ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

শতবর্ষে টিএস এলিয়টের

‘দ্য হলো মেন’: অগণন বিস্তৃতির  বিপন্ন বিস্ময়

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৯:৫৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
‘দ্য হলো মেন’: অগণন বিস্তৃতির  বিপন্ন বিস্ময়

২০২৫ সাল বিশ্বসাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের শতবর্ষ। এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের  The Great Gatsby, ভার্জিনিয়া উলফের Mrs. Dalloway, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের In Our Time, সিনক্লেয়ার লুইসের Arrowsmith, টমাস মানের The Magic Mountain, ফ্রানজ কাফকার The Trial, ডব্লিউ সমারসেট মমের The Painted Veil, এজরা পাউন্ডের Cantos-এর সাথে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় টিএস এলিয়টের The Hollow Men-এর কথা। 

আজ থেকে শতবর্ষ আগে তিনি তাঁর চারপাশে যেসব ‘শূন্যগর্ভ মানুষদের’ বিচরণ দেখেছিলেন; কী আশ্চর্য! শতবর্ষ পরেও তারা একইভাবে আমাদের চারপাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের সংখ্যা ও অন্তঃসারশূন্যতা আরো বেড়েছে বৈকি। গত একশ  বছরে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিস্তর উন্নতি ঘটলেও মানুষের চৈতন্যে তার ইতিবাচক প্রভাব আশা-জাগানিয়া নয়। একটি বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্মের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। একটি যুদ্ধোত্তর বিশ্বের মানুষের নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্বের সংকট, নৈতিক স্খলন, হতাশা, উদ্দেশ্যহীনতা, সংশয় ইত্যাদির যে ছবি তিনি এঁকেছিলেন, শতবর্ষ পরে আজকের উত্তরাধুনিক ডিজিটাল যুগেও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, উদ্দেশ্যহীনতা ও চরমপন্থার ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে যার কারণে মানুষের পতন অনিবার্য।

‘শূন্যগর্ভ’ মানুষের এই পতন রুখে দেওয়ার মতো কোনো বিকল্পের সন্ধান মিলছে না। তাদের সবকিছু নিঃশব্দে, কাতর গোঙানির মধ্য দিয়ে শেষ হবে। তবে জেনে রাখা ভালো যে এলিয়ট নিজে উদারবাদী বা বিজ্ঞানমনস্ক কোনোটাই ছিলেন না। মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাশূন্যতা তার সংকটের মূল কারণ বলে তিনি বিশ্বিাস করতেন এবং ‘আধ্যাত্মিক' বলতে তিনি কেবল খ্রিস্টীয় ধর্মবোধকে বুঝতেন। এই সংকট থেকে বাঁচতে হলে একটি খ্রিস্টীয় সমাজের পুনঃনির্মাণের ওপর তিনি তাঁর আস্থা ব্যক্ত করেন। 

সমালোচক আইএ রিচার্ডসের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল মূলত বিজ্ঞানকে ঘিরে। রিচার্ডস চাইতেন কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞানের মিতালী আর এলিয়ট চাইলেন ধর্মের সঙ্গে কাব্যের সম্মিলন। প্রতিক্রিয়াশীলতার এই রূপটি তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা হিসেবে সমালোচিত হলেও তৎকালীন যে সমাজচিত্র তিনি এঁকেছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। Broken Column বা Dead land-এর মতো প্রতীকগুলো শুধু যুদ্ধোত্তর ইয়োরোপ নয়, বরং যে কোনো ভেঙে পড়া সভ্যতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা সমকালীন সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। পৃথিবী ধ্বংসের যে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন আজ আমরা দেখতে পাই তা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। 

‘এভাবেই পৃথিবী ধ্বংস হবে/কোনো বিস্ফোরণ নয়, কাতর গোঙানির মধ্য দিয়ে’, তিনি বলেছিলেন। পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কামনা করলেও এলিয়টের মতে, মানুষ আধ্যাত্মিক চেতনাশূন্য এবং বিভ্রান্ত হয়ে জীবনের অর্থ খুঁজতে মরিয়া। কবিতাটিতে তিনি সক্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তোলেন, যার ফলে সমাজে কেবল ‘প্রতিশ্রুতিবাদী’ জনপ্রিয় নেতাদের উত্থান ঘটে, যারা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। The Hollow Men প্রকৃতপক্ষে মানুষের অস্তিত্বের চিরন্তন সংকট ও অন্তঃসারশূন্যতার এক শক্তিশালী চিত্র যা একুশ শতকেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

এলিয়টের অনেক কবিতার মতো এখানেও পর্যায়ক্রমে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় সত্তার বিচূর্ণন ঘটে। কবিতাটি সমাজের নানা রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করে, অভিযোগ উত্থাপন করে এবং অপরাধীর দিকে আঙুল তোলে। একইসঙ্গে তা ব্যাপক অর্থে ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক। বুদ্ধিবৃত্তিকতার আড়ালে এলিয়ট ধর্মের দিকে ঝুঁকেছেন এবং তাঁর যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। ১৯২২ সালে রচিত The Waste Land এর ধারাবাহিকতায় ১৯২৫ সালে লিখলেন The Hollow Men, এরপর পারিবারিক হতাশা থেকে বের হতে ১৯২৭ সালে ক্যাথোলিক ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন, যা তাঁর আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। এভাবেই তিনি ধর্মে বিশ্বাসী এক মানুষ হয়ে উঠলেন। আজ ২১ শতকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ উত্থানকালে তাঁর জীবনের এই ঘটনা প্রবাহের দিকে মনোযোগ দিতেই হয়; কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজেও একসময় অস্বস্তি ও সংকুচিত বোধ করতে থাকেন। 

এই কবিতায় আমরা ২টা ‘এপিগ্রাফ' দেখতে পাই। ‘মিস্তাহ কুর্টজ―সে মারা গেছে’ ও ‘বুড়ো লোকটার জন্য ১টি পয়সা খয়রাত দিন’। প্রথমটি জোসেফ কনরাডের Heart of Darkness এর ইঙ্গিত আর দ্বিতীয়টি ইংল্যান্ডে ৫ নভেম্বর গাই ফকস্ দিবসে শিশুদের পয়সা তোলার আবেদনকে মনে করিয়ে দেয়। অসাধারণ প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষমতার অধিকারী কুর্টজ কঙ্গোর জঙ্গলে ভিন্ন আবহে সমস্ত নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ভয়ঙ্কর কর্তৃত্বপরায়ণ ও হিংস্র হয়ে ওঠেন। গাই ফকস্ ১৬০৫ সালে বোমা মেরে সংসদ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই দিনটিতে শিশুরা ফকসের একটি কুশপুত্তলিকা বহন করে, আর সেটি পোড়াতে আতশবাজি ক্রয়ের জন্য মানুষের কাছে পয়সা চায়। 

এলিয়টের কবিতার শিরোনাম শেক্সপিয়রের Julius Caesar নাটকের ব্রুটাস উচ্চারিত ‘Hollow Men’ শব্দ দুটির প্রতি ইঙ্গিত করে। শব্দ দুটি তিনি উচ্চারণ করেন যখন তাঁর সন্দেহ হয় সিজার-হত্যা ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ক্যাসিয়াস নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে না। প্রতিশ্রুতি ও কর্মস্পৃহাহীন মানুষেরা এমনই হয়; কাজের সময় পুরোপুরি ব্যর্থ। এলিয়ট মনে করেন, যারা কর্মে বিশ্বাসী তারা ভালো বা মন্দ যে কাজই হোক না কেন, তা করেই ছাড়ে। যদি হতাশা বা অনিশ্চয়তা তাদের গ্রাস করে তাও তারা পিছিয়ে আসে না। 

ব্রুটাস সিজারের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন তা রোমের মঙ্গলের জন্য জরুরি। আধুনিক মানুষেরা ভয়, আড়ষ্টতা, সিদ্ধান্তহীনতা, বিশ্বাসহীনতার কারণে পঙ্গু ও গতিহীন। এলিয়ট মনে করতেন কিছু না করা থেকে খারাপ কিছু করা ভালো। তাই ব্রুটাস, কুর্টজ ও ফকস্-এর মতো হিংস্র আত্মারা তাঁর কাছে যতটা গুরুত্ব পায়, ততটা পায়না অনুর্বর শেয়াকুল জন্মানো জমিতে আটকে থাকা সাধারণ মানুষগুলো। ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের রাজনীতি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য যাই হোক না কেন তাদের মাথায় গোবর পুরা নয়, তাদের ফিসফিসানি অর্থহীন নয়, অদম্য স্পৃহা আর চোখে চোখ রেখে তারা মৃত্যুর অন্য রাজ্যে প্রবেশ করেন। সর্বশেষ সাক্ষাতকালে ব্রুটাস বা ক্যাসিয়াস কেউই কথা এড়িয়ে যান না, বা তোতলান না। তাদের জন্য জীবনের সফর শেষ হয় প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দে, যা অন্তঃসারশূন্য মানুষদের ঠিক বিপরীত, যারা বিদায় নেয় কাতর গোঙানির মধ্য দিয়ে।

রাজনৈতিকভাবে এলিয়ট ফ্যাসিবাদ, সাম্যবাদ ও উদারবাদসহ তাঁর সময়ের সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তার বদলে তিনি খ্রিস্ট্রীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ধর্মভিত্তিক সরকার গঠনের কথা বলেছেন। কিন্তু এই আদর্শগুলোর দুর্বল দিক সম্পর্কে তিনি স্পষ্টতই কম ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৫৪ সালে After Strange Gods: A Premier of Modern Heresy গ্রন্থে তিনি লিখছেন:

‘ভালোমন্দের পার্থক্য নিরূপণের গুণাবলীসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যে কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভের জন্য উন্মুখ আধমদের সংখ্যাও বিবেচনাযোগ্য। আমার নিজের প্রজন্ম খুব গুরুত্বের সঙ্গে সেজন্য কাজ করেনি। ছাপাখানাগুলোও এ ধরনের লেখা ছাপতে ব্যস্ত থাকেনি এবং এর থেকে আগে কখনো এতো ফালতু ও মিথ্যা মতবাদের জন্ম হয়নি।’

বিশ্বের সব দেশেই এখন ধর্মীয় উন্মাদনা মানুষের উদারবাদী অবস্থানকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। রাজনৈতিক ও শাসন ক্ষামতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা ডগ উইলসন মনে করেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা একটি ব্যর্থ প্রকল্প’ এবং তিনি ১৯৬০-এর দশকের উদার, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক উজ্জীবনকালের আন্দোলনকে আজ নিপীড়িত, নিম্নস্তরের অবিশ্বাসী এক সমাজ গঠনের জন্য দায়ী বলে মনে করেন। আজকের দিনে ধর্মীয় উগ্রবাদের মতো সমস্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতর্কগুলোও অগ্নিগর্ভ উসকানিতে পরিপূর্ণ। এগুলোকে কর্ম ও ক্ষমতায়নের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে ধর্মনিরপেক্ষ উদারনীতির বিরোধিতা করা হচ্ছে। 

ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উইলিয়াম উলফ ২০২৩ সালে বলেছেন, ‘যদিও খ্রিস্টান হিসেবে আমরা শান্তি চাই, কিন্তু শত্রু আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে আমরা যদি অস্ত্র তুলে না নেই, তবে তা হবে কাপুরুষের মতো আচরণ।’ এলিয়ট বেঁচে থাকলে আজ খুশি হতেন নিশ্চিত। খ্রিস্ট ধর্মের উগ্র পুনরুজ্জীবন তাকে আহ্লাদিত করত। 

বর্তমানে দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম সংখ্যালঘুর নাগরিক অধিকার খর্ব করছে, মানবতা ও উদারতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এই বিষয়টি একেবারে শুরুতে এপিগ্রাফেই মনোযোগ কাড়বে যেখানে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী গাই ফকস্, যিনি এলিয়টের মতো ক্যাথলিক আদর্শে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সরকার উৎখাতের জন্য সংসদ ভবনে বোমা স্থাপন করেছিলেন। তার কুশপুত্তলিকা দাহর অর্থ হলো, তার আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি জানানো। এলিয়ট উগ্রবাদীকে বীর হিসেবে চিহ্নিত করছেন, আর সাধারণ মানুষকে অন্তঃসারশূন্য বলে ভর্ৎসনা করছেন। কারণ তারা ধর্মকে গুরুত্ব দেয় না। 

The Hollow Men সেই অর্থে গভীরভাবে রাজনৈতিক কবিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক সমাজের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অনুভূতিহীনতা, ক্ষমতার দুর্বলতা, নৈতিক অধঃপতনের সমালোচনার সাথে রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ইঙ্গিত ব্যবহার দুর্বল নেতৃত্ব ও দুর্বল বিশ্বাসী জনগণের সমালোচনা করা হয়েছে। গাই ফকস্ ও ব্রুটাসের কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও তা এলিয়টের কাছে সক্রীয়তার অংশ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দান্তে ও কনরাডের উল্লেখ আধ্যাত্মিক ব্যর্থতাকে বোঝায়।

দান্তের ‘Divine Comedy’, বিশেষ করে ‘Inferno’র ‘Twilight Kingdom’, River Acheron’ Multifoliate Rose’ এর মতো চিত্রকল্পগুলো ব্যবহার করে তিনি আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক শূন্যতা, নিষ্ক্রিয়তা ও পরিত্রাণের অসম্ভাব্যতা তুলে ধরেছেন। দান্তে তাঁর পরকালের যাত্রায় এমন এক অবস্থা অবলোকন করেন যেখানে মানুষ ইহজগতেই আটকা পড়ে থাকে, পরিত্রাণ বা নরকবাস কোনোটাই জোটে না। ধর্মীয় প্রতিশ্রুতিহীন জীবন অন্তঃসারশূন্য মানুষের বৈশিষ্ট্য। পাতালের আকেরন নদী এই ফাঁপা মানুষেরা অতিক্রম করতে পারে না, অজস্র পাপড়ির গোলাপের সুঘ্রাণ তাদের নাকে পৌঁছায় না। দূরদৃষ্টির অভাব, ব্যর্থ উপাসনা ইত্যাদি সর্বনাশের চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে দান্তে আধুনিক মানুষের পোড়ো জমিতে আটকে থাকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দান্তে প্রতিষ্ঠিত পরকালের ধারণা ব্যবহার করে এলিয়ট সমসাময়িক বন্ধ্যাত্ব  অন্বেষণ করেন। এমন এক জগতের খোঁজ দেন যেখানে অভিশাপ ও মুক্তি―দুটোর পথই অস্পষ্ট। 

এলিয়ট Julius Caesar নাটকে ব্রুটাসের কথোপকথনের যে অংশটুকু থেকে কবিতার শিরোনাম ধার করেছেন তা হলো: ‘সোজা-সরল বিশ্বাসে কোনো কৌশল নেই;/কসরৎ দেখাতে উন্মুখ ঘোড়ার মতো/ অন্তঃসারশূন্য মানুষেরা বীরত্ব ও দক্ষতা দেখাতে চায়।’ ব্রুটাস তাদের নিন্দা করেছেন যারা কাজে নয় কথায় বড় হতে চায় এবং যারা কুটিলতা দিয়ে সত্য প্রকাশের ভয়কে আড়াল করে। এর মাঝে তরুণ এলিয়টকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাই অনেক সমালোচক এই কবিতাকে প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বীকারোক্তিমূলক মনে করেন। আর তা থেকে প্রবাদের সত্যের প্রমাণ মেলে, ‘ধর্মান্তরিত লোকের জোশ বেশি।’ 

এলিয়ট সবসময় উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি ‘সাহিত্যে ধ্রুপদীপন্থী, রাজনীতিতে রাজতন্ত্রী এবং ধর্মবিশ্বাসে রোমান-ক্যাথলিক।’ তাঁর লেখাতে সমাজ বিপ্লবের কোনো কথা নেই। কারণ বিপ্লব সামনে এগিয়ে যাবার পথ করে দেয়, কিন্তু এলিয়ট তো সামনে যাননি, পেছনমুখো ছিল তাঁর দৃষ্টি। ঐতিহ্য সন্ধান করেছেন তিনি, আর তা ধর্মীয় ঐতিহ্য। তিনি সংসদবিহীন রাষ্ট্র চান, যেখানে খ্রিস্ট্রীয় নীতি মেনে দেশ শাসিত হবে; এমন সমাজ চান যা রেনেসাঁ-পূর্ববর্তী সময়ে দেখা গেছে। বর্তমান সময়ের যে নীতিহীনতা ও অবক্ষয়ের পরিপ্লব তার মূলে রয়েছে মানুষের ধর্মীয় শিকড়ের সাথে সম্পর্কহীনতা―এমনই বিশ্বাস তাঁর। এই কথার সমর্থন মেলে তরুণ সান্যালের ‘এলিয়ট: প্রসঙ্গ ঐতিহ্য, খৃষ্টীয় সমাজ ও সংস্কৃতি’ নিবন্ধে:  

‘আসলে সতীত্ব, নিষ্ঠা, দয়া, মায়া, বিনয়, কৃচ্ছ্রতা―এসব লোপ পেয়ে গেছে পুঁজির দাপটে। মানুষ তার জীবনের উদ্দেশ্য বিষয়েই আর অবহিত নয়, তার জানার ইচ্ছাও নেই। এক প্রবল প্রবাহে সে ভেসে চলেছে। এই ভাসমান মূল্যবোধ বিষয়ে অজ্ঞ মানুষের সমাজ উদ্ভবের জন্য দায়ী তার শিকড়চ্যুতি। এলিয়টের মতে সে শিকড় ছিল রেনেসাঁপূর্ব কালে। ব্যক্তিস্বার্থবাদী যে মানুষ জন্ম দিয়েছে রেনেসাঁ, সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ‘হিউম্যানিজম’ এই অধঃপতনের জন্য দায়ী। আর তাই বর্তমান প্রেক্ষিত মনে রেখেও এলিয়ট আকাঙ্ক্ষা করেন এক খৃষ্ট্রীয় সমাজ রচনা।’

এলিয়ট তাঁর কবিতার সেই সময়কার অনেক উদারবাদী আদর্শ উপেক্ষা করেছেন, পরিবর্তে তিনি একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী মানসিক অবস্থান তৈরি করেছিলেন। শতবর্ষ পরে এসে দেখা যাচ্ছে সেই ভিত্তির ওপর বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে গেছে। যে দেশে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেই তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের চাষ করছে। আর সর্বত্র সেখানে নানা স্বাদের বিষফল ফলছে।

১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত এডলফ হিটলারের রাজনৈতিক ইশতেহার ও আত্মজৈবনিক Mein Kampf (আমার সংগ্রাম) এমন এক গ্রন্থ যেখানে নাৎসিবাদের ভিত্তি, হিটলারের বর্ণবাদী আদর্শ, জার্মানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা, নাৎসি শাসন ও হলোকাস্টের নৃশংসতার জন্য একটি নীলনকশা তুলে ধরা হয়েছে। বইটি একজন স্বার্থপর ব্যক্তির আত্মকথন ও ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক তত্ত্বের মিশ্রণ, যা ঘৃণা ও অপ্রমাণিত অভিযোগে ভরা। এমন গ্রন্থ এখন প্রায়ই লেখা হচ্ছে। ওই বইয়ের এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে, ‘যে বেঁচে থাকবে তাকে অবশ্যই লড়াই করতে হবে। যে এই পৃথিবীতে লড়াই করতে চায় না, যেখানে নিরন্তর সংগ্রাম জীবনের নিয়ম, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’ 

আপাত দৃষ্টিতে শুনলে যত উদ্দীপনামূলক মনে হয়, বাস্তবে ঠিক ততটাই উসকানিমূলক। এলিয়টের শূন্যগর্ভ মানুষেরা যে কারণে শূন্যগর্ভ বলে তিনি হাহাকার করেছেন, তার উল্টোদিকটাই বেশি সবল বলে এখন মনে হয়। ওদের মস্তিষ্কে ঘৃণা ও হিংসার পোকাগুলো যেভাবে কিলবিল করছে সেই কারণেই কি আজ ওরা অন্তঃসারশূন্য নয়? শতবর্ষ আগে সেই একই কারণে তিনি কি তাদের অগ্রজ ছিলেন?   

ঢাকা/তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়