথা। তাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের সাফল্য, আমাদের ব্যর্থতা আমরা ভাগ করেছি। এটাই একটা সুখী পরিবারের চিত্র। যদি মাঠের সাফল্যর কথা বলতে বলেন, অবশ্যই বলবো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারানো ছিল অনেক বড় অর্জন। ওই ম্যাচে আমার মিশ্র অনুভূতি ছিল। সবাই তো জানেন, দক্ষিণ আফ্রিকা আমার মাতৃভূমি। দেশের পতাকা উড়ছে না এটা দেখে খারাপ লেগেছিল। আবার আমি যে পরিকল্পনা করে বাংলাদেশকে জিতিয়েছি সেটা দেখে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছে।বিশ্বকাপে আমরা একাধিকবার তিনশর বেশি রান করেছি। ব্যাটিং কোচ হিসেবে এটা দেখতে ভালো লেগেছে। আবার ব্যক্তিগত সাফল্যগুলোও আমাকে নাড়া দিয়েছি। সব মিলিয়ে দুই বছর দারুণ সময় কেটেছে বাংলাদেশে।
রাইজিংবিডি: ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা?
নিল ম্যাকেঞ্জি: সামনের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য কন্ডিশন অনুকূলেই থাকবে। আমার মনে হয়, এখনকার দলের অনেক ক্রিকেটার সে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এখনকার ক্রিকেটারদের ফিটনেস অবশ্যই ধরে রাখা উচিত, তাহলে তারা সেখানে অংশ নিতে পারবে। যদি তারা মানসিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকে, তবে সামনের তিন বছর তারা অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে পারবে। তখনকার বাংলাদেশ দল হবে অনেক অভিজ্ঞ। সে দলে বর্তমান সময়ের মতো ৪-৫ জন নয় বরং ৮-৯ জন ম্যাচ উইনার থাকবে।
ঢাকা/ইয়াসিন
আরো পড়ুন