ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘সাকিব যখন ২২ গজে তখনই তার সেরা রূপটা দেখা যায়’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ১৯ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৫:৩৪, ১৯ মার্চ ২০২২
‘সাকিব যখন ২২ গজে তখনই তার সেরা রূপটা দেখা যায়’

ঘরের উঠোনে নিজ দেশের পরাজয় মানতে পারেন না কেউ-ই। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলে যখন থাকে পুরোনো শিষ্যরা, তখন কিছুটা গর্ব অনুভব তো হবেই। সেঞ্চুরিয়নে ধারাভাষ্যে বসে নিল ম্যাকেঞ্জি তেমনই মিশ্র অনুভূতি পেলেন। ডুসেন-মিলারদের পরাজয়ে খুশি নন এই প্রোটিয়ান। তবে বাংলাদেশের সাবেক ব্যাটিং কোচ ঐতিহাসিক জয়ে প্রশংসায় ভাসালেন সাকিব, লিটন, তাসকিনদের।

শনিবার (১৯ মার্চ) সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাইজিংবিডির ক্রীড়া প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসানের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশের প্রোটিয়া দূর্গ ভাঙার গল্প শুনিয়েছেন নিল ম্যাকেঞ্জি। কথোপকথনে উঠে এলো আরও অনেক কিছু। বিস্তারিত তুলে ধরা হলো রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য।

রাইজিংবিডি:  দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় কতটা উপভোগ করেছেন?
নিল ম্যাকেঞ্জি:
দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে এই ফল নিশ্চয়ই আমি উপভোগ করিনি। এছাড়া বাংলাদেশের হয়ে এখন আর কাজও করছি না। এজন্য আমার কাছে ফলটা উপভোগ্য নয় কোনোমতেই!

তবে বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে তাতে কিছুটা গর্ব খুঁজে পাচ্ছি। কারণ, এই দলের ৯৫ শতাংশ খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার কাজ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না দলগত নৈপুণ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সগুলো দারুণ ছিল। দলগতভাবে তারা খুব আত্মবিশ্বাসী মাঠে তা দেখিয়েছে। প্রত্যেকের ওপর বিশ্বাস রেখে কোচিং স্টাফরা যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা ঠিকঠাক পালন করেছে।

খুবই ভালো লাগছে বাংলাদেশ দেশের বাইরে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে নিজেদের মেলে ধরছে। বেশ ভালো ব্যাটিং পারফরম্যান্স ছিল। এক কথায় বলবো, অলরাউন্ড ক্লিনিক্যাল টিম পারফরম্যান্স।

রাইজিংবিডি: সাকিব শুরুতে এই সফরে আসতে চায়নি। বলেছিলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট নন। কিন্তু ২২ গজে তাকে দেখে একবারও কি মনে হয়েছে তেমন কিছু?
নিল ম্যাকেঞ্জি:
দেখুন, মাঠের সাকিবের সঙ্গে আপনি কোনো কিছুকে তুলনা করতে পারবেন না। সে যখন ২২ গজে, তখনই তার সেরা রূপটা দেখা যায়। মাঠের বাইরে কি হচ্ছে সেই সম্পর্কে নুন্যতম ধারণা থাকে না। শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট না থাকার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে মাঠে তাকে প্রাণবন্ত, সতেজ লেগেছে। মনে হয়েছে অন্য সবার মতোই জয়ের নেশায় বুদ হয়ে ছিল। খুব ভালো পারফরম্যান্স। বিশেষ করে যেভাবে গিয়ার শিফট করে চড়াও হয়েছিল তাতে ম্যাচের দিক পরিবর্তন করে।

রাইজিংবিডি: আপনি কি বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরবর্তী বড় দল হবে যারা যেকোনো মাঠে যেকোনো ম্যাচ জিততে পারে?
নিল ম্যাকেঞ্জি:
আমরা সবাই জানি, ৫০ ওভারের ক্রিকেট বাংলাদেশের ছেলেরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। এই ধরণের জয় প্রমাণ করে যে, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় দল হয়ে উঠতে পারে। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে নিজেদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ কতটা শক্তিশালী সবাই জানে। এই জয় নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে দেশের বাইরেও পারফর্ম করতে এবং তারা কতটা সামর্থবান সেটাও প্রমাণ করে।

মূল বিষয়টা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বুদ্ধিদীপ্ত পারফরম্যান্স করছে, তারা পরিণত হয়েছে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। তরুণ যারা আসছে তারা ভয়ডরহীন। ইয়াসির আলী মাঠে এসে সাকিবের সঙ্গে ম্যাচটা পরিবর্তন করে দিলো। আমরা সাকিব, লিটনের থেকে এরকম পারফরম্যান্স আগে পেয়েছি। আপনি তরুণদের কিভাবে সুযোগ দিচ্ছেন, কতোবার সুযোগ দিচ্ছেন সাফল্যের জন্য সেগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, তিন পেসার… শরিফুল, তাসকিন ও মোস্তাফিজ গতকাল অসাধারণ বোলিং করেছে। বাংলাদেশের বোলাররা সব সময়ই স্কিলফুল ছিল। কিন্তু তাদের গতির ধারাবাহিকতা ছিল না। দেশে তাদের সেই কাজ করার সুযোগ কম। কিন্তু দেশের বাইরে তারা করে দেখিয়েছে যে, সঠিক লাইন ও লেন্থে বোলিং করলে তারাও আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারে। সত্যিই তাদের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছি।

ব্যাটিং বাংলাদেশ ভালো করে। আমি যখন কোচ ছিলাম ববাবরই তাদেরকে বলেছি, পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বড় শট খেলতে। সেটাই গতকাল তারা করেছে। তারা বড় শট খেলেছে। ম্যাচটা বের করে এনেছে।

রাইজিংবিডি: সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখান থেকে কি করার দরকার?  
নিল ম্যাকেঞ্জি:
আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ বড় দলগুলোর বিপক্ষে যেকোনো মঞ্চেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে। এজন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে হবে। ছেলেদের পূর্ণ সমর্থন, বারবার সুযোগ দিতে হবে। এক পজিশনের জন্য একাধিক খেলোয়াড় তৈরি করে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা বাড়াতে হবে।

কোনোভাবেই মনোবাল হারানো যাবে না। একটি ম্যাচ হারলেই সব শেষ এরকম ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ক্রিকেট বাংলাদেশের কাছে আবেগের মতো। হারলেই সব শেষ— এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। দল হারতে পারে, বাজে দিন কাটাতে পারে। কিন্তু আপনি কিভাবে ঘুরে আসবেন সেটা ম্যাটার করে। এছাড়া দলে যাকে নেওয়া হচ্ছে তার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। সে আপনাকে জিতিয়ে আসতে পারে সেই বিশ্বাস রাখতে হবে। তারা কেউই রোবট নয়। আপনি প্রত্যেকবার যেভাবে চাইবেন সেভাবেই তারা পারফর্ম করবে এমনটা নয়।

উদাহরণ হিসেবে লিটনের কথাই ধরুণ। লিটনের প্রতি যে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটা দেখুন। লিটনের পারফরম্যান্স আহামরি ছিল না। দল থেকে বাদ পড়তো। আবার দলে আসতো। স্টিভ রোডসের অধীনে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। রাসেল ডমিঙ্গোও তাকে এগিয়ে নেয়। তাকে আমরা সুযোগ দিয়েছি। আমরা জানতাম সে ভালো ক্রিকেটার। এখন দেখুন সে কতোটা দায়িত্ব নিয়ে আস্থার প্রতিদান দিচ্ছে। আমি মনে করি বড় দল হয়ে উঠতে এভাবেই আস্থা রাখা উচিত। সঙ্গে ক্রিকেটারদেরও নিজেদেরকে খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, যখন একজন খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয় তাকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা আপনার। এমন না যে, তাকে আনলেন আর বাদ দিলেন।

রাইজিংবিডি: বলা হয়, বোলাররা বড় পার্থক্য তৈরি করে দিতে পারে?
নিল ম্যাকেঞ্জি:
দেশের বাইরে সফলতার জন্য তিন পেসারের ভূমিকা অপরিহার্য। ব্যাটসম্যানরা নিজেদের তৈরি করে ভিন্ন কন্ডিশনে বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নেবে। কিন্তু প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের আসল পরীক্ষা নেবেন বোলাররাই। আপনি দেখেন, নিউ জিল্যান্ডে ইবাদত অসাধারণ পারফর্ম করেছিল। দেখুন আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যান কিন্তু অনেক বেশি। কিন্তু আমরা তেমন লম্বা পেসার কিন্তু পাইনি। এখন ইবাদত আছে। শরিফুলকে পেয়েছি। তাসকিন আছে। যারা ভালো জায়গায় বল ফেলতে পারে। তাই তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। আমি মূলত ব্যাটসম্যানদের নিয়ে কাজ করি। কিন্তু কোচিং প্যানেলে থাকলে আপনার দায়িত্ব সবাইকে নিয়েই কাজ করা। সেই কাজটা বাংলাদেশে থাকাকালিন করেছি। এখন যারা আছে তারা আশা দেখাচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে ২০ উইকেট নিতে পারলেই সফলতা মিলবে। ওয়ানডে ক্রিকেটেও আপনাকে শুরুতে আক্রমণ করতে হবে। যেটা গতকাল দুই পেসার করেছে। ৪০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাকফুটে ছিল।

রাইজিংবিডি: লিটন বড় স্কোর করলে আপনি কতোটা খুশি হন? আপনি সবসময় তার ব্যাটিং ভক্ত ছিলেন।
নিল ম্যাকেঞ্জি:
আমি সত্যিই লিটনে মুগ্ধ ও খুশি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সব সময়ই কঠিন। আপনার সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। পেছন থেকে কেউ আপনাকে আগলে রাখছে এমন আস্থার প্রয়োজন হয়। লিটন নিশ্চিতভাবেই সেই সমর্থন পেয়েছে। আমি যখন তাকে প্রথম পেয়েছি তখন দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিল। স্থির ছিল না। কিন্তু আমাদের হাতে আসার পর তাকে আমরা সমর্থন করা শুরু করি। তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করি। ফ্রি খেলার রসদ দেই। এমন না যে ২০-২৫ রান করে চলে আসো। তাকে ইনিংস বড় করার সময়ও দেয়া হয়েছিল। গতকাল সে ও তামিম মন্থর ব্যাটিং করলেও তারা কঠিন কাজটা করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন বলে ব্যাটিং সব সময়ই কঠিন। পুরো কথাই ফিরে যাই, দল হারলেই কাউকে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে আনতে হবে এমন ভাবনা ভুল। লিটনকে নিয়ে আমরা ম্যাচ হেরেছি। কিন্তু আস্থা হারাইনি। এখন লিটন ম্যাচ জেতাচ্ছে। আপনাকে প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকে সবাইকে সাহায্য করতে হবে। সফলতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। লিটন হচ্ছে দল নির্বাচন প্রক্রিয়ার আদর্শ উদাহরণ। খুব খুশি হই যখন দেখি সে বড় স্কোর করছে। 

রাইজিংবিডি: দ্বিতীয় ওয়ানডেতে নিশ্চয়ই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে? 
নিল ম্যাকেঞ্জি:
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশই আমার দ্বিতীয় দল। তারা এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিহাস তৈরি করেছে সে জন্য ভালো লাগছে। তবে রোববার বড় ম্যাচ অপেক্ষা করছে। আমি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য গলা ফাঁটাবো। ওয়ান্ডারার্সে দক্ষিণ আফ্রিকা ভয়ঙ্কর দল। আমি মনে করি, দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই দুই দলের আসল যুদ্ধ হবে।

ঢাকা/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়