ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ৯ অক্টোবর ২০২০  
মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা

একজন মানুষের পরিপূর্ণতা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? কে বা কারা নিজেকে পরিপূর্ণ দাবি করতে পারেন? এর সহজ কোনো উত্তর নেই। একজনের পরিপূর্ণতা বোধের সঙ্গে অন্য কারো পরিপূর্ণতা বোধের মিল নাও থাকতে পারে। আমরা যে কাজটি করতে পারি তা হলো- কে অপরিপূর্ণ তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর কোনো মানুষই নিখুঁত নন। তবে চাইলে কেউ পরিপূর্ণ হতে পারেন। নিখুঁত হওয়া আর পরিপূর্ণ হওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক। আজকের এ লেখা জীবনের পরিপূর্ণতা নিয়ে।

যিনি জীবন নিয়ে পরিপূর্ণ নন কিংবা পরিপূর্ণ হবার পথেও নন তিনি সবসময় একটি দ্বন্দ্বে থাকেন। নিজেকে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চান, সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তাই যে কোনো অনুষ্ঠানে তার সামনের সারিতে বসার প্রবণতা থাকে। এছাড়া তার পরিচয় যেন আগে থেকেই সবাই জানে কিংবা কোথাও উপস্থিত হবার পর সবাই যেন তাকে ঠিকমতো চিনতে পারে সেজন্য অন্যকে, অধীনস্তকে ব্যবহার করার চেষ্টা তার থাকে। সবসময়ই তার মনে হতে থাকে, আশেপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি কিংবা মানুষজন তাকে ঠিকমতো মূল্যায়ন করছে না। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কিংবা লোকসমাগমে তিনি কারণে-অকারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। চলার পথে তিনি চাইবেন সবাই তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করুক। আমাদের বর্তমান জীবনে আবশ্যিক হয়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিপূর্ণ মানুষেরা নিজেদের স্তুতি নিয়ে অনেক ব্যস্ত। কারণে-অকারণে নিজের ছবি দিয়ে, নিজের অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় খবর প্রকাশ করে সবাইকে আকৃষ্ট করতে চান। এ যেন আত্মমুগ্ধতা বা আত্মমগ্নতা (Narcissism, গ্রিক দেবতা Narcissus তার নিজের সৌন্দর্যেই মুগ্ধ হবার বিষয়টিকেই Narcissism বলে)। বিজ্ঞানীগণ Narcissism কে মানসিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির দৈন্য বলে অভিহিত করেছেন।

একজন পরিপূর্ণ মানুষের অন্যের প্রতি আগ্রহ কম। বিশেষ করে, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে তিনি নির্বিকার থাকবেন। মানুষের পরিপূর্ণ হবার অনেকগুলো উপকরণের অন্যতম একটি হলো- খাবার দেখে লোভ না করা। অথবা অন্যের থেকে পাওয়া আতিথেয়তায় তৃপ্ত থাকা। যিনি ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট খাবার খেয়ে বড় হয়েছেন কিংবা দেখেছেন যে তার পিতামাতা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার আন্তরিকতার সঙ্গে খেতে দিয়েছেন, তিনি পরবর্তীতে খাবার নিয়ে কোনো আক্ষেপ করবেন না। এর সঙ্গে সম্পদের প্রাচুর্য্যের সম্পর্ক নেই। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। অফিসে সভা, সেমিনারে নাস্তা পরিবেশন করা হয়। কোনো কারণে নাস্তা না পেলে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। কিংবা বিয়ে বাড়িতে খাবার না পেয়ে অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নিজেকে ছোট আর গুরুত্বহীন ভেবে নিয়ে তারা যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তা পরিপূর্ণতার বিপরীত। অথচ একবেলা নাস্তা বা খাবার না খেলে কিছুই হতো না।

একা থাকাটা অপরিপূর্ণ মানুষের জন্য কষ্টকর। বিপরীতে একজন পরিপূর্ণ মানুষ তার একাকীত্ব অনুভব করতে চাইবে। এটি খুব জোরালো বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ মানুষের মধ্যে basic instinct হিসেবে introvert (অন্তর্মুখী) ও extrovert (বহির্মুখী) হবার দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোনটাই তার দুর্বলতা নয়, বরং যার যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেটিই তার শক্তি। তবে একাকীত্ব দূর করার জন্য হোক আর না হোক অপরিপূর্ণ মানুষ তার চেয়ে অধিনস্তদের সঙ্গে গল্প কিংবা নিজেকে উপস্থাপন করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। পক্ষান্তরে, একজন পরিপূর্ণ মানুষ যে কোনো মর্যাদার মানুষের সঙ্গে মেশার যোগ্যতা রাখবেন। একটি বিষয় খুবই মজার। একজন অপরিপূর্ণ মানুষের কাছে কেউ তার দুঃখ-কষ্ট বর্ণনা করে নিজেকে হালকা করতে চাইলে উল্টো ফল হতে পারে যেটি পরিপূর্ণ মানুষের ক্ষেত্রে অসম্ভব। যেমন, আপনি একজনকে আপনার শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেন। তিনি যদি মানুষ হিসেবে অপরিপূর্ণ হয়ে থাকেন, তবে তিনি শারীরিক খারাপ অবস্থার কথা শুনিয়ে দেবেন।

পরিপূর্ণ মানুষ চিনতে গিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা যেতে পারে তা হলো মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য। পরিপূর্ণ মানুষের কাছে মানুষের মনের সৌন্দর্যের কাছে বাহ্যিক বা অন্যান্য লোক দেখানো সবকিছুই অর্থহীন মনে হবে। সত্যিকার অর্থেই, একজন মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যের কাছে অন্য সব কিছুই গুরুত্বহীন। তাত্ত্বিকভাবে কথাটি সত্য ধরে নিলেও বাস্তবে আমরা ভিন্নভাবে চিন্তা করে থাকি। বলা হয়, প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। পরিপূর্ণ মানুষের জন্য শতভাগ ক্ষেত্রে এরকম হবার কোনো সুযোগ নেই। কার্যত মানুষের বাইরের সৌন্দর্যের মূল্য নেই, কেউ মানুক আর না মানুক। মানুষ হিসেবে কাউকে বিবেচনা করতে হলে দেখতে হবে কার ভেতর ও বাহির একই রকম এবং সর্বক্ষেত্রে একই রূপ প্রকাশ করে থাকে।

একজন অপরিপূর্ণ মানুষের যৌন চাহিদার বিষয়ে সব সময় নিজেকে বঞ্চিত মনে হবে। এ জন্য বয়স বা অন্যান্য বিচার-বিবেচনা না করে বিপরীত লিঙ্গের প্রায় সবাইকেই গায়ে পড়ে বাজিয়ে দেখার প্রবণতা তার মাঝে থাকবে। প্রচলিত ধারণায় এটিকে সুযোগ নেওয়া বলা যেতে পারে। এটি পুরুষ-নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। যদিও শারীরিক তারতম্যের কারণে পুরুষের ক্ষেত্রে এ চর্চা হয়তো বেশি প্রকট। চলার পথে, অনুষ্ঠানে মেয়েদের দেখলে আমরা পুরুষরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই তা কোনোভাবেই সম্পূর্ণ মানুষ হবার লক্ষণ প্রকাশ করে না। বয়সের তারতম্য ভেদে ১৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী সকল পুরুষ প্রায় একই ধরনের কামনার দৃষ্টিতে উচ্ছ্বসিত হন। কোনো সুশ্রী, সুন্দর গড়নের নারী দেখলে যারা ইতরের মতো লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকে বিছানার সঙ্গী মনে করতে গিয়ে এক ধরনের অযাচিত আনন্দ উপভোগ করেন তাদের জীবনে পরিপূর্ণতা আসেনি। বয়সের কারণে যিনি শারীরিকভাবে অক্ষম তিনিও দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের ফসল হিসেবে আনন্দ পাচ্ছেন। ভাবুনতো, এ পুরুষগুলো সারা জীবন ধরে কী কষ্টই না পাচ্ছেন! এরা কিভাবে, কখন পরিপূর্ণ হবে? অযাচিত যৌন চাহিদা মানসিক দৈন্যের বিষয়। একটি উদাহরণ দেই। আপনি বিধবা বা বিপত্নীক। আপনার পাশের ফ্ল্যাটে যে দম্পতি বাস করেন তারা আপাত দৃষ্টিতে সুখী। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জৈবিক সুখ দেখে আপনি যদি কোনোরূপ কষ্টে আটকে পড়েন তাহলে আপনিও পরিপূর্ণ নন। যে লোক অন্যায় কাজটা না করে কষ্ট পেয়ে সে কষ্ট চেপে রাখবে সেও অপরিপূর্ণ। যিনি কষ্ট ছাড়া সাময়িক অবৈধ সুখের বিষয়টি অগ্রাহ্য করতে পারবেন তিনি পরিপূর্ণ মানুষ।

প্রসঙ্গ আসতে পারে, পরিপূর্ণ মানুষ ভুল করে কিনা; করতেই পারে। অনেক সময়ই মানুষ ভুল করে। সে ভুল অন্যকে কষ্ট দেয়। আবার অনেক সময় তার ভুল নিজেকেও কষ্ট দেয়। কথা হচ্ছে, আপনি এক জীবনে কতবার ভুল করবেন? সে ভুলের সর্বোচ্চ সংখ্যা কত হবে? একজন পরিপূর্ণ মানুষের ভুলের সংখ্যা সীমিত হবে এবং সে ভুলের কারণে অন্যের ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা কম। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে একজন অপরিপূর্ণ মানুষ নিজের ভুল অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাইবেন, যেটা পরিপূর্ণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে তিনি অন্যের ভুল নিজের গায়েও নিয়ে নিতে চাইবেন। একজন অপরিপূর্ণ মানুষ কিংবা যে মানুষ এখনও পরিপূর্ণতার পথে চলতে শুরু করেননি এরা অন্যকে অনেক বেশি গালাগালি, উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পছন্দ করেন। অপরিপূর্ণ মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তারা বিরক্তি প্রকাশ করতে খুব ভালোবাসেন।

একজন পরিপূর্ণ মানুষ অন্যকে সম্মান করে আনন্দিত হন। শিক্ষা মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। এটা কেতাবি শিক্ষা নয়। যার সঙ্গে থাকলে আপনার নিজের উচ্চতা বেশি মনে হবে অথবা অবস্থান সুদৃঢ় মনে হবে তিনিই তত বেশি শিক্ষিত, তিনিই তত পরিপূর্ণ। Aristotle বলেছেন, “Educating the mind without educating the heart is no education at all.” নিজে দোষ করে থাকলে একজন পরিপূর্ণ মানুষ তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন, আর বিপরীত চিত্র দেখা যাবে অপরিপূর্ণ মানুষের ক্ষেত্রে। সাধারণভাবে, মানুষ তার দোষ স্বীকার করতে চায় না। বরং নিজের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। তার কাজটা কেন সঠিক ছিল সে বিষয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয় আর অন্যের কাছে এর যে কোন প্রকার যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেয়। পরিপূর্ণ মানুষ এর ব্যতিক্রম। এছাড়া অন্যকে সম্মান করতে পারার যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক একজন পরিপূর্ণ মানুষের জন্য এক বিন্দু অহঙ্কারী  হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই।

পরিপূর্ণ মানুষের অন্য মানুষের উপর চাহিদা বা প্রত্যাশা কম থাকে বলে অনেক বেশি সুবিবেচক ও সহনশীল হন। একজন পরিপূর্ণ মানুষ যতখানি কষ্ট-সহিষ্ণু হন একজন অপরিপূর্ণ মানুষ ঠিক তার বিপরীত। পরিপূর্ণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার একটা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা থাকে। অন্যদিকে অপরিপূর্ণ মানুষেরা প্রতিনিয়ত তাদের চাওয়া বদল করেন। পরিপূর্ণ মানুষ তার আগ্রহ, লক্ষ্যের বিষয়ে সচেতন। তিনি জানেন কী কী বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে, কতটুকু আগ্রহ রয়েছে। অপরিপূর্ণ মানুষের আগ্রহের জায়গা অনির্দিষ্ট।  
পরিপূর্ণ মানুষের জীবনের ব্যাপ্তি অনেক বড়। জীবনের ছোট ছোট অনুষঙ্গগুলো গুরুত্বহীন না হলেও পরিপূর্ণ মানুষের কাছে জীবন অনেক অর্থবহ। জীবনের ছোট অনুষঙ্গগুলো বাদ দিলে মোটামুটিভাবে মূল উপাদান হল- খাওয়া, ঘুম, পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়, সেক্স, চাকুরি বা ব্যবসা, ভ্রমণ। আপনি খুব সচেতনভাবে একটি ইনডেক্স তৈরি করে নিতে পারেন। পরিপূর্ণ মানুষের জীবনে এ সব উপাদানের একটি ভারসাম্য থাকে। একজন অপরিপূর্ণ মানুষের কাছে অনেক সময় তার চাকুরি বা ব্যবসা বড় হয়ে যায়। টাকা উপার্জন জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

অপরিপূর্ণ মানুষেরা নিজের শিকড়ের সঙ্গে বা অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অনেক সময় হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। যেমন, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। নিজে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে বড় হলেও যখন চাকরি বা অন্য কারণে শহরে থাকতে হয় তখন আঞ্চলিকতা পরিহার করে চলার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাই সন্তানদের শুদ্ধ বাংলায় কথা শেখানোর একটি প্রয়াস থাকে। নিজেকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে নিজের শিকড় অবজ্ঞা করে চলার এ কাজটি পরিপূর্ণ মানুষেরা করেন না।

কেন একজন মানুষ পরিপূর্ণ হতে পারেন না কিংবা পরিপূর্ণতার পথেও চলতে পারেন না? কেন এমন হয়? মানুষের জীবন অনেকটা ব্যবসা কৌশলের মতোই। যত বেশি বিনিয়োগ করবেন তত বেশি প্রাপ্তি যোগ হবে। যার জীবনে বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হবে তিনি তত পরিপূর্ণ হবেন এবং তিনি অন্যকে তত বেশি দিতেও পারেন। বিনিয়োগের এ শুরুটা হয় মূলত পরিবার থেকে। যথার্থ, সঠিক বিনিয়োগ করলে একজন মানুষ পরিপূর্ণ হয়। সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের উৎস হলো পরিবার। বাবা-মা সবচেয়ে বড় শিক্ষক, সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। এছাড়া আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশী সবার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিনিয়োগই একজন মানুষ পরিপূর্ণ হয়। পরিবার থেকে মানুষের যেসব বিনিয়োগ হয়ে থাকে তার প্রথমটি হলো ভালোবাসা, স্নেহ, আদর। ভালবাসা বা আদরে কেউ নষ্ট হয় না বরং সঠিক আদরের অভাবেই মানুষ নষ্ট হয়। ভালোবাসা কী? ভালোবাসা আসলে একটি প্রতিফলন। ভুলে যাবেন না যে, আপনি যাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছেন কিংবা অস্বস্তি বোধ করছেন আপনাকে দেখে তারও একই অনুভূতি হচ্ছে। আপনাকে কেউ ভালোবাসলে আপনি নিশ্চিত বুঝতে পারবেন। এটি একটি দারুণ সমঝোতা ও সমন্বয়ের জায়গা। অফিসে এমন হতে পারে, যার সঙ্গে আপনাকে কাজ করতে হচ্ছে তিনি আপনাকে পছন্দ করছেন না এবং আপনিও পছন্দ করছেন না। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দুজনেই এটি বুঝতে পারছেন। এ বিষয়টি নিজের পরিবারের মানুষের ক্ষেত্রেও সত্যি। কথায় আছে, You cannot choose your family and colleagues but you can choose your friends.

এখানে উল্লেখ্য, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মানুষের জীবনে বন্ধুত্ব কেন গুরুত্বপূর্ণ? সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বন্ধুর সঙ্গে যেসব ভাবনা বিনিময় করা যায় তা আর কারও সঙ্গে করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কারো সঙ্গেও নয়। এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গেও নয়। আমরা ভাবি যে আমাদের সবারই অনেক বন্ধু। আসলেই কি তাই? যাদের আপনি বন্ধু ভাবছেন তারা কি আসলেই আপনার বন্ধু? কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন? তিনি কতদিন থেকে বন্ধু? তার কি কোন স্বার্থ নেই আপনার সঙ্গে? বন্ধুত্ব সম্পর্কটা এতটাই জটিল যে খুব সহজে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ নেই। ভার্চুয়াল জগতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রভাবে বন্ধুত্ব বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। একটু চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরুণ, এক) রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে কে বিল দেবে সেটা নিয়ে কোনো টেনশন নেই, বিল যত টাকারই হোক। কার পকেট থেকে যাবে সেটা নিয়ে ভাবার দরকার নেই কারণ কেউ একজন দিলেই হবে; দুই) কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতে বললে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সে আপনার জন্য সেটা করবে; আপনিও তার জন্য সেভাবেই করবেন; তিন) একমাত্র বন্ধুকেই ‘তুই’ করে বলা যায়; চার) ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিলে সে উল্টাপাল্টা না লিখে আপনার অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করবে; পাঁচ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার সঙ্গে থাকলে আপনার নিজের উচ্চতা বেশি মনে হবে। প্রশ্ন হলো, কে আপনার খুব ভালো বন্ধু হতে পারে? যে আপনার জন্য বেশি স্বার্থ ত্যাগ করবে তিনিই আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং তা পরস্পরের পরিপূরক হবে। কে বন্ধু হবে সেটারও সঠিক উত্তর জানা নেই। তবে অনেকাংশেই তার সঙ্গে আপনার পছন্দের রং মিলে যাবে, খাবারের রুচি মিলবে কিংবা গানের সুর-পছন্দ মিলে যাবার সম্ভাবনা বেশি।

পরিবার ও অন্যান্যদের বিনিয়োগের পাশাপাশি স্বীয়-সৃষ্ট পরিপূর্ণ মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বরং একটা বয়স শেষে নিজেকে নিজেরই প্রস্তুত করতে হয়। একটা সময়ে নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষক। বিনিয়োগ করার জন্য তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ: চিন্তা, প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়তা। জীবন চলার পথে চিন্তাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র ও কৌশল। পরিপূর্ণ মানুষ তার সমস্যা সমাধানে নিজের চিন্তাকে প্রাধান্য দেবেন। 

মানুষের জীবন এক অদ্ভুত যাত্রা। এর মূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষ্য কী? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ নয়। একেক জনের কাছে উত্তর একেক রকম হবে। বয়স, পারিপার্শ্বিকতা ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে এর ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। আমরা চেষ্টা করতে পারি একটা সিদ্ধান্তে আসার। জীবন যেহেতু এসেছে সেহেতু মরণ অনিবার্য। তবে মরে যাওয়াই কি আসল গন্তব্য? এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক) মরে যাওয়াই মূল লক্ষ্য, অথবা দুই) মৃত্যু চিন্তা বাদ দিয়ে জীবনকে উপভোগ করা। যদি মরে যাওয়াই সব হয় তবে জীবনটাকে এমনভাবে তৈরি করে নিতে হবে যেন মৃত্যুটাকে উপভোগ করা যায়। যদি মরে যাওয়াই শেষ কথা না হয় তবে কিসে মানুষের জীবনের সফলতা? এরকম হতে পারে যে, জীবনের মূল লক্ষ্য সুখে থাকা। অন্যভাবে বললে সফল হওয়া। দুটো গন্তব্যের ক্ষেত্রেই মানুষের জীবন অনেক অর্থ বহন করে। আর জীবনকে অর্থবহ করতে হলে সফল হতে হবে। তবে চূড়ান্ত সাফল্য মানেও কিন্তু পরিপূর্ণতা নয়। একজনের দামি বাড়ি, গাড়ি দেখে তাকে সফল মনে হলেও তিনি হয়তো কোনো একটি দিক থেকে পরিপূর্ণ নন। আর সফলতাসহ জীবনের স্বাদ পেতে হলে পরিপূর্ণ হতেই হবে। এভাবেও বলা যায় সফলতা বিষয়টি অনেকাংশেই দৃশ্যমান কিছু; পক্ষান্তরে পরিপূর্ণতা অনেকক্ষেত্রেই অদৃশ্য আত্মিক বিষয়। একজন পরিপূর্ণ মানুষ আয়নায় নিজের সামনে দাঁড়াতে কখনোই ভীত নন; বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। দিন শেষে আয়নায় নিজের সামনে দাঁড়ানোই জীবনের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক।

এরকম প্রসঙ্গও আসতে পারে যে বিশেষ কারও উপস্থিতি কি মানুষকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে? খুব সহজভাবে বললে, অবশ্যই করে। মানুষ তার পছন্দের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রিয়জনের উপস্থিতি তাকে আনন্দ দেয়। মানুষের চিন্তা, আদর্শ ও পছন্দের পার্থক্যের কারণে মানুষে-মানুষে পার্থক্য হয়। পার্থক্য হয় পারস্পরিক সম্পর্কে, নিজেকে জানতে পারার অনুভবে। কেউ জানতে চাইতে পারেন কে বা কারা পরিপূর্ণ মানুষ। এ উদাহরণ দেওয়া সহজ নয়। এরকম হতে পারে আপনি যাকে অর্থহীন বা ব্যর্থ মনে করছেন তিনিই জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছেন। আপনি যার রিকশায় চড়ে যাচ্ছেন, সে ব্যক্তিটি হয়তো জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছেন। পরিপূর্ণতা অর্জনই জীবনের সত্যিকার সার্থকতা।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়