ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মুক্তচিন্তা বিকশিত হয় কুবির মুক্তমঞ্চে

জাভেদ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:৫৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
মুক্তচিন্তা বিকশিত হয় কুবির মুক্তমঞ্চে

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রথম ক্লাস ছিল ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। একজন নবীন হিসেবে তখন ক্যাম্পাসের কিছুই চিনি না। ক্লাস শেষে আমরা সবাই সবাইকে বলছিলাম কোথাও একসঙ্গে বসে যদি আমরা পরিচিত হতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। একসঙ্গে ৫০ জন বসে পরিচিত হব তেমন কোনো জায়গা পাচ্ছিলাম না। তখন একজন সিনিয়র ভাই এসে বললেন, তোরা মুক্তমঞ্চে বসে সবার সঙ্গে একে একে পরিচিত হতে পারিস। আর এভাবেই মুক্তমঞ্চ থেকেই শুরু একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আর সেই পরিচয় থেকেই বন্ধুত্ব। বলা যেতে পাতে, আমাদের বন্ধুত্বের গল্পটা মুক্তমঞ্চ থেকেই শুরু। সেদিনের পর থেকে জায়গাটি হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল।  

এই মুক্তমঞ্চকে শুধু আমাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল ভেবে ভুল করবেন না। কখনো কখনো সিনিয়র ভাইদের দেখি মুক্তমঞ্চে বসে স্মৃতিচারণ করতে। স্মৃতিচারণ করতে করতে তাদের চোখ থেকে দুয়েক ফোটা অশ্রুও ঝরতে দেখেছি। কখনো দেখি কবুতরের জোড়ার মতো বসে থাকে প্রেমিক-প্রেমিকা। বলে যায় কত কথা, বুনে থাকে রঙিন স্বপ্ন। লাল মাটির এই ক্যাম্পাসে মুক্তমঞ্চকে বলা হয় স্বপ্ন বোনার জায়গা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাণ কেন্দ্র।

এ মঞ্চে আসতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত নাক বরাবর আসতে হবে। এরপর হাতের বাম দিকে মোড় নিলেই দেখা যাবে গ্রিক এরিনা তথা ওপেন এয়ার মঞ্চের আদলে তৈরি স্থাপনাটি। লাল সিরামিক ইট দিয়ে তৈরি এই মুক্তমঞ্চটিতে রয়েছে ১০টি সিড়ি, যেখানে প্রায় ৫০০ জন একত্রে বসে যেকোনো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। এখানেই শেষ নয় মুক্তমঞ্চের পূর্ব-উত্তর দিকে রয়েছে সবুজ গালিচা; চাইলে সেখানে বসেও উপভোগ করা যাবে অনুষ্ঠান। এছাড়া দর্শকদের সামনে লাল সিরামিক ইটের কাজ করা বিশাল মঞ্চতো রয়েছেই।

একদিন আমার সিনিয়র ভাই অর্ক গোস্বামীর সাথে মুক্তমঞ্চ নিয়ে গল্প করছিলাম। তখন তিনি এর যাত্রা শুরুর প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান এখানে আয়োজন করা হয়েছে। তবে এর শুরুটা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন 'থিয়েটার কুবি'। বর্তমান মুক্তমঞ্চের জায়গাটি পূর্বে ঝোপঝাড়ে ভর্তি ছিল। সে জায়গাটি পরিষ্কার করে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ উপলক্ষে 'থিয়েটার কুবি' 'বাঙালির স্বাধীনতা' শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনুষ্ঠান শেষে 'থিয়েটার কুবি' ও এই সংগঠনের সভাপতি মেহেদী হাসান উপস্থিত শিক্ষকদের নিকট এই স্থানে মুক্তমঞ্চ করার দাবি তুলেন। এর ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় এ মুক্তমঞ্চটি নির্মিত হয়। মঞ্চটি যখন বর্তমান আকার লাভ করে, তখন থিয়েটার কুবিই সর্বপ্রথম মান্নান হীরা রচিত ‌ইনডেমনিটি' নাটকটি এখানে মঞ্চস্থ করে। 

এ মুক্তমঞ্চ দ্রুত সময়ে যার কারণে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে, তিনি হলেন প্রত্নতত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের জন্য গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রধান ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যখন এসেছিলাম, তখন দেখতাম ছাত্র-ছাত্রীরা মাটিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন সংগঠনকে দেখতাম তাদের প্রোগ্রাম করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। তখন শুধু আফসোসই হতো! কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে যখন দেখি ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে বা কখনো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে, তখন খুব ভালো লাগে।

মুক্তমঞ্চ ছাড়াও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁঠাল তলা, শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। মুক্তমঞ্চের মত সেসব জায়গাতেও প্রতিদিনই আড্ডার আসর বসে। তবে সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে অন্যন্য ভূমিকা পালন করে আসছে কুবির এই মঞ্চ।

লেখক: জাভেদ রায়হান

মুক্তমঞ্চের ব্যাপারে বলতে গিয়ে 'থিয়েটার কুবি'র বর্তমান সভাপতি অর্ক গোস্বামী বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন নাট্য উৎসব করি, তখন তিন দিনের প্রোগ্রামের জন্য আমাদের প্রায় ২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল শুধু মঞ্চের জন্য। কিন্তু যখন মুক্তমঞ্চের কাজ শেষ হয়, তখন এসবের জন্য আমাদের নামেমাত্র একটা খরচ হয়।  ক্যাম্পাসের সার্বিক সাংস্কৃতিক আবহ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুক্তমঞ্চ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যখন তাকাই, তখন দেখি সাংস্কৃতি চর্চার বেশিরভাগই হয় মুক্তমঞ্চ কেন্দ্রিক। আমাদের যেহেতু এখনো অডিটোরিয়াম বা টিএসসি নেই, তাই বলতে পারি মুক্তমঞ্চ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিমনা করে তুলতে প্রধান নিয়ামক হিসেব কাজ করে।

কুবির প্ল্যাটফর্ম ব্যান্ড দলের সদস্য আহসান হাবীব জয়, যিনি মুক্তমঞ্চের অনেক অনুষ্ঠানেই পারফর্ম করেছেন। তার কাছে মুক্তমঞ্চের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মুক্তমঞ্চের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশটা অনেক সুন্দর। এমন পরিবেশে পারফর্ম করতে অনেক ভালো লাগে। আগে অন্য কোথাও আমরা তেমন রিহার্সেলের সুযোগ পেতাম না, মুক্তমঞ্চ হওয়াতে আমরা অনুষ্ঠানের আগে রিহার্সেল করতে পারছি এবং অনুষ্ঠানগুলো সুন্দরভাবে আয়োজন করতে পারছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

/মাহি/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ