ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

এখানে জলের রঙ কালো

সুপন সিকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪১, ২২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৭:৪৭, ২২ মার্চ ২০২১
এখানে জলের রঙ কালো

মাত্র আলো নিভেছে, চারদিকে অন্ধকার, কানে ভেসে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক। বদ্ধ ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ, দূরে এক ফোঁটা জোনাকির আলো ক্ষণিকেই সহস্র জোনাকির ঝলকানির মতো করে ফরিদপুরের কবি জসীম উদ্দীন হলে মঞ্চায়িত হলো ‘ভাটি কইন্যার পালা’ নাটক। নাট্যদল শহীদ সুফী নাট্য চক্রের ৩০তম প্রযোজনায় এই নাট্যের ১০ম মঞ্চায়ন। 

গমগম করছে হল। এই বুঝি নাটক শুরু হয়, না, হয়তো আরও একটু পর। কিন্তু না। ৭টা ২০মিনিটে শুরু হলো নাটক। নদী মাতৃক দেশের চরাঞ্চলের একটি গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠে গল্প। কি নেই সেই মেলাতে! গারশির গান, লাঠি খেলা, পুতুল নাচ, রঙ খেলা সব মিলিয়ে একটি সুদৃশ্য সন্দেশে পরিণত হয়েছে মুহূর্তটি। এই মুহূর্তটিই পুরো নাটক দেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাটির কইন্যার পালা নাট্যের ভেতর দিয়ে মূলত চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনার বহিঃপ্রকাশের চেষ্টা করেছেন নাটকের রচয়িতা শেখ ফরিদ আহমেদ। 

ভাটি অঞ্চলের একটি চর সালিপুরের একজন প্রভাবশালী ভূমিদস্যু শামসের খাঁর সঙ্গে হঠাৎ একদিন গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক দিনমুজুর ফজল মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়, তাকে বলেন তার জমির ফসল কেটে দিতে, তার বিনিময়ে ফজলকে এক ভাগ ফসল দেবেন কিন্তু ফজল মিয়া রাজি হন না, তখন শামসের খাঁ তাকে বলেন, দুই ভাগ ফসল দেবেন, ফজল মিয়া এতে মহাজনের কথায় রাজি হয়ে যান। পরের দিন সকালে ফজল মিয়ার বাবা তাকে ঘুম থেকে তোলেন ও ফজল মিয়াকে কাজে পাঠান। এক সময় বাড়ির বাইরে থেকে কোকিলের ডাক শোনা যায়, মুহূর্তেই মঞ্চে দেখা যায় ফজল মিয়ার একমাত্র মেয়ে কুসুমকে কলসি কাঁধে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে। তাকে দেখে ফেলেন দাদা, তাকে জেতে বারণ করেন কিন্তু দাদার চোখ এড়িয়ে কুসুম জল আনতে যায়, সেখানেই দেখা হয় কুসুমের প্রেমিক শমসের খাঁর একমাত্র ছেলে সুজনের সঙ্গে। তখন চলতে থাকে তাদের ভাব বিনিময়, এভাবেই এগোতে থাকে গল্প। 

নদীর পরম নিয়ম এক পাড় ভাঙে এক পাড় গড়ে। সেই ভাঙা ও গড়ার সঙ্গেই বদলে যায় ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবন, নেমে আসে অন্ধকার। এক মুহূর্তে দেখা যায় বর্ষায় সালিপুর চরে ভাঙনের কবলে পড়া নিরীহ মানুষকে নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জেতে, সেখানেও চোখ পড়ে শামসের খাঁর। তিনি তার পালিত লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে হানা দেন ও মানুষের শেষ সম্বল কেড়ে নেন। এই দৃশ্যে লেখক সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। 

শুধু চরাঞ্চল নয়, বাস্তব সমাজেও এই সব হায়নাদের বসবাস। নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় গল্প। চর ছেড়ে কুসুম চলে গেলেও সজলের কাছ থেকে তাকে আলাদা করা যায়নি। একদিন শামসের খাঁর এক গুপ্তচর কুসুম ও সজলের মেলামেশা দেখে ফেলে এবং শামসের খাঁকে জানায় এবং পিতা প্রথমে তার ছেলেকে সাবধান করেন, পরে কুসুমের বাবাকে অপমান করেন। মূলত এখানেই দুজনের সম্পর্কে চির ধরে। নানা ট্র্যাজেডির ভেতর দিয়ে গল্প ভেসে চলে। সমাজে অসহায় মানুষের শেষ পর্যন্ত নিজের সর্বস্ব হারাতে হয়, হয়তো এটাই চিরন্তন সত্য। ‘ভাটি কইন্যার পালা’ মূলত একটি পালা নাট্য। নাটকটিকে পালা নাট্য রূপায়নে নির্দেশক সেলিম মাহামুদ যে প্রয়াস দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। অন্যদিকে লেখক সমাজের ভেতরের অন্ধ ট্র্যাজেডিকে যে কারুকার্য দিয়েছেন, তা সত্যি ধন্যবাদের দাবি রাখে। 

নাটকের অভিনয়ের দিকে তাকালে প্রথমেই চোখ যায় শামসের খাঁ ও দাদা চরিত্রে শেখ ফরিদ আহমেদের দিকে। তিনি একাই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার অভিনয় এক কথায় অসাধারণ। তিনি একাই নাটক বয়ে নিয়ে গেছেন। এখানে লেখক নিজে দাঁড়িয়েছেন তার সৃষ্টির সামনে, যা সত্যি সাহসিকতার। এদিকে সজল চরিত্রে সেলিম মাহামুদ ছিলেন প্রাণবন্ত। তিনি নির্দেশকের ভূমিকায় থেকেও অভিনয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ফজল মিয়া চরিত্রে শহিদের অভিনয় দর্শকের চোখে পড়লেও। তার সংলাপ বলার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে ও চোখের ভাষাতে কাজ করবার প্রয়োজন রয়েছে। 

অপরদিকে কুসুম চরিত্রে রিশা চোখে পড়লেও তার লাজুক ভাব প্রকাশ পেয়েছে। শামসের খাঁর স্ত্রী চরিত্রে তাপসি ছিল ভীরু। অন্যান্য চরিত্রে শাহিন আহমেদ ও সজল ভালো করেছে। করিওগ্রাফি ছিল বেশ ভালো। সেখানে মুকুল, পাখি ও আফজাল সুনাম কুড়িয়েছেন। নাটকটির আবহসঙ্গীত ছিল অনবদ্য। আবহসংগীত নাটকটিকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। 

বিশেষ করে বাঁশির সুর ছিল মন ভোলানো। আলোকসজ্জা ছিল সাবলীল। সব কিছু ছাপিয়ে বলতে হয়, নানা অবশ্যম্ভাবীতার মাঝে তৃনমূলে যে এমন নাটক উপস্থাপন করা সম্ভব, এই সাহসিকতার জন্য শহীদ সুফি নাট্য চক্রকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। 

লেখক শেখ ফরিদ আহমেদ বলেছেন, ভাটি অঞ্চলের মানুষ আমি। বাবার মুখে শুনেছি আজ থেকে ৭০ বছর আগে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। সেই ভাঙনের সঙ্গে ঘোড়া দৌড় দিয়েও পারেনি। চরাঞ্চলে ভূমিদস্যুর অত্যাচার আছে এই দেশে, সব অপরাধের বিচার হয় কিন্তু ভূমিদস্যুরা একমাত্র বিচারের বাইরে থেকে যায়। যখন আবার চর জাগে, তখন ভূমিহীনরা নিজের জমিতে ফিরে আসে কিন্তু দেখা যায় তারা তাদের জমি আর পায় না। তত দিনে ভূমিদস্যুরা জমিগুলো একটা মাধ্যমে নিজেদের নামে করে নেয়। এই মানুষ নিজেদের জমিতে থাকতে পারে না আবার এরা এদের কথা কাউকে বলতেও পারে না। আমি এই নাটকের ভেতর দিয়ে নিরীহ মানুষের কথাগুলো বলবার চেষ্টা করেছি।

লেখক সৃষ্টিতে যে পরিবর্তনের বীজ রোপণ করেছেন, তা দর্শককে মুগ্ধ করেছে। মরুভূমির বুকে তৃষ্ণার্ত পথিকের কাছে জল মানে জীবন। আর ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছে জল মানে অন্ধকার জল, মানে কালো। বসন্ত বাতাসের সুরভীর মতো করে সৌরভ ছড়াক ‘ভাটি কইন্যার পালা’ এই কামনা। জয় হোক মঞ্চ নাটকের। 

পর্যালোচক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়