স্কুল বুলিং থেকে নিরাপদ থাকুক প্রতিটি শিশু
অয়ন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম
অনুপ (ছদ্মনাম) আবৃত্তি ও নাচে খুবই পারদর্শী। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে ওরই কিছু সহপাঠী প্রায়শই ওর বই-খাতায় অনুপের জায়গায় ‘অনুপমা’ লিখে রাখে এবং ‘হাফ লেডিস’ বলে সম্বোধন করে।
তাসফিয়া (ছদ্মনাম) ক্লাসে ঢুকলেই ‘মোটা মোটা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে ওর ক্লাসরুম। প্রায়ই শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত দিয়ে দৌড় দেয় কিছু সহপাঠী; নিজেকে নিয়ে তাই হীনমন্যতায় ভোগে তাসফিয়া। পিয়াসকে (ছদ্মনাম) প্রায়ই ওর ধর্ম নিয়ে কটূক্তি শুনতে হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে আরও খারাপ কথা শুনতে হয় পিয়াসকে; কখনো কখনো আবার চড়থাপ্পড়ও খেতে হয় সহপাঠীদের হাতে। তাই পিয়াস স্কুলে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনুপ, তাসফিয়া বা পিয়াসের ঘটনাগুলো ভিন্ন তিনটি বিদ্যালয়ে সংগঠিত এবং আপাত দৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন। তবে এই ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। এরা প্রত্যেকেই ‘স্কুল বুলিং’-এর শিকার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে বা বাইরে যখন একজন শিক্ষার্থী আরেকজন শিক্ষার্থীর দ্বারা শারীরিক বা মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়, তখন সেই ঘটনাকে স্কুল বুলিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্কুল বুলিং একজন শিক্ষার্থীর জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। স্কুল বুলিংয়ের প্রতিক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথও অবলম্বন করতে পারে এই জঘন্যতম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়।
২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত বুলিং প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেন। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই উচ্চ আদালতে নীতিমালাটি দাখিল করা হয়।
সরকারি নীতিমালায় স্কুল বুলিংয়ের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যালয় চলাকালীন সময় বা শুরু হওয়ার আগে বা পরে, শ্রেণিকক্ষে বা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা বাইরে কোনো শিক্ষার্থী কর্তৃক (এককভাবে বা দলগতভাবে) অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনো বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করাকে স্কুল বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।’
নীতিমালায় স্কুল বুলিংকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে- শারীরিক বুলিং, সামাজিক বুলিং ও মৌখিক বা মানসিক বুলিং। কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত, চড়-থাপ্পড় দেওয়া, লাত্থি ও ধাক্কা মারা, থুথু নিক্ষেপ, জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ শারীরিক বুলিংয়ের পর্যায়ে পড়বে। উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন ও অশালীন শব্দ ব্যবহার ও হুমকি মৌখিক বা মানসিক বুলিং হিসেবে চিহ্নিত হবে। সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় পরিচিতি বা বংশগত অহংবোধ থেকে কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন, কারো সম্পর্কে গুজব ছড়ানো এবং প্রকাশ্যে অপমান করা হলে তা সামাজিক বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।
পারিবারিক শিক্ষার ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে স্কুল বুলিং বাড়ছে বলে মত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফয়সাল আহমেদ রাফির। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রধানত শান্তশিষ্ট স্বভাবের ও শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা উত্ত্যক্ত ও নিগ্রহের শিকার হয়। শুধু শিক্ষাজীবনই না, ভবিষ্যৎ জীবনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে স্কুল বুলিংয়ের প্রতিক্রিয়ায়। আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ায় উদ্ভুত হীনমন্যতা থেকে নানা ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে একজন ভুক্তভোগী। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদে ভোগা এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা কাজ করার অন্যতম বড় কারণ স্কুল বুলিং।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা জোরদার করার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। ভুক্তভোগীরা যেন চুপ না থেকে নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারে এবং প্রতিকার পায়-সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও আবশ্যক বলে মত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফয়সাল আহমেদের।
স্কুল বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের বড় অংশ এই বিষয়ে চুপ থাকে বলে এর সঠিক পরিসংখ্যান বের হওয়া সম্ভব নয় বলে মত ‘ইউনিসেফ’ বরিশাল প্রধান তৌফিক আহমেদের।
তাঁর মতে, বুলিংয়ের শিকার প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ জানালে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বুলিং প্রতিরোধে সচেতন হলে এই অনাচার বিলোপ করা সম্ভব। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্রুপিং এবং বুলিং ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে বলে মনে করেন তৌফিক আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘কিশোরদের নৈতিক মূল্যবোধ ও স্কুল বুলিং বিষয়ে সচেতন করার জন্য সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
স্কুল বুলিং শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় বলে মনে করেন বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাহবুবা হোসেন।
তাঁর মতে, শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা এবং লেখাপড়ার ক্রমবর্ধমান চাপ স্কুল বুলিংয়ের প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, ‘স্কুল বুলিং প্রতিরোধের জন্য সহকারী প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে অভিযোগ কমিটি রয়েছে। স্কুলে অভিযোগ বক্স রয়েছে। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও বৃহস্পতিবার ক্লাস শুরুর সময় নীতিনৈতিকতা বিষয়ে আলোচনা করেন শ্রেণিশিক্ষকবৃন্দ। স্কুল বুলিং সম্পর্কিত লিখিত কোনো নির্দেশনা না পেলেও আমরা নিজস্ব উদ্যোগে স্কুল-বুলিং প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছি।’
স্কুল বুলিংয়ে আক্রান্ত ও আক্রমণকারী শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করা হয় এবং আক্রমণকারী শিক্ষার্থীকে সতর্ক করে তার ও তার অভিভাবকের লিখিত অঙ্গীকারনামা রাখা হয় বলে জানান প্রধান শিক্ষিকা মাহবুবা হোসেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়।
বরিশাল/মাহি