জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ মুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস রাবি
ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি || রাইজিংবিডি.কম
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রাবি শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করেন।
১৬ জুলাই, ২০২৪ সালের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছে। এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়।
এ ঘটনাটি শুধু রাবির শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, সমগ্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কারণ রাবিই প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করে।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রাবি শিক্ষার্থীদের এ প্রতিরোধ দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসেও ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার প্রেরণা জোগায়, যা পরবর্তীতে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ফুঁসে উঠছিল, তখন আন্দোলন দমনের প্রধান দায়িত্ব নেয় ছাত্রলীগ। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হুমকি, হামলা ও কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করছিল। রাবির শিক্ষার্থীরা দ্রুতই বুঝতে পারে, এ আন্দোলনকে সফল করতে হলে ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা অপরিহার্য।
১৬ জুলাইয়ের দুপুরের দিকে এই ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়। শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল বেলা আড়াইটায়, কিন্তু ছাত্রলীগের সম্ভাব্য বাধা এড়াতে শিক্ষার্থীরা গোপনে নির্দিষ্ট সময়ের ২-৩ ঘণ্টা আগেই একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর থেকে প্রায় দুশো থেকে আড়াইশো শিক্ষার্থীর একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রায় ১০০ জন পুলিশ সদস্য উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো বাধা দেননি। প্রতিরোধের জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল রড, পাইপ ও লাঠিসোঁটা।
শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই মুহূর্তেই সব হলের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বেরিয়ে আসেন। জোহা চত্বর এবং প্যারিস রোড ধরে যখন বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন বিপরীত দিক থেকে আরো কয়েকশ শিক্ষার্থী এসে মিছিলে যোগ দেন। মেয়েদের হলের সামনে পৌঁছালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রীও এই বিশাল মিছিলে অংশ নেন।
মিছিলটি বিজ্ঞান ভবন ও হাবিবুর রহমান হলের মাঠ হয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের সামনে আসে, যেখানে ছাত্রলীগ কর্মীরা অবস্থান করছিল। শিক্ষার্থীরা হলের ভেতর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের প্রতিহত করতে শুরু করে। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মাদার বখশ হলের সামনে চলে আসে।
ততক্ষণে সোহরাওয়ার্দী, জোহা, শাহ মখদুম, লতিফ ও আমীর আলী হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে তাড়া করে। সাড়ে ১৫ বছরের নিজেদের ‘রাজত্ব’ ছেড়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গালিবের পালিয়ে যাওয়ার ১০ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তার হলের কক্ষটিও ভাঙচুর করে।
এরপর বিক্ষোভ মিছিলটি বিজয় ২৪ হলের (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল) সামনে এসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর করে। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে পুলিশ উদ্ধার করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ এবং দপ্তর সেল থেকে তিনটি পিস্তল, ছয়টি রামদা, ১০-১৫টি মদের বোতল, কয়েকটি দা এবং রড উদ্ধার করেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। পরে উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র রাবি প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাবেক সমন্বয়ক মেশকাত মিশু সেই দিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি জানান, ১৬ জুলাই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, তারা প্রতিটি হলের গেটে তালা মেরে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যেতে বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি সেদিনই সংঘটিত করে।
তিনি বলেন, “ওইদিন আমি ছাত্রলীগের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মাদার বখশ হলের সামনে আসি। দেখি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গালিব তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল আসাদুল্লাহ-হিল গালিব ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের তাড়া করেন। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। নিমেষেই তাদের দীর্ঘদিনের মসনদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। বিরল সে মাহেন্দ্রক্ষণ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় থাকা সানজিদা ঢালি জানান, ১৬ জুলাইয়ের এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রস্তুতি ১৫ তারিখ থেকেই শুরু হয়েছিল। ছাত্রলীগের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় তারা দুপুর আড়াইটায় আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। মেয়েদের হলের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সানজিদা সেদিন দুপুর ১টা থেকেই মন্নুজান হলে ঘণ্টা বাজিয়ে মেয়েদের একত্রিত করতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, “সব হলের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে যখন মন্নুজান হলের সামনে অবস্থান নেয়, তখন দেখি ছেলেরা প্যারিস রোড হয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা মেয়েরা সেই মিছিলে যুক্ত হই এবং একসঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। আমাদের মিছিলের সংখ্যা এতটাই বড় ও শক্তিশালী ছিল যে, ছাত্রলীগ তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব মনে করেন, “১৬ জুলাই রাবি থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। মূলত ছাত্রলীগকে বের করার মাধ্যমেই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান রচিত হয়। এই ঘটনার মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশের শুভ সূচনা হয়েছে।”
আরেক সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা বলেন, “তাদের ভয়াল গ্রাসের কারণে এই প্রক্রিয়া মোটেও সহজ ছিল না। এর জন্য ১৫ জুলাই রাতের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা ক্যাম্পাসের এক জায়গায় জড়ো না হয়ে বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হই। ছেলেদের হল, মেয়েদের হল ও বিনোদপুরকেন্দ্রিক আলাদা আলাদা করে জড়ো হই। ছাত্রলীগ হাবিবুর ও জিয়া হলে আক্রমণ করলে, ছেলেদের হলের একটি গ্রুপ তাদের তাড়া করে। এরপরই ছাত্রলীগ কর্তৃক দখলকৃত রুমগুলো দখলমুক্ত করা হয়। সন্ত্রাসের রাজত্ব মাটিতেই মিশিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা।”
ঢাকা/মেহেদী