ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ম্যান অব অল সিজনস

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৪ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ম্যান অব অল সিজনস

ভারতের বিদায়ী ও ১৩তম রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বৃষ্টিদিনে কাগজে মুড়িয়ে বই বগলদাবা করে খালি পায়ে স্কুলে ছুটে যাওয়া গ্রামের সেই দামাল ছেলে পল্টু ভারতের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অবসর নিচ্ছেন।

ছোটবেলার সেই আদরের পল্টু, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটের গণমানুষের পল্টুদা প্রণব মুখার্জি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২৫ জুলাই মেয়াদ শেষ করছেন।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদ রাষ্ট্রপতি। মাত্র ১৩ জন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রয়েছে ভারতের, যার মধ্যে প্রণব মুখার্জি একজন। গ্রামের আর ১০টা ছেলের মতো বেড়ে ওঠা প্রণব মুখার্জি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে দেশের প্রথম নাগরিকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। শুধু ভারতেই নয়, তিনি বিশ্বের সফল মানুষদের একজন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন এই নেতা দলের সুখে-দুঃখে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। যখনই কোথাও সংকট তৈরি হয়েছে, সেখানে তাকে কাজে লাগিয়েছে কংগ্রেস। বড় বিপদেও তিনি অটল থেকেছেন। কংগ্রেসে তার কাজের মূল্যায়নও করেছে। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন দেয় সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বধানী কংগ্রেস। পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতি পদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

রোববার ভারতের পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হয় প্রবণ মুখার্জিকে। এদিন পার্লামেন্টে শেষবারের মতো ভাষণ দেন তিনি। পার্লামেন্টের সঙ্গে ৩৭ বছরের সম্পর্ক তার। রাজ্যসভা ও লোকসভার সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে প্রায় চার দশক কাটিয়েছেন প্রণব মুখার্জি। তিনি বলেন, আমি এই পার্লামেন্টেরই সৃষ্টি। 

পার্লামেন্টে বিদায় ভাষণে স্মৃতির পাতা খুলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেও সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান দিক নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রণব মুখার্জি। অধ্যাদেশের অতিরিক্ত ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন তিনি।

মুখার্জি বলেন, একই পতাকা, একই শাসন ব্যবস্থা ও একই সংবিধানের অধীনে ১২২টি ভাষাভাষির ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারত। বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যকে ভারতীয় গণতন্ত্রের মহান শক্তি হিসেবে অভিহিত করেন তা রক্ষার তাগিদ জানিয়ে পার্লামেন্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘পার্লামেন্টে আমার সময়ে আমি শিখেছি, এটি আলোচনা, বিতর্ক ও ভিন্নমতের স্থান। আমার মতে, বিশৃঙ্খলা বিরোধীদেরই বেশি ক্ষতি করে।’

প্রণব মুখার্জির বিদায় সংবর্ধনা উপলক্ষে পার্লামেন্টে ভাষণ দেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্র মহাজন। বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ওপর আলোকপাত করে দেশের প্রতি তার অবদানের কথা তুলে ধরেন তিনি।

প্রণব মুখার্জি তার রাজনৈতিক গুরু ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ব্যক্তিত্ব গঠনে তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তিনি। ভাষণে তিনি আরো বলেন, ‘পার্লামেন্টের আমার বছরগুলোতে পি ভি নরসিমা রাওয়ের প্রজ্ঞা, অটল বিহারি বাজপেয়ীর ভাষণ, মনমোহন সিংহের স্থিতি, এল কে আদভানির পরামর্শ ও সোনিয়া গান্ধীর সমর্থন আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরামর্শ ও সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, প্র্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও এইচ ডি দেব গৌড়া, কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ও সহসভাপতি রাহুল গান্ধী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা।

প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে কিছু তথ্য
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের (তৎকালীন বাংলা) বীরভূম জেলার মিরাটে কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কিংকর মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য (১৯৫২-১৯৬৪)। তার মায়ের নাম লক্ষ্মী।

বীরভূমের সুরি বিদ্যাসাগর কলেজ শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে এমএ এবং আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের উপ-মহাহিসাবরক্ষকের কার্যালয়ে উচ্চমান করোনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৬৩ সালে চব্বিশ পরগনায় বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তিনি দেশের ডাক পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করতেন।

১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন প্রণব মুখার্জি। ওই বছর মেদেনিপুরে এক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভি কে কৃষ্ণ মেননের উপনির্বাচনে সফল ক্যাম্পেইন চালানোর পর তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়েন। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিষ্ঠা, সততা ও পরিশ্রমের জোরে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সিঁড়ি রাষ্ট্রপতি ভবনের অধিপতি হয়েছেন।

শুরু থেকে শেষ : মুখার্জির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
১৯৬৯ : ভারতীয় পার্লামেন্টের ‍উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য

১৯৭৩-১৯৭৪ : কেন্দ্রীয় শিল্প উন্নয়নমন্ত্রী

১৯৭৪ : কেন্দ্রীয় নৌযোগাযোগ ও পরিবহনমন্ত্রী

১৯৭৪-১৯৭৫ : কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী

১৯৭৫-১৯৭৭ : কেন্দ্রীয় রাজস্ব ও ব্যাংকিং মন্ত্রী

১৯৭৮-১৯৭৯ : কংগ্রেস পার্টির কোষাধ্যক্ষ

১৯৭৮-১৯৭৯ : সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষ

১৯৮০-১৯৮৫ : রাজ্যসভার নেতা

১৯৮০-১৯৮২ : বাণিজ্য এবং স্টিল ও খনি মন্ত্রী

১৯৮২-১৯৮৪ : কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী

১৯৮২-১৯৮৫ : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের গভর্নর বোর্ডের সদস্য

১৯৮২-১৯৮৫ : বিশ্বব্যাংকের গভর্নর বোর্ডের সদস্য

১৯৮২-১৯৮৪ : এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের গভর্নর বোর্ডের সদস্য

১৯৮২-১৯৮৫ : আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের গভর্নর বোর্ডের সদস্য

১৯৮৪ : কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও সরবরাহমন্ত্রী

১৯৮৪, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮ : এ চার সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের চেয়ারম্যান

১৯৮৫ ও ২০০০-২০১০ : কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ইউনিটের প্রেসিডেন্ট

১৯৯১-১৯৯৬ : পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান

১৯৯৩-১৯৯৫ : কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী

১৯৯৫-১৯৯৬ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৯৯৫ : সার্ক মন্ত্রিপরিসদ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট

১৯৯৮-১৯৯৯ : সর্ব ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক

১৯৯৯-২০১২ : কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নির্বাচন সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান

২০০৪-২০১২ : লোকসভার নেতা

২০০৪-২০০৬ : প্রতিরক্ষামন্ত্রী

২০০৬-২০০৯ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

২০০৯-২০১২ : অর্থমন্ত্রী

২৫ জুলাই, ২০১২-২৫ জুলাই, ২০১৭ : রাষ্ট্রপতি

রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় এত বেশি অভিজ্ঞতার অধিকারী মানুষ ভারতের রাজনীতিতে খুবই কম। যে কারণে প্রণব মুখার্জিকে বলা হয়, ‘ম্যান অব অল সিজনস’। বিশ্বের সফল ব্যক্তিদের কাতারে তার নামটি সমুজ্জ্বল থাকবে- চিরদিন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুলাই ২০১৭/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ