ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রম

সুমাইয়া জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৃদ্ধাশ্রম

অনেকে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটিকে সমাজের অভিশাপ বলে ব্যাখ্যা করেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মূল্যবোধের অভাব এবং অপসংস্কৃতির প্রভাবের প্রতীক হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন এই উদ্যোগকে। আমি কিন্তু এই ‘বৃদ্ধাশ্রম’ উদ্যোগকে বেশ সম্মান করি। যদিও বিষয়টি বিভিন্নভাবে দেখা যায়।

যদি আমরা আমাদের মূল সংস্কৃতির গোড়ার দিকে তাকাই, দেখবো আমরা মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজের বংশোদ্ভুত। সেই সাথে রয়েছে ইসলামিক চিন্তাধারার প্রভাব। সেই হিসেবে বাবা-মাকে ভালোবাসা বা যত্নে রাখা একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বা আছে। এই প্রজন্মের আগে মানুষ বাবা-মাকে অবহেলা করে ফেলে রাখার মতো স্পর্ধা খুব কমই দেখাত। কিন্তু বৈশ্বিক চিন্তাধারার মিশ্র প্রভাব এই ধারাকে ভেঙে নতুন প্রথার জন্ম দিয়েছে, যার চর্চা এখন আমাদের সমাজের সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

এখন আসি ‘বৃদ্ধাশ্রম’ উদ্যোগটি কতটা সমর্থনযোগ্য। এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, জাতি হিসেবে নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় আমরা কতটুকু শুদ্ধ? মূলত পশ্চিমা দেশের সভ্যতা ধীরে ধীরে আমাদের সভ্যতাকে গ্রাস করছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সফল, এ বিষয়ে আমার সাথে খুব কম মানুষই দ্বিমত পোষণ করবেন। সুতরাং আসল মূল্যবোধের জায়গা থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে এসেছি। তাই বাবা-মাকে সর্বোচ্চ সেবাদানের ভাবনা থেকেও আমাদের অবস্থান বেশ দূরে।

দ্বিতীয়ত, কৃষি ও পরিবারভিত্তিক ধারা থেকে বের হয়ে চাকরি ও একক পরিবার, চলমান সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট‌্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা, কমেছে পরিবারের সদস্য সংখ্যা। তাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের যথাযথ সেবা শুশ্রূষা করার সময় বা সুযোগ মানুষের নিতান্তই কম। অনেকে সেবিকা (নার্স) রাখেন পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনে। তবে বাড়তি একজন সেবিকার ব্যয়ভার বহন অনেক পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে। তাই তারা বৃদ্ধাশ্রমের শরণাপন্ন হন বাবা-মায়ের প্রতি শেষ কর্তব্য পালনের দায়বোধ থেকে।

এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে আমি কি বৃদ্ধাশ্রমের সমর্থক? সরাসরি বলবো ‘হ্যা’। কারণ বর্তমান সমাজে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আপনাকে পেছন ফিরে তাকালে চলবে না। অগ্রসর মানুষের সাথে ছুটতে হবে আপনাকেও। তবে এক্ষেত্রে কথা আছে। আপনি যদি আপনার পেশাগত জীবনের সাথে ভারসাম্য রেখে বৃদ্ধ ও অক্ষম মাতা-পিতার সঠিক শুশ্রূষা করতে সক্ষম হন, তবে আপনাকে দিচ্ছি বাহবা। কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষার কাজটি অত্যন্ত দুরূহ।

অনেক সময় দেখা যায়, সমাজের কটুক্তির ভয়ে বা নৈতিকতার টান থেকে চাকুরিজীবী পরিবার বৃদ্ধ প্রজন্মকে রাখেন নিজের সাথেই। কিন্তু এতে তাদের সঠিক দেখাশোনা না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক অবনতির শিকার হতে হয়। তাই সেক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমই তাদের শেষ আশার আলো।

যদি বৃদ্ধাশ্রম না থাকতো, একবার ভাবুন তো, কী হতো এসব অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের? অনেকে অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই আশ্রম না থাকলে ছেলে-মেয়েরা নিজের দায়ভার অর্পণ করতেন কার উপর? অনেকে আছেন, যারা জীবনে বিয়েশাদিই করেন না, আবার করলেও বাচ্চা হয় না, তাদের শেষ বয়সেও বৃদ্ধাশ্রম হয় একমাত্র অবলম্বন। তাই আমি জোরালোভাবেই বলবো, বর্তমান সমাজে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ অংশ। সভ্য জনগোষ্ঠীর সমাজে আত্মসম্মান রক্ষার দণ্ড এবং সমাজের বাড়তি হয়ে যাওয়া সদস্যদের শেষ ভরসা।

ধীরে ধীরে সমাজের মানুষের যে মূল‌্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, শারীরিক কারণে মানুষ যে হারে বন্ধ‌্যা হচ্ছে, তাতে বৃদ্ধাশ্রমের জন‌্য সরকারের আলাদা পৃষ্ঠপোষক এবং বাজেট থাকা অতীব জরুরি। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠতে পারে।

বৃদ্ধাশ্রম এমন একটি জায়গা, যেখানে শুধু অসহায় মানুষই থাকেন না বরং অনেক উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও থাকেন। তাদের চোখে একটু ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষা দেখা যায়।  

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ‌্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।


এসইউবি/সুমাইয়া জামান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়