ঢাকা     শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২০ ১৪৩১

ঈদ উপলক্ষে সৈয়দপুর রেল কারখানায় মেরামত হচ্ছে ১০০ কোচ

ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন, নীলফামারী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ৫ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৯:৪৮, ৫ এপ্রিল ২০২৩
ঈদ উপলক্ষে সৈয়দপুর রেল কারখানায় মেরামত হচ্ছে ১০০ কোচ

আসন্ন ঈদুল ফিতরে ঘরমুখো মানুষের চাপ মোকাবিলায় রেকর্ড সংখ্যক কোচ মেরামত করা হচ্ছে নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ জনবল, বাজেট স্বল্পতা, উপকরণ সরবরাহসহ নানা সমস্যা নিয়ে এবারের ঈদযাত্রায় ১০০টি কোচ সংযুক্ত করতে যাচ্ছে কারখানাটি। এর মধ্যে রয়েছে ৮৩টি ব্রডগেজ ও ১৭টি মিটার গেজ কোচ। 

এদিকে, অল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে ব্যাপক চাপের মধ্যেও  নষ্ট ও চলাচল অযোগ্য বগিগুলোকে সচল করে তুলছেন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। চরম কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পুরোনো ট্রেনকে নতুন করার কাজ চলছে ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি স্থাপন করে। সেই সময় সৈয়দপুর কারখানায় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। ধীরে ধীরে জনবল কমে যাওয়ার পরও এ কারখানায় প্রতিদিন একটি কোচ ও একটি ওয়াগন মেরামত করা হচ্ছে। এছাড়া রেলওয়ের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এখানে। প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ হচ্ছে কারখানাটিতে। 

কারখানার যান্ত্রিক শাখায় ২ হাজার ৮৫৯ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬২১ জন।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জিওএইচ, উৎপাদন মেশিন শপ, ক্যারেজ শপ, হুইল শপ, বগি শপ ও সিএইচআর শপ ঘুরে দেখা গেছে, চলছে নষ্ট হয়ে যাওয়া বগি মেরামত। কেউ ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, কেউবা ব্যস্ত চাকা মেরামতে। আবার কেউ ওয়েল্ডিং ও কোচের সিট মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোথাও আবার মেরামত করা বগিকে নতুন করে রং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে। সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। 

শ্রমিকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জনবল ও কিছু সংখ্যক কাঁচামালের অভাবে পুরো কর্মযজ্ঞ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 

মেরামতকৃত কোচ ঈদের বিশেষ ট্রেনগুলোতে সংযুক্ত করা হবে। রেলবহরে বাড়তি কোচগুলো যুক্ত হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টদের।  

প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ চলছে কারখানার ২৪টি বিভাগে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া ৭০টি বগি চলে গেছে রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাছে।

ক্যারেজ শপের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি সুবাহান আলী বলেন, ঈদ উপলক্ষে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গাড়ির যাবতীয় কাজ করছি। অচল গাড়িকে আমরা সচল করে থাকি। আমাদের কাজের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আগে যে পরিমাণ আউটটার্ন যেতো তার দ্বিগুণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের ওভারটাইম, হলিডেসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে আউটটার্ন নেওয়া চেষ্টা করছে আমরাও চেষ্টা করছি আউটটার্ন দেওয়ার। আমাদের কষ্টের বিনিময়ে মানুষ শান্তিতে ঈদ করতে পারবে, ঘরে ফিরতে পারবে এটাই আমাদের সফলতা।

পেইন্ট শপের বাবু লাল বলেন, আমি কালো রঙের কাজ করি। গাড়ির বডিতে যত কালো রং আছে সব আমি এবং আমার পাঁচজন সহযোগী মিলে করি। ঈদের সময় যে কাজের চাপ থাকে তা আমরা সুন্দরভাবে করে যাচ্ছি। আরও যদি কাজ থাকে তাও আমরা করবো। আমরা কাজকে ভয় করি না, কাজকে ভালোবেসে করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের জনসেবার জন্য আমরা এটা করছি। 

একই শপের শহিদুল ইসলাম বলেন, কাজের চাপ প্রচুর। এতো প্রচুর যে বলার মতো না। আমাদের লোক সংকট আছে। যার কারণে আমরা আউটটার্ন ঠিকমত দিতে পারছি না। সীমিত লোক নিয়ে গাড়ি আউটটার্ন দিচ্ছি আমরা। বাংলাদেশের বহুলোক বহু জায়গায় নিজ নিজ গন্তব্যেস্থলে যাবে ঈদ করতে। গাড়িতে টিকেট কেটে যাবে। এটা আমাদের অনেক অনেক ভালো লাগবে। এটা আমাদের গর্ব। আমরা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। সেবা দেওয়াটাই আমাদের কর্ম।

বগি শপের মিস্ত্রি মেহেদী হাসান বলেন, ট্রলি বের করে নতুন চাকা ফিটিং করে আবার সেটা গাড়িতে ফিটিং করি। ফিট করার পর গাড়ি আউটটার্ন দেই। এভাবে মাসে ১০ থেকে ১৫ টা গাড়ি আউটটার্ন দেই। ঈদ উপলক্ষে স্যাররা যে কাজ দেবেন সেটাই আমাদের করতে হবে। ১০ জনের কাজ দুইজনে করা লাগে। এই জায়গায় লোকবল নেই। কর্তৃপক্ষের উচিত নতুন লোক নেওয়া।

বগি শপের ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম বলেন, ১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল আমাদের কর্ম তৎপরতা চলবে। এই ৪০ দিনে আমাদের টার্গেট ১০০ কোচ প্রস্তুত করা। এই টার্গেট আমরা সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত কর্মযজ্ঞ চালাই। কারখানায় অনেকগুলো শপ আছে। একটা শপ আরেকটা শপের ওপর নির্ভরশীল। সবগুলো শপ সমন্বয় করে আমরা আউটটার্ন দেই। জিনিজটা এমন কেউ যদি একদিন কাজ মিস করে তাহলে আমাদের অন্যদিকে পিছায় যাওয়া লাগে। এজন্য আন্তরিকতার সঙ্গে সকাল থেকে আমাদের শ্রমিকরা রোজা থেকে শারিরীক পরিশ্রম করছেন। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটাই উদ্দেশ্যে,  ঈদে নিরাপদে অতিরিক্ত যাত্রী গ্রামে এবং  ঈদ শেষে যাত্রীদের নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া।

ক্যারেজ শপের ইনচার্জ মমিনুল ইসলাম বলেন, ঈদ উপলক্ষে ঘর মুখো যাত্রীদের একটা প্রত্যাশা ও চাপ থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপরে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা ১০০টি কোচের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। আমাদের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ কোচ আমরা আউটটার্ন দিতে সক্ষম হয়েছি। আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে বাকি ৩০ শতাংশ আউটটার্ন দিতে সক্ষম হবো বলে আশা রাখছি। আমরা দেশের সেবা করতে পারছি দেশের জনগণের সেবা করতে পারছি এটাই ভালো লাগার বিষয়। আমাদের কারখানায় লোকবল অনেক কম। তবে কর্তৃপক্ষ ওভারটাইম দিচ্ছেন এবং লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্বিগুণ পরিশ্রম করছেন। 

জিওএইচ শপের ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের অল্পসংখ্যক জনবল দ্বারা আমরা আমাদের কাজগুলো করে থাকি। আমার এখানে কিছু অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। অন্য সময়ে যে কোচ আউটটার্ন দিয়ে থাকি তার দ্বিগুণ আমরা বর্তমানে হাতে নিয়েছি। ঈদ উপলক্ষে যে ১০০টি কোচের টার্গেট রয়েছে ইতোমধ্যে আমরা ৭০টি কোচ ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পেরেছি। আগামী ১৩  বা ১৪ তারিখের মধ্যে বাকি কোচ গুলো ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পারবো। ঈদে মানুষের ঘরে আসার জন্য চলাচল ব্যবস্থা নিরাপদ করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই পরিশ্রমটাকে আমরা পরিশ্রম মনে করি না। যখন মানুষ নিরাপদে ভ্রমণ করে নিজ গন্তব্যে আসতে পারেন তখন আমাদের স্বার্থকতা আমরা পেয়ে থাকি।

কারখানার শিডিউল দপ্তরের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইনচার্জ) রুহুল আমিন রুবেল বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রার সুবিধার্থে ১০০টি কোচ আউটটার্ন প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০টি কোচ মেরামত করে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩০টি কোচ আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হবে। এই কোচগুলা দিয়ে পঞ্চগড়-ঢাকা, রাজশাহী-ঢাকা, চিলাহাটি-ঢাকা, খুলনা- ঢাকা, চাপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা এবং ঢাকামুখী ট্রেনগুলোতে সংযোজন হবে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা সহজ হবে। আমরা ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য অবদান রাখতে পারছি এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান বলেন, মার্চের ১ তারিখ থেকে এপ্রিলের ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমাদের ৪০টি কার্যদিবস রয়েছে। এই ৪০ কার্যদিবসের মধ্যে আমরা টোটাল ১০০টি কোচ মেরামত করে অপারেটিং ডিপার্টমেন্টকে হস্তান্তর করবো। এই কারখানা সক্ষমতা তিন ইউনিট। এই সময় আমাদের শ্রমিক কর্মচারীরা রয়েছেন তারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে অতিরিক্ত কোচ গুলোকে আউটটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এই কোচ গুলো বিভিন্ন আন্তঃ নগর ট্রেনগুলো যুক্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্য সময় আমাদের যে সমস্যা গুলো থাকে, সেই সমস্যা গুলো এখনও বহাল আছে। কিন্তু ঈদের সময় যাতে যাত্রীরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন সেজন্য আমাদের শ্রমিকরা উৎফুল্ল হয়ে কাজ করছেন। অনেক সময় তাদেরকে কাজের জন্য বলা লাগে কিন্তু বর্তমানে স্ব-প্রনোদিত হয়ে অতিরিক্ত কাজগুলো করেছেন তারা। 

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়