ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষার একাল-সেকাল

মামুনার রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২ মে ২০২১  
শিক্ষার একাল-সেকাল

শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ব, বিবেক, নৈতিক গুণাবলির বিকাশ সাধন, সৃজনশীল মেধাকে বিকশিত করা, বাস্তব জগৎ সম্পর্কে চিন্তাশীল ভাবনা ভাবতে সাহায্য করে। শিক্ষা আমাদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে, সমাজের কুসংস্কার, অনৈতিক কার্যকলাপ, অপসংস্কৃতি, বিকৃত চিন্তাধারাগুলোকে দূর করে৷ কিন্তু সে শিক্ষার পরিধি হতে হয় মহাকাশের মতো অসীম। 

প্রাণ থাকলে যেমন প্রাণী বলি, তেমনি মানুষকে তখনি একজন আদর্শ বিবেক সম্পন্ন মানুষ বলি, যখন তার মাঝে মনুষ্যত্বের ও নৈতিক মূল্যবোধ ও গুণের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। মেরুদণ্ড না থাকলে যেমন মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি সুশিক্ষা না থাকলে কোনো জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে অক্ষম। এজন্যই বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। 

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ জ্ঞান আহরণের পথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষা লাভ করি, তা মূলত আমাদের বাস্তবিক জগতে পরীক্ষায় পাসের জন্য, ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট লাভের আশায়, জীবিকার্জনের শিক্ষা। আমরা শিক্ষাকে এমনভাবে আকড়ে ধরেছি যে, পরীক্ষায় পাস করে বেশি বেতনভুক্ত চাকরিতে নিজেকে নিয়োজিত করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা। আমদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিলেই এটি পরিলক্ষিত হয়। আমরা আজকে অনেক বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করি, আসলেই কি শিক্ষিত বলতে এই শিক্ষাকে বুঝি? নাকি নিজের মধ্যে বিবেকসম্পন্ন, সুস্থ ধারার চিন্তা-চেতনার ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরা? যারা সুশিক্ষার মাধ্যমে আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে কাজ করে যাবে, কোনো প্রকার দেশ বিরুদ্ধ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়াবে না। 

আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার আজকের শিশুরা। আমরা বর্তমানে শিশুদের যে শিক্ষার দিকে ধাবিত করছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে সে রকম চিন্তাধারার জাতি পাবো। শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাই শুধু পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে। আমরা তাদের এক প্রকার বন্দি করে রেখেছি ও তাগিদ দিয়ে রেখেছি পাঠ্যপুস্তকের নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে৷ কিন্তু আমরা কি একবার চিন্তা করি আমরা আজকে তাদের যে প্রতিযোগিতার মাঠে নামিয়ে দিয়েছি, সেখানে কি আসলেই তারা পারবে; শিক্ষার আসল স্বাদটুকু গ্রহণ করতে? তাদের মেধার সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যমে নৈতিক গুণাবলী ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে? পারবে কি নিজের সৃজনশীল মেধাকে প্রসারিত করতে? শুধু শিক্ষিত নয়, সুশিক্ষিত হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে, তাহলেই হয়তো বা আমরা ভবিষ্যতে সুস্থ চিন্তা-ধারার একটা সুন্দর মানসিকতা জাতি পাবো।

সার্টিফিকেট অর্জনের লড়াইয়ে আজকে আমরা নিজের মেধাকে বন্দি করে ফেলেছি আত্মস্বার্থের এক অদৃশ্য দেয়ালে, মেধার  সুষ্ঠু বিকাশ ও ব্যবহারের কথা ভুলেই গেছি, জ্ঞানের পরিধিকে করে ফেলেছি সংকুচিত। তাই তো অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ উন্নতিতে সাড়া ফেলতে পারছে না এই শিক্ষা। আমাদের সমাজে কোনো মানুষের সম্মানের মাপকাঠি করি তার অর্জিত ডিগ্রি আর সার্টিফিকেট ও ডিগ্রির সংখ্যার উপর। আমাদের সমাজ বর্তমানে কোর্ট-টাই পরা স্বল্পশিক্ষিত বা নামমাত্র শিক্ষিত, ছোট মানসিকতার মানুষকে যতটা সন্মান করে, একজন সুশিক্ষিত, বিবেকসম্পন্ন, সুস্থ চিন্তা চেতনার,  নৈতিক গুণাবলি ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষকে ততটা সন্মান করতে জানে না।

সমাজ গঠনের মূল কারিগর প্রথমেই অভিভাবক, কারণ এদের কাছেই শিখি। সমাজের অধিকাংশ সন্তানের অভিভাবকের চিন্তা-ভাবনা এরকম হয়ে গেছে যে, আমার সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে ভালো কোনো কাজে নিয়োজিত হলো তো সুশিক্ষিত হলো। তারা যেভাবে মূল্যায়ন করার চিন্তা করছেন, সেটা অবমূল্যায়নের পথে যাচ্ছে না তো? অভিভাবকরা আজকে সন্তানদের যেভাবে শিক্ষিত দাবি করার চিন্তা করছে, সেটি অনেক দুশ্চিন্তার বিষয়। আমরা শিক্ষাকে ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত করে ফেলেছি, যেখানে লাভ-ক্ষতির হিসেব চলে প্রতি মুহূর্তে।  

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে ভর্তি করাতে ও ভর্তি পরবর্তী খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এটারও অনেক কারণ আছে, তারমধ্যে একটি হলো অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের অভিযোগ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাকি সঠিকভাবে পাঠদান করানো হয় না, তাই তারা শিশুদের ভর্তি করতে কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দারস্থ হচ্ছে।

অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি আছেন, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ না করেও নিজেকে সুশিক্ষার মাধ্যমে স্বশিক্ষিত করেছে। এই প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল কথা না বললেই নয়, যারা স্বচেষ্টায় পাড়ি জমিয়েছেন জ্ঞানের রাজ্যে।  আমরা অনেকেই একটা কথা বলে থাকি, আগে যারা এসএসসি বা এইচএসসি পাস, তাদের শিক্ষার সঙ্গে বর্তমানে বড় বড় ডিগ্রিধারীদের তুলনা করলেও আগের শিক্ষার মতো হবে না। এর কারণও অবশ্য আছে, আগে তারা নিজের চেষ্টায় নিজেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছে, নিজের বিবেকবোধ, সৃজনশীলতা, নৈতিক গুণাবলিগুলোকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছে, আর এখন আমরা সার্টিফিকেট অর্জনের লড়াইয়ে শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছি।

আমাদের সমাজে সম্প্রতি নানা অসঙ্গতি দেখতে পাই, তার মধ্যে কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি-

অনেক বাবা-মাই সন্তান কর্তৃক অবহেলিত হয়ে শেষ বয়সে এসে নিজের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমকে, অনেক সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তি সমাজের উচ্চপর্যায়ে দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে স্বার্থান্বেষী অনৈতিক কার্যকলাপে, নিজেকে নিমজ্জিত করেছে দুর্নীতির বেড়াজালে, গড়ে তুলেছে টাকার সাম্রাজ্য। আজকে আমরা স্বল্প শিক্ষিত হয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করার কথা ভুলেই গেছি,  হারিয়ে ফেলেছি নিজের মূল্যবোধকে, শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নানা রকম অসামাজিক ও রাষ্ট্র বিরুদ্ধ কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে সমাজ ও দেশের কাছে শিক্ষিত সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করছি, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছি বহির্বিশ্বের কাছে। এছাড়াও প্রতিনিয়তই দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো সমাজ বিরুদ্ধ কাজ তো আছেই। 

শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে ঠিকই কিন্তু তার মনুষ্যত্বকে কতটা জাগিয়ে তুলতে পারে এ বিষয়ে সন্ধিহান রয়েছে অনেক। আমদের সমাজে শিক্ষিত লোকের অভাব নাই কিন্তু সুশিক্ষিত লোক ক’জনই বা আছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে প্রভাবিত করতে পারলেও অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পারে না। সমাজের অভিভাবকদের উচিত শিক্ষাকে লাভ ক্ষতির দিক দিয়ে চিন্তা না করে নিজের সন্তানদের এমন শিক্ষার দিকে এগিয়ে দিতে হবে যে শিক্ষা গ্রহণের ফলে দেশ, জাতি, সমাজের ভাবমূর্তি উজ্বল করবে। যাতে ভবিষ্যতে বাঙালি জাতি মানবিকতা সম্পন্ন, বিবেকবান এক নতুন প্রজন্ম পায়।

বাঙালি জাতির দায়িত্ব যারা নিয়েছেন, তাদের উচিত, যে শিক্ষার মাধ্যমে জাতি নিজের সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখবে, সে শিক্ষা যেন কোনোভাবেই ব্যবসায়ীদের হাতে চলে না যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন শিক্ষার মান অক্ষুন্ন থাকে, সে দিকে কড়া নজর দিলে আগামীর প্রজন্ম আমাদের এই দেশকে উপহার দেবে নতুন কোনো ইতিহাস ও দেশকে নিয়ে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়। 

লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

দিনাজপুর/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়