ঢাকা     বুধবার   ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘আমাগো চুল-দাড়ি রাখার স্বাধীনতা লাগবো’ 

আরিফ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৪:২০, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
‘আমাগো চুল-দাড়ি রাখার স্বাধীনতা লাগবো’ 

আপনার ফেসবুক বা ইউটিউবের স্ক্রল থামিয়ে দেওয়া একটি ভিডিও। একদল যুবক, পরনে লোগো-আঁকা টি-শার্ট। তাদের ঘিরে ক্যামেরা, মোবাইল। মাঝখানে অসহায়, বিবস্ত্র এক মানুষ—হয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন, হয়তো কোনো সাধু, কিংবা জীবনের ভারে ন্যুব্জ কোনো ভবঘুরে।

যুবকদের হাতে কাঁচি আর ক্ষুর কিংবা ইলেক্ট্রিক চুল কাটার মেশিন। তারা পরম উৎসাহে সেই মানুষটির জটা, দীর্ঘ চুল কেটে ন্যাড়া করে ফেলছে। এরপর গায়ে সাবান ডলে গোসল করিয়ে একটি টি-শার্ট পরিয়ে দিচ্ছে। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক প্যাকেট খাবার। ক্যামেরা জুম ইন করে সেই ‘পরিচ্ছন্ন’ মুখের ছবি তুলছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে করুণ সুর। ভিডিওর ক্যাপশন: ‘আসুন মানবিক হই’। 

লাখ লাখ ভিউ, হাজার হাজার শেয়ার, প্রশংসার বন্যা। এই দৃশ্যটি এখন আমাদের ডিজিটাল জগতের এক পরিচিত অধ্যায়। কিন্তু পর্দার পেছনের গল্পটা কী? এটি কি সত্যিই সমাজসেবা, নাকি ভিউ বাণিজ্যের এক নির্দয়, অমানবিক রূপ? এই ‘পরিচ্ছন্নতা অভিযান’-এর নামে যা চলছে, তা কি মানবতা নাকি ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর এক নৃশংস আক্রমণ?

যারা এই কাজ করছেন, তাদের উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ—অন্তত তারা তাই দাবি করেন। তারা বলেন, পথের এই মানুষগুলোকে পরিচ্ছন্ন করে সমাজে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শরীরে হাত দেওয়া, জোর করে তার চুল বা দাঁড়ি কেটে ফেলা—এসব কি সেবা হতে পারে?

ভিডিওগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, অসহায় মানুষটি কাঁদছেন, অনুনয় করছেন, কিংবা ভয়ে চুপ করে থাকছেন। তার চোখে থাকে অপমান আর লজ্জা। তার দীর্ঘদিনের জটা, যা হয়তো তার আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ, তা কেটে ফেলার সময় তার আর্তনাদ কি ক্যামেরার পেছনের মানুষগুলোর কানে পৌঁছায় না?

সামাজিক মাধ্যমে একজন যথার্থই লিখেছেন, ‘এটা অত্যাচার ছাড়া কিছু নয়। এরা এত ভালো কাজ করতে চাইলে রাস্তার আবর্জনা পরিষ্কার করে না কেন? বস্তির মানুষের বাড়িঘর পরিষ্কার করতে যায় না কেন?’ প্রশ্নটি যৌক্তিক। কারণ আবর্জনা পরিষ্কার করলে বা বস্তিতে কাজ করলে হয়তো এত সহজে ভাইরাল হওয়া যায় না। 

একজন অসহায়, প্রতিরোধে অক্ষম মানুষকে নিয়ে নাটকীয় কনটেন্ট তৈরি করা অনেক সহজ। এখানে মানুষটি সেবাগ্রহীতা নন, তিনি হয়ে ওঠেন কনটেন্ট তৈরির একটি ‘উপকরণ’ মাত্র। দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘On Liberty’ গ্রন্থে ‘Harm Principle’-এর কথা বলেছেন। একজন মানুষের স্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ, যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়। পথের কোনো মানুষের জটাধারী চুল বা ময়লা পোশাক আপনার বা আমার কোনো ক্ষতি করছে না। সুতরাং, তার ব্যক্তিগত পছন্দে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সমাজ বা কোনো গোষ্ঠীর নেই। এই ‘পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ মিলের এই নীতির সরাসরি লঙ্ঘন।

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট শিখিয়েছেন, কোনো মানুষকে কখনো ‘উপায়’ বা means হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ প্রত্যেক মানুষই নিজে একটি ‘উদ্দেশ্য’। কিন্তু এই ভিডিওগুলোতে অসহায় মানুষগুলোকে ভিউ, লাইক আর সাবস্ক্রিপশন বাড়ানোর ‘উপায়’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল পণ্য। এটি কান্টের নৈতিক দর্শনের পরিপন্থী।

এই কাজটি এক ধরনের ‘প্যাটার্নালিজম’ বা ‘অভিভাবকত্ববাদী’ মানসিকতার প্রকাশ। যেখানে একদল লোক মনে করছে, ‘আমরা জানি তোমার জন্য কোনটা ভালো’। তারা ধরেই নিচ্ছে, ওই ভাসমান মানুষটি নিজের ভালো-মন্দ বোঝে না এবং তাদের ওপর যে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু একজন মানুষের মানসিক অবস্থা যাই হোক না কেন, তার মানবিক মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিককে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। জোরপূর্বক কারও চুল কেটে দেওয়া, তাকে জনসমক্ষে বিবস্ত্র করে গোসল করানো—এই কাজগুলো তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সম্মানের ওপর চরম আঘাত। এটি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর। জাতিসংঘের ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ (UDHR) এবং ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি’ (ICCPR) ব্যক্তির শারীরিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানানোর কথা বলে। বিশেষ করে, মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে তৈরি ‘CRPD’ সনদে বলা হয়েছে, তাদের সম্মতির ভিত্তিতেই যে কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ এই সকল আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ফলে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু অমানবিকই নয়, বরং বেআইনিও।

দুঃখজনকভাবে, এই ডিজিটাল ভিজিল্যান্টিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে, এই ‘নতুন কালচার’ এক সামাজিক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সুফি, বাউল, সাধু, সন্ন্যাসীদের দেশ। জটা রাখা, বিশেষ পোশাক পরা—এগুলো অনেকের কাছে আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ। পথের এই মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই হয়তো সেই ধারার অনুসারী। তাদের জটাকে ‘অপরিচ্ছন্নতা’ বলে কেটে ফেলা কেবল তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপরই নয়, বরং তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর একটি নির্লজ্জ আক্রমণ। 

জটাধারী নজরুলকেও হয়তো এরা ‘অপরিচ্ছন্ন’ বলে চুল কেটে দিত! সামাজিক মাধ্যমের এক মন্তব্যকারী যেমন বলেছেন, ‘এরা তো কাজী নজরুলকে পেলেও অপদস্থ করত।’ ইসলামের দৃষ্টিতেও এই কাজটি গর্হিত। ইসলামে ‘মাজনুন’ বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির ওপর শরিয়তের বিধান কার্যকর হয় না। বরং সমাজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের প্রতি সদয় হতে। 

সুফি দর্শনে ‘মজ্জুব’ বা আল্লাহর প্রেমে পাগল ব্যক্তিকে উচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরের অধিকারী মনে করা হয়। জোর করে তাদের ‘স্বাভাবিক’ বানানোর এই প্রবণতা এক ধরনের উগ্র সালাফি চিন্তার প্রতিফলন, যা ইসলামের মূল উদারনৈতিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘Discipline and Punish’ গ্রন্থে ‘প্যানঅপটিকন’ নামক এক কারাগারের মডেলের কথা বলেছেন, যেখানে কয়েদিরা সবসময় নজরদারির অধীনে থাকে এবং ধীরে ধীরে নজরদারির এই ধারণাকে আত্মস্থ করে নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। আজকের সোশ্যাল মিডিয়া যেন এক ডিজিটাল প্যানঅপটিকন। এই ভিডিও নির্মাতারা সমাজের ‘স্বাভাবিকতা’র এক মানদণ্ড তৈরি করছে। যারা এই মানদণ্ডের বাইরে—অর্থাৎ ভবঘুরে, জটাধারী বা মানসিক ভারসাম্যহীন তাদের ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তারপর ক্যামেরার সামনে তাদের জোর করে ‘স্বাভাবিক’ বানানো হচ্ছে, যা দেখে দর্শক (আমরা) সেই মানদণ্ডকে সমর্থন করছি। এখানে অসহায় মানুষটি শুধু ভিকটিম নয়, সে একটি প্রদর্শনী বস্তু। তার অপমানকে পণ্য করে আমরা বিনোদন কিনছি। এই নজরদারি এবং সামাজিক পুলিশি ব্যবস্থা আমাদের সমাজকে আরও অসহিষ্ণু করে তুলছে। 

সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওর শেষে দেখা যায়- এক বৃদ্ধ, যার চুল জোর করে কেটে দেওয়া হয়েছে, অসহায়ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে বলছেন, ‘‘আল্লাহ তুই দেখিস...’’। এই একটি বাক্যই এই পুরো অমানবিকতার সারমর্ম। মজলুমের এই আর্তনাদ আমাদের সভ্যতার গালে এক বিরাট চপেটাঘাত। এই ভিউ ব্যবসায়ীদের তৈরি করা ‘মানবিক’ গল্পের আড়ালে লুকিয়ে আছে শোষণ, নিপীড়ন আর চূড়ান্ত অপমান। তাদের দেওয়া একটি টি-শার্ট বা একবেলার খাবার কখনোই কেড়ে নেওয়া আত্মসম্মানের মূল্য হতে পারে না।

প্রশ্ন হলো, দর্শক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কী? আমাদের দায়িত্ব হলো এ ধরনের কনটেন্ট প্রত্যাখ্যান করা। লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করে এই অমানবিক বাণিজ্যকে সমর্থন না করা। সম্ভব হলে, এই ভিডিওগুলোকে রিপোর্ট করা এবং এদের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সোচ্চার হওয়া। যদি সত্যিই সমাজসেবা করতে হয়, তাহলে ক্যামেরা বন্ধ করে কাজ করুন। এই মানুষগুলোর জন্য স্থায়ী আশ্রয়, চিকিৎসা এবং খাবারের ব্যবস্থা করুন। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করুন। তাদের আত্মসম্মানকে সম্মান জানিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। তা না করে, ক্যামেরার সামনে অসহায় মানুষের চুল কেটে যে ‘হিউম্যান সার্ভিস’ দেখানো হচ্ছে, তা আদতে ‘অ্যানিমেল ইনস্টটিংট’ বা পাশবিক প্রবৃত্তিরই নামান্তর। 

আসুন, এই ডিজিটাল কসাইখানা বন্ধ করি। নইলে সেই বৃদ্ধের আর্তনাদের দায় আমাদের প্রত্যেককে নিতে হবে। কারণ, আল্লাহ নিশ্চয়ই দেখছেন।
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়