ঢাকা     বুধবার   ০৮ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

ছোটগল্প || হৃদয় ঘরে হৃদয় পোড়ে

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৭, ২৬ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || হৃদয় ঘরে হৃদয় পোড়ে

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

সাইফ বরকতুল্লাহ : ‘তুমি এসব কী করছ?’

‘কি করছি মানে?’

‘না, তুমি মোবাইল দেখবা না। প্লিজ বন্ধ করো মোবাইল। বলছি...প্লিজ...।’

‘না, দেখা বন্ধ করব না।’

রাগে-ক্ষোভে হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিতেই বাঁ গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল কিরন।

 

বৈশাখের তপ্ত দুপুর। প্রচণ্ড রোদ আর সূর্যের তাপ। শহরের মানুষগুলোও গরমে অতীষ্ট। হাঁফিয়ে উঠেছে শহর। এই অসহ্য আবহাওয়ায় ওরা বের হয়েছিল ভালোবাসার পরশে কিছু সময় কাটাতে। সঙ্গে কিছু কেনাকাটা করা আর দুজন দুজনকে আরো কাছে থাকার কিছুটা সময় কাটানো।

 

সকাল দশটা। কিরন চলে এল রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে। এর খানিকটা পরে মারিয়াও চলে এল। দুজন দুজনের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে মার্কেটে গেল। কিছু কাপড়চোপড়ও কিনল। মারিয়া কিরনের জন্য একটা জিন্সের প্যান্ট কিনল। কিরনও মারিয়ার জন্য হলুদ-আকাশি রঙের কামিজ কিনল। ঘুরতে ঘুরতে বেলা তখন প্রায় দুপুর। কাঠপোড়া রোদের কারণে ওদের গলা পানির জন্য ছটফট করছে। মারিয়া বলল- চলো কোল্ড ড্রিংকস খাই। কোনো ফাস্টফুডের দোকানে না বসে দুজনে দুইটা পেপসির বোতল কিনে চলে এল বিমানবন্দরে। ট্রেনে কোথাও যাওয়ার জন্য নয়, আরো কিছুটা সময় কাটানোর জন্য তারা এখানে চলে আসে। কিন্তু হঠাৎ মোবাইলটা নিয়ে তাদের কথা-কাটাকাটি মারিয়ার হৃদয়কে ভেঙে দিল। থাপ্পড় খেয়ে দুচোখে পানি থামাতে পারল না।

 

প্ল্যাটফর্মে বসা অপেক্ষমাণ যাত্রীরা কিরনের আচরণটা ভালোভাবে যে নেয়নি, তা বোঝা গেল। যাত্রীরা তাদের দেখে কেউ কেউ বলছেন- ‘প্রেমিক-প্রেমিকা মনে হয়।’ কেউ আবার বলছে, ‘প্রেম করলে এমন হতে পারে।’

 

নাজনের নানা কথা। প্ল্যাটফর্মের উল্টাদিকে দায়িত্বরত পুলিশের একজন কর্মকর্তা কাছে এল। ওই পুলিশ সদস্যের বয়স পঞ্চাশ প্লাস হবে। মুখে দাড়ি আছে। অর্ধেক পেকে গেছে। কাছে এসেই পুলিশ জানতে চাইল, ‘আপনারা কোথায় যাবেন?’

‘কী করেন?’

‘কোনো সমস্যা?’

ক্রন্দনরত মারিয়া পুলিশের কথা শুনেই হো হো করে হেসে দিল। কিরন বলল- ‘না, কিছু হয়নি।’পুলিশ কিছুক্ষণ দেখে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করে চলে গেল।

 

দুপুরের পড়ন্ত রোদ। সঙ্গে গরম তো আছেই। এরই মধ্যে ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেন এসে থামল। বিমানবন্দরে ঢাকা যাওয়ার অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ট্রেনে উঠে গেল। কিরন আর মারিয়া ট্রেনে না উঠে চলে গেল ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে অগ্রিম টিকিট কাউন্টারে। মারিয়ার চোখে জল টপটপ করছে। মনের ভেতর প্রচণ্ড রাগ। চার বছরের প্রেম। এখনো বিয়ের কথা ভাবেনি। কিন্তু দুজনের জীবনে কখনো এমন মুহূর্ত আসেনি। কী কারণে কিরন এমন করল। নানা প্রশ্ন মারিয়ার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিরনের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি থামছেই না। হঠাৎ কিরন বলল- ‘তুমি কি কথা বলা বন্ধ করবা?’

মারিয়া বলল, ‘বন্ধ না করলে কি করবা?’

‘ওকে ভালো থেকো। আজই শেষ দেখা। শেষ কথা...। আর কোনো দিন কথা হবে না।’ কথাগুলো বলেই চলে গেল কিরন। বৈশাখের চড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল অনেকটা পথ। ঘাড়, পিঠ, শরীরের বিভিন্ন অংশ গরমে ভিজে একাকার। মারিয়াও চলে গেল। এতটা সময় দুজন দুজনার হলেও এখন যাচ্ছে তারা দুটি পথে।

 

রাত দুইটা দশ। চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। কিরন এ আলোয় বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। মারিয়া গেছে যে আর কোনো যোগাযোগ করেনি। কিরনও ফোন দেয়নি।

কোথায় আছে মারিয়া?

কী করছে সে এখন?

রাতে কী খেয়েছে ও?

আমার কথা কী সে ভাবছে এখন?

এসব ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে গেল। সকাল দশটায় ক্যাম্পাসে যেতে হবে। এদিকে চোখেও ঘুম এসে পড়েছে। লাইটটা অফ করে ঘুমিয়ে পড়ল কিরন।

 

ঘড়ির অ্যালার্ম বাজছে। ঘুম থেকে যখন উঠল তখন ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে। কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে দৌড় দিল ক্যাম্পাসের উদ্দেশে।

সকালের ক্যাম্পাসটা আজ সজীব। আকাশে হালকা রোদের সাদা মেঘ জমেছে। আজ ম্যাথ স্যার আসেনি। তাই ম্যাথ স্যারের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটা হচ্ছে না। ক্লাসের সবাই ক্যাম্পাসের জামতলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। মারিয়া, পারমিতা, ইশিকা, টিউলিপ, জাবেদ, নাদিম বসে জম্পেশ জামিয়েছে আড্ডা। এরই মাঝে চলে এল কিরন। এসেই পারমিতাকে বলল, ‘কী রে, ক্লাসে যাসনি তোরা?

পারমিতা বলল, ‘না, ম্যাথ স্যার আসেনি। আজ ক্লাস হচ্ছে না।’

‘তাহলে তো ভালোই হলো।’

 

আড্ডা দিতে দিতে বিকেল হয়ে যায়। ওরা আজ আর কোনো ক্লাস করল না। মারিয়া প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ওদের সবাইকে ‘তোরা থাক, আমি ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে আসি’ বলে সে গেল ক্যান্টিনে। মারিয়া, কিরনও কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিনে চলে আসে। মারিয়া যে টেবিলে বসে শিঙাড়া আর চা খাচ্ছিল, কিরনও সেই টেবিলে বসে করিম মামাকে সমুচা আর পেঁয়াজুর অর্ডার দিল।

 

মারিয়া কিরনের কাণ্ড দেখে দাঁত কিড়বিড় করছে। গতকালের ঘটনাটা মারিয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। আবার খারাপও লাগছে। চার বছরের সম্পর্ক কি এখানে ইতি টানবে, নাকি কনটিনিউ করবে। দুচোখে ঝাপসা দেখছে।

 

কিরন মারিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মারিয়া চা খাচ্ছে। কিরন বলল, ‘গত চার বছর তোমার সঙ্গে কখনো রাগ করিনি। আমার হৃদয়ে রাগ নেই। কিন্তু গতকালের ঘটনা আমার হৃদয় জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনে আমার জ্বলছে মন। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর মারিয়া।’

 

কিন্তু মারিয়া এসব কিচ্ছু শুনছে না। যেন কোনো সম্পর্ক নেই তাদের। এমন ভাব। মারিয়া বলল, ‘মাঝে মাঝেই তো তোমাকে কত কিছু বলতাম। কিন্তু তুমি তো কখনো রাগ করো না। কেন কালকে এমন করলা। তুমি কি জানো- শুধু রাগের কারণে আমি দুজনকে ব্রেকআপ করে তোমাকে পেতে চেয়েছি। তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক কনটিনিউ করতে চাই না (কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে)’ বলতেই হাত থেকে চায়ের কাপটা নিচে পড়ে ভেঙে গল। করিম মামাকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে চলে গেল মারিয়া।

 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাইরের রাস্তায় লোকজন ছুটে চলেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। বিষণ্ন হৃদয়ে কিরন ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে রমিজ চাচার চায়ের দোকানে এসে বাঁশের বেঞ্চে বসে সিগারেট টানতে লাগল।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়