ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

একটি মৃতপ্রায় স্বপ্নের বাস্তবায়ন

আসিফ অনিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ২৮ অক্টোবর ২০২০  
একটি মৃতপ্রায় স্বপ্নের বাস্তবায়ন

করোনার এই সংকটময় মুহূর্তে সদ্য এইচএসসি পাস করা ১৩ লাখ শিক্ষার্থীর সময় এসেছে জীবনের অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, সময় এসেছে বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত ভর্তিযুদ্ধের।

ছোটবেলা থেকে হয়তো তুমি একটা কিছু করার স্বপ্ন দেখে আসছো, ঠিক তেমনি তোমার পরিবার ও তোমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখে। হতে পারে তোমার ও তোমার পরিবারের স্বপ্ন একই, আবার আলাদা। সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তোমার সঙ্গে তোমার পরিবারের দেখা স্বপ্নের মিল থাকে না। এমন একটি স্বপ্নের কথা আজ তোমাদের বলবো।

২০১৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দেই। জিপিএ ৫ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগেই সরকারি আজিজুল হক কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হই। পরিবারের মানুষের আশা ছিল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। কিন্তু নিজে কখনো সেভাবে জীবন বা ভবিষ্যৎ নিয়ে উপলব্ধি করিনি।

উচ্চমাধ্যমিকে মাসখানেক ক্লাসের পর উপলব্ধি করলাম উচ্চ মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞান, গণিত আমার জন্য নয়। উল্লেখ্য, স্কুল জীবনে পদার্থবিজ্ঞানে একবার ৪ পেয়েছিলাম। এরই মধ্যে একদিন এক কাজিনের মাধ্যমে আসলে জানতে পারলাম যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং বাদে আরও অনেক চাকরি আছে, যেখানে সম্মান বা ক্ষমতা কোনো অংশেই কম নয়। এরপর, আমি যখন আমার গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের দুর্বলতা তার সঙ্গে শেয়ার করলাম, তখন তিনি বললেন, আমি চাইলে এখনো মানবিকে ভর্তি হতে পারি ও পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি, আইন, সাংবাদিকতাসহ অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারি।

সত্য বলতে সেদিনই মাথায় চেপে গেলো যে, আমি মানবিকেই পড়বো। বাসায় গিয়ে আব্বা-আম্মাকে বলার পর প্রথমই যে জবাবটি দিলো, এটি শুনলে মানুষ কী বলবে। তারা আরও বললেন, বিজ্ঞান না পড়লে সমাজে কোনো দাম নেই। এরপর, আমি বললাম, মানবিকে পড়তে না দিলে আমি আর পড়াশোনাই করবো না। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। সুতরাং আমার আর মানবিকে পড়া হলো না।

এরপরের সময়গুলো খুব যাচ্ছেতাইভাবে পার হতে লাগলো। কলেজের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষায় উচ্চতর গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে ফেল, প্রি টেস্ট পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে ফেল। সত্যি বলতে পড়াশোনার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। টেস্ট পরীক্ষার পরপরই সবাই যখন কোচিংয়ে ভর্তি হলো, তখন ডি ইউনিটের প্রস্তাব দিলেও আমাকে ফার্মগেটে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। 

২০১৭ সালের এপ্রিলে এইচএসসি পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার পর বাসায় বললাম, কোনোভাবেই পদার্থবিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পাবো না, ফলে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবো না। ভাবলাম, এবার হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আমাকে বগুড়ায় মেডিকেল প্রিপারেশন কোচিংয়ে ভর্তি করে দেওয়া হলো। কোচিংয়ে যাওয়া-আসা করতাম আর নিজের স্বপ্নকে মৃত্যুর দিকে এগোতে দেখলাম।

এইচএসসি ফলাফল প্রকাশের আগের শুক্রবার, কোচিংয়ে বিকালে উচ্চতর গণিতের ক্লাসে আমি ও আমার বন্ধু জাগ্রতকে অমনযোগী হওয়ায় স্যার বের করে দিলো। তো, বের হয়ে দুই বন্ধু গল্পের সময় বললো, আমি মনযোগী নই কেনো? এরপর আমি আমার ইচ্ছার কথা বললে ওই আমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে গেলো ও দুজনের টাকা দিয়ে বই কিনে সেদিন থেকেই বাসায় না জানিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। 

সপ্তাহখানেক পর এইচএসসি ফলাফল, আমার ফলাফল, জিপিএ ৪.৮৩। মেডিকেলে পরীক্ষায় ৫ মার্ক কাটা, বাসায় বললো এ অবস্থায় অন্যরা পারলে তুই পারবি না কেন? এরপর আরও ১০ দিন কোচিং করার পর কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোচিং বাদ দিবো ও নিজের মতো করে ডি ইউনিটের জন্য পড়বো। বাসায় এবারেও রাজী না, তবে আমার জেদে বাধ্য হলো ও বললো, ব্যাকআপ হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে।

তো, রেজাল্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মধ্যে প্রায় ৪০ দিন নিজের মতো করে পড়াশোনা করলাম। ১২ অক্টোবর ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পরীক্ষা। আগের দিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকলেও ভর্তি না হয়েই গেলাম পরীক্ষা দিতে। তো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম পরীক্ষায় আমার সিরিয়াল আসলো ৬৯১, সিট ২২৫। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম আমার দুইজন বন্ধু যারা ডি ইউনিটের কোচিং করেছে, তাদের সিরিয়াল ৪৫, ১২৪। অর্থাৎ তারা ইতোমধ্যে চান্স পেয়ে গেছে। সুতরাং আমি আবারও হতাশায় পড়ে গেলাম।

২০ অক্টোবর, ২০১৭। স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ইউনিটের পরীক্ষা। পরীক্ষায় বসে মনে পড়লো , বাবা-মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসে ডি ইউনিটের জন্য পড়লাম, এখন যদি চান্স না হয়, তাহলে কী হবে। পরীক্ষা শুরুর আগেই এই চিন্তা আমার কনফিডেন্স লেভেল মাইনাসে নিয়ে গেলো। তো পরীক্ষা শেষে বের হয়েই বুঝলাম, আমার স্বপ্ন ততক্ষণে শেষ, বাবাকে বললাম, আমি পারলাম না। বাবা বললো, ২টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটা দিয়ে দেখো কী হয়। ভেজা শরীরে ঢুকলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে। মোট প্রশ্ন ৭২টা। ৫৬টা উত্তরের ভাবলাম, ৫৬ পেলেও তো চান্স হবে না। তাই, ইচ্ছামত ৭২টাই পূরণ করলাম। 

এরপর রাত ৮টায় স্বপ্নের ঢাকা শহরকে অশ্রুবিদায় দিয়ে পরের দিন দুপুর ১টায় বগুড়া পৌঁছে আবার ৩টায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রাত সাড়ে ৮টায় রাজশাহী পৌঁছে বন্ধু রিফাতের বাসায় উঠলাম। ২২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুর বাসায় গেলাম, আরেক বন্ধু রিয়াল ও সেখানে এলো। তবে, আমি সত্যই জানতাম না একটুপর আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। 

৭টায় জানতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ইউনিটের রেজাল্ট হয়েছে। প্রথমে রিয়াল দেখলো, ওর চান্স হয়নি। এরপর আমারটা দেখলো, আমারও হয়নি, ইংরেজিতে মাইনাস মার্ক। মন খারাপ করে দুজন বসে থাকলাম। কিন্তু একটু পর যখন জানতে পারলাম আমার যেসব বন্ধু ডি ইউনিটের জন্য কোচিং করেছিল, তারা প্রায় সবাই চান্স পেয়েছে, তখন আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছি। রিফাতের বাসার ৫ তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম লাফ দিব কি দেব না। বাবা-মার ফোন কয়েকবার কাটার পর মনের মধ্যে যত রাগ ছিলো সব ঝাড়লাম। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, পরের দিনের পরীক্ষা দিয়ে বাসায় যাবো, আর কোনো পরীক্ষাই দেব না। সকালে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা ভালোই দিলাম। এরপর আইনের পরীক্ষা ১৫ মিনিট দিয়ে বের হলাম ও বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বগুড়ার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। 

বগুড়ার প্রায় কাছাকাছি এসে জানতে পারলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরিয়াল ৪৩০, সিট ৩৪০টি। সেখানকার এক ভাই জানালো, ভালো সাবজেক্টই পাবো। এরপর একটু প্রাণ ফিরে পেলাম, রাতে খাওয়ার পর বাসায় জানালাম যে, জগন্নাথে চান্স হয়েছে। বাসায় মোটামুটি খুশি হলো। কিন্তু পরের দিন রাতে আমাকে আবার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা দিতে বললো। অর্থাৎ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ানোর ভূত তখনো মাথা থেকে নামেনি। আমি সেই রাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম না।

আমার সর্বশেষ পরীক্ষা ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইচ্ছা ছিল না, তবে বাবার কথায় ট্রেনে ঘোরার উদ্দেশ্যে খুলনা রওনা দিতাম। আমি জানতাম, খুলনাতেও হয়তো শুধু বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা হবে। কিন্তু দেখলাম, গণিত ও মানসিক দক্ষতাও আছে, আর প্রশ্ন ইংরেজি ভার্সনে। তারপরও মোটামুটি পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। পরের দিন রাতে জানতে পারলাম বি ইউনিটে পজিশন ২৩৯।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েটিং ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির তারিখ ছিল ৩ ডিসেম্বর। জানতে পারলাম, খুলনায় সাংবাদিকতা পেতে পারি, তাই ভর্তি হয়ে গেলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সুতরাং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তোমার পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি তোমার নিজের ইচ্ছাকেও গুরুত্ব দাও। নিজের স্বপ্নকে শেষ হতে দিও না। ইচ্ছা থাকলে, পরিশ্রম করলে তোমার স্বপ্ন অবশ্যই তুমি পূরণ করতে পারবে ও তোমার মাধ্যমে তোমার, তোমার পরিবার, তোমার সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব। 

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন (তৃতীয় বর্ষ), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

খুবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ