ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

‘ব্যাংকিং খাতে যে পরিস্থিতি তা অত্যন্ত নাজুক’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ২৪ জুলাই ২০২২  
‘ব্যাংকিং খাতে যে পরিস্থিতি তা অত্যন্ত নাজুক’

‘ব্যাংকিং খাতের যে পরিস্থিতি তা অত্যন্ত নাজুক। ব্যাংকিং খাতের সুদের হারের সীমারেখা বেঁধে দেওয়ায় ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ সংকুচিত হচ্ছে। আমাদের দেশে ইনভেস্টমেন্ট জিডিপি রেশিও এখনও কম আছে। বেসরকারি খাতের যে বিনিয়োগ মূলত ব্যাংক ফাইন্যান্সিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। কেননা, ক্যাপিটাল মার্কেট এখনও যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ যে মনিটারি পলিসির প্রতিবেদনে যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল তার চেয়ে কম। কাজেই এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুদের যে সীমারেখা বেধে দেওয়া আছে তা কতটুকু যৌক্তিক।’

রোববার (২৪ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ : কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?’ শীর্ষক আলোচনায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেন। 

আলোচনায় প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ,  বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আলোচনায় অংশ নেন।  

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ অনেকটা কমে গেছে। আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। রেমিট্যান্সে শুধু ২.৫০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে কতটুকু কাজ হয়েছে তা দেখতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে আমাদের মধ্য মেয়াদী চেষ্টা করতে হবে। বাজার বৈচিত্রকরণ ও দক্ষ লোকবল বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। যাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।  

তিনি বলেন, আমদানি প্রবৃদ্ধি টাকার অঙ্কে বেড়েছে তাতে প্রাইজ (মূল্য) নাকি কোয়ান্টিটি (সংখ্যা) দেখতে হবে। আমার ধারনা মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে। আমদানির সঠিকভাবে হচ্ছে না ওভার ইনভয়েসিং করছে তার উপর নজর দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে দারিদ্রসীমা এখনও অফিসিয়ালভাবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রয়ে গেছে। এরপর আর জানা নেই। ২০১৯ ছিল ২০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচের লোকসংখ্যা বেড়ে এখন ৩০ শতাংশ হয়েছে। আর তা কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য একদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে অপরটি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে হবে। আর যখন কর্মসংস্থানের কথা আসে তার সঙ্গে বিনিয়োগের প্রশ্ন আসে। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল অনেক সময় তসরুপের কথা শোনা যায়। এই তহবিল দারিদ্রসীমার নিচের লোকজনকে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, দেশে আয়ের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল তা বিতরণ অনেকটাই সম্ভব হয়নি।

মূল প্রবন্ধে সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। মূল্যস্ফীতির অব্যাহত চাপ, দেশীয় মুদ্রামানের পতন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে আসা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহে পতন এবং সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। এসব চ্যালেঞ্জ উস্কে দিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই সংকট স্বল্পমেয়াদী প্রকৃতির নয়। তাই সহজে সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না। সরকারের বর্তমান ব্যবস্থাগুলো বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদী প্রকৃতির। তাই সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ খুঁজে বের করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব বাড়ানো, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বৃদ্ধি করা।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার সময় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটারি পলিসির ঘোষণার মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন। সেটি কিভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়। গত মাসে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশিত সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি হারের তুলনায় অনেক বেশি। কোনও কোনও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ‌্যের মূল্য ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।  

এই সংকটকালে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো- অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা। যা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এছাড়া মনিটারি পলিসিতে যেসব বিষয় বলা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। আমরা মূল্য নিয়ন্ত্রণের যে টুলস ব্যবহার করছি তা খুব বেশি কাজে আসছে না। তাই মধ্যবিত্ত ও ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কৃচ্ছ্রতা সাধনে সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তাতে সুফল পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বব্যাপী ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি আমদানিতে আমাদের চলে যায় বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল এবং এলএনজি জ্বালানি আমদানিতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং দ্বিপাক্ষিক উৎস যেমন-সৌদি আরব কুয়েত, কাতার থেকে ঋণ নিতে পারে। তাছাড়া সরকারি, ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিশেষ করে বিদ্যুতে লোডশেডিং, সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার উদ্যোগ বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সংকটের মধ্যে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করতে হবে। এরমধ্যে রাজস্ব আহরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময় যদি আমরা সহায়তা দিতে চাই যাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে না পড়ে তাতে রাজস্ব আহরণে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি রাজস্ব আহরণ ও সরকারি ব্যয় বিরাট ঘাটতি রয়েছে। এতে সু-ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ সংকট বিশ্ব সংকট। যা সহসা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সংকট থাকবে। সংকট ২০২৪ সালে ঠিক হতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো বলেই আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যেখান থেকে আমরা সরে আসছি সেখানে পুনঃস্থাপন করা গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা/এনএফ/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়