ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

লোনের টাকায় সফল ব্যবসায়ী রিয়াদ

আনিসুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০২১
লোনের টাকায় সফল ব্যবসায়ী রিয়াদ

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রিয়াদ। আর দশটা ছেলের মতো স্বাভাবিকভাবে সময় যাচ্ছিল তার। কিশোর বয়স শেষ করে সবে যৌবনে পর্দাপণ। বাবা-মায়ের আদরের ছেলে দুষ্টুমিতে কমতি ছিল না। একটা সময় ছিল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় দিন কাটতো। সকালে বের হলে রাতে বাসায় যাওয়া হতো। নানা জায়গায় ঘুরে-ফিরে দিন চলে যেত। পরিবারে দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় বিয়াদ পাঠান (২৫)। 

পরিবারে বড় ছেলে হওয়াতে একটা সময় সংসার সামলানোর চাপ আসতে শুরু করে রিয়াদের উপর। ফলে তাকে পড়াশোনাটা ছাড়তে হয়। তাই টানাপোড়েনের কথা চিন্তা করে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। কিন্তু তার আগে থেকেই চাকরি জিনিসটা অপছন্দ ছিল। স্বাধীনতার অভাব এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে চাকরি ভালো লাগতো না। এজন্য কয়েকটা চাকরি করার পরও মন টেকেনি। শেষ পর্যন্ত একেবারে চাকরি ছেড়ে শেষ গন্তব্য বাড়িতে চলে আসেন। 

বাড়িতে থাকার সময় হতাশায় ও বিষন্নতায় দিন কাটতো। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে চলাফেরা করতে কষ্ট হতো। সবসময় পরিবারের কাছে টাকা চাইতে লজ্জা বোধ হতো। এভাবে প্রায় দুই বছর বেকার জীবন কাটে। বেকার থাকার সময় তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধ-বান্ধব এবং পরিবার থেকেও অনেক কটু কথা শুনতে হতো। সবাই কেমন যেন অবহেলা ও সমীহ করে চলতো। তখন তার নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো। ভাবতো তাকে দিয়ে হয়তো কিছু হবে না।

কিছু দিন যাওয়ার পর তার জেদ হলো। সবার অবহেলাটা আর নিতে পারছিল না। সে ভাবতে লাগলো নিজের পরিবার ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও তার কিছু করা উচিত। মাথায় ব্যবসা করার চিন্তা আসলো। কিন্তু তখন তার কাছে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। কারো কাছে টাকা চাইতে লজ্জা লাগত। অনেকের কাছে টাকা চাওয়ার পরও পাননি। সবশেষে কারো কাছে টাকা না পেয়ে তার এক চাচাতো ভাইয়ের সহযোগিতায় ৫০ হাজার টাকা লোন নেন। ভাবতে লাগলেন এত অল্প টাকা দিয়ে কী ব্যবসা করবেন! 

তার বাড়ির কাছে গাছতলা ব্রীজের পাশে টঙের মতো একটা দোকান ছিল। মনে মনে তার দোকানটি কেনার ইচ্ছে হলো। তখন সে টঙের মালিককে দোকানটি ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন। মালিক দোকানটি বিক্রয়ে রাজি হন। তখন সে লোনের টাকার কিছু অংশ দিয়ে ভাঙা দোকানটি কেনেন। দোকানের কিছু অংশ মেরামত করে একটু বড় ও পরিপাটি করেন। প্রথমে দোকানে ১০-১২ হাজার টাকার মালামাল উঠানো হয়। এরমধ্যে চা-সিগারেট, বিভিন্ন আইটেমের বিস্কুট, কেক, রুটি, কলা, চিপ ইত্যাদি পণ্যগুলো ছিল বেশি। দোকান উঠানোর পর অনেকে অনেক কথা বলেছেন। তার দ্বারা এসব হবে না, দুই মাসের মধ্যে দোকান ছেড়ে দেবে, এগুলো তার পক্ষে সম্ভব হবে না, শুধুই সময় নষ্ট করা ইত্যাদি। 

অনেকে অনেক সমালোচনা করেছে। তখন সে মনে মনে নিজকে বলতো ‘না’ তার কিছু করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও কিছু করা দরকার। এসব কথা সে কর্ণপাত করতো না। নিজের প্রতি বিশ্বাস ও মানসিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে গেছেন। এছাড়া দোকান কেনার সময় তার ফুফাতো ভাই ও কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব তাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। সবসময় নানাভাবে পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন।

টঙ দোকানের পাশেই ছিল চাঁদপুর মেরিন একাডেমির ভবন। এখানে অনেক শিক্ষার্থী ট্রেনিং নেয়। তারা অনেক দূর থেকে এসে এখানে ক্লাস করেন।  শহর থেকে একটু বাইরে হওয়াতে একাডেমির আশেপাশে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। এছাড়া একাডেমিতে শিক্ষার্থীদের খাওয়ার কোনো নিজস্ব সিস্টেম নেই।  এখানে তার কেনা টঙ দোকান ছাড়া আর কোনো দোকান নেই বললেই চলে।  শিক্ষার্থীরা তার দোকানের রুটি, কলা, বিস্কুট, চা খেয়ে দিন কাটাতো। এগুলো খেয়ে আসলে দিন কাটানো সম্ভব ছিল না। তার কাছে বিষয়টা ভালো লাগতো না। তাই চিন্তা করলো কী করা যায়। 

ছোট থেকেই সে একটু-আধটু রান্না করতে পারতো। চিন্তা করলো নিজের তৈরি করা খিচুড়ি সস্তায় তাদের জন্য তৈরি করবে। প্রথমে মুরগিটা ছোট ছোট করে মিক্স করে খিচুড়ি তৈরি করলো। দাম নির্ধারণ করা হলো ৫০ টাকা। মোটামুটি মেরিনের ট্রেনিং নিতে আসা শিক্ষার্থীরা খিচুড়ি টেস্ট করতে শুরু করলো। তখন সে লক্ষ করলো খিচুড়িটা শুকনো হওয়ার ফলে তাদের খেতে একটু কষ্ট হচ্ছে। পরে খিচুড়িটা অন্যভাবে তৈরি করা হলো। মুরগির সঙ্গে আলু ও ঝোল দেওয়া হলো, যাতে খেতে সুবিধা হয়। এত সস্তায় খিচুড়ি পেয়ে তারা সবাই সন্তুষ্ট হলো। 

তখনো তেমনভাবে টঙ ঘরটি কেউ চিনতো না। সিপি রাইডারস্ নামে একটা গ্রুপের সদস্যরা প্রতিদিন সকালে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে এখানে আসতো। তখন তারা কৌতুহলবশত টঙ দোকানে আসেন। চা-টা খওয়ার পর তার বানানো খিচুড়িটা সবাই টেস্ট করেন। মোটামুটি সবার কাছেই খিচুড়িটা ভালো লাগলো। তখন তারা ফেসবুকে রিভিউ দিলেন যে অল্প টাকার মধ্যে ভালো মানের খিচুড়ি পাওয়া যায়। ফেসবুকে রিভিউ দেখে তাদের বন্ধুরা এখানে আসেন এবং তারাও খিচুড়টা টেস্ট করেন। তাদের কাছেও অল্প টাকার মধ্যে এটা স্বাদের ও ভালো মনে হলো। তখন তারাও ফেসবুকে রিভিও দেন। 

এভাবে স্থানীয় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা দেখেন। ধীরে ধীরে নেটওয়ার্ক বাড়ে এবং তার দোকানের বিষয়টা সবাই জানতে শুরু করে। মানুষের চাপ দিন দিন বাড়তেই থাকে। এভাবে তার ব্যবসা ভালো হতে শুরু হলো।

তখন সে দোকানের নাম ‘পাঠান টং ঘর’ দিয়ে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। অনলাইনে খিচুড়ির অর্ডার আসতে শুরু করে। প্রথম প্রথম অর্ডার কম হলেও পরে বাড়তে থাকে। একটা সময় অতিরিক্ত অর্ডারের কারণে হিমশিম খেতে হতো। তাড়াহুড়োয় ডেলিভারি করতে গিয়ে কয়েকবার মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টও হয়েছেন। এরমধ্যেই  টঙ ঘরে কিছু আইটেম বাড়ানো হয়। মোরগ পোলাও, ভুনা খিচুড়ি করা হয়। বিভিন্ন পোগ্রাম বা বিশেষ দিনে ফ্রাইড রাইসের সঙ্গে ফ্রাইড চিকেন, কোমল পানি ও ভেজিটেবল দিয়ে প্লেটার করে অফার দেওয়া হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে এক টাকার চায়ের অফার ও ফ্রিতে হোম ডেলিভারিও দেওয়া হয়। পাশাপাশি কক মুরগি খিচুড়ি, বিফ খিচুড়ি করা হয়। 

এছাড়াও দুপুরে ও রাতে খাওয়ার জন্য সাদা ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন আইটেমের মাছ, ডাল, ভর্তা ও সালাদ দিয়ে প্যাকেজ করা হয়। চায়ের আইটেম বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রায় ২৩ ধরনের চা পাওয়া যায়। এরমধ্যে কাজুবাদাম চা, নবাব চা এবং মালাই চা বেশি বিক্রি হয়। বিকালে বা সন্ধ্যায় চিকেন চপ, ডিপ চপ, রোল এবং নুডুলস আইটেম  বিক্রি হয়। এছাড়া সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খিচুড়িটা পাওয়া যায়। খিচুড়ি এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এছাড়াও শীতের এই সময়ে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি পায়েস পাওয়া যায়।  

প্রতিদিন এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা জায়গা থেকে মানুষ আসেন। নদীর উপর ব্রীজ ও পাশের মেরিন একাডেমি একসঙ্গে জায়গাটার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মোটামুটি ঘুরার মতো একটা পরিবেশ আছে এখানে। সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ হওয়াতে অনেকেই সময় কাটাতে আসেন। তখন তারা গল্প ও চায়ের আড্ডায় মেতে থাকেন। 

করোনা ও লকডাউনের সময় বেচাকেনা কম হতো। তবে করোনার আগে তার ব্যবসা ভালো ছিল। এটা প্রতিটা ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই হয়েছে। এখন করোনা কমতে শুরু করায় ব্যবসা আবার আগের মতো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে ব্যবসা আরো বেশি হবে। করোনা মহামারিতে পাঠান টঙ ঘরের পক্ষ থেকে প্রায় ২০০-৩০০ পথশিশু, বৃদ্ধ ও খেটে খাওয়া মানুষের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। 

রিয়াদ পাঠান বলেন, ‘টঙ ঘর নিয়ে আরো বড় পরিকল্পনা আছে আমার। ভবিষ্যতে বড় পরিসরে রেস্টুরেন্ট করবো ও সবচেয়ে কম খরচে ও দামে মানসম্পন্ন খাবার উপহার দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবার দোয়া ও ভালোবাসা নিয়ে পাঠান টং এগিয়ে যাবে।’

তার ভাষায় তরুণ বেকারদের প্রতি পরামর্শ, ছোট হোক বড় হোক কোনো কাজকে ছোট মনে করা বা অসম্মান করা যাবে না। সব কাজকে সম্মান করতে হবে ও সর্বোচ্চ আগ্রহী হয়ে কাজটি করার চেষ্টা করতে হবে।

বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের মতে, জীবনে সফল হতে চাইলে দুটি জিনিস প্রয়োজন ‘জেদ আর আত্মবিশ্বাস’। 

রিয়াদ পাঠানের জন্ম ও বেড়ে উঠা চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের ইসলামপুর গাছতলায়। হাফেজিয়া মাদ্রাসা ঘসিপুর থেকে দাখিল (এসএসসি) পাশ করেন। এখানেই পড়াশোনার অধ্যায় শেষ হয়। চাকরি থেকে ফিরে এসে নানা চড়াই-উতরাই শেষে ব্যবসায় সফল হয়েছেন। অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে পেরে নিচ্ছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। একটা সময় অবহেলা করা বন্ধুটাও এখন নিয়মিত ফেসবুকে তার খোঁজ নেন। কথায় আছে, সফলদের সঙ্গে সবাই থাকেন। তার ব্যবসা একদিন অনেকদূর এগিয়ে যাবে আশাবাদী তার পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।  

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

চাঁদপুর/মাহি   

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়