ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে হরেন্দ্র ঘোষের ইন্দুটি দই

শারমিন জিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১৭ জুন ২০২১  
টাঙ্গাইলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে হরেন্দ্র ঘোষের ইন্দুটি দই

ই-কমার্সের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাঝেও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টাঙ্গাইলের দই। এই অঞ্চলের চমচম সারাদেশের মানুষের কাছে আগের থেকেই জনপ্রিয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের দই সম্পর্কে এখনো তেমন কেউ জানেনা। এই এলাকার চমচমের মতই দইও স্বাদে ও গুণে সেরা।

টাঙ্গাইলের চমচম বিখ্যাত হওয়ার একটি অন্যতম কারন মুখে মুখে এর প্রচার । কিন্তু দই নিয়ে তেমন প্রচার কখনো হয়নি। দই যে টাঙ্গাইলের মিষ্টান্নতে নতুন যোগ হয়নি তার প্রমাণ মেলে ঘোষেদের বাড়ি ঘুরে আসলেই। এই প্রমানের খোঁজেই চলে গেলাম টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার পাশেই ইন্দুটি গ্রামে।

সেখানে দেখা মিলল হরেন্দ্র ঘোষের। যদিও তাদের পারিবারিক টাইটেল ছিলো গোপ। কিন্তু কালক্রমে বর্তমানে ঘোষ উপাধিতেই পরিচিত তারা। তাকে জিজ্ঞেস করেই জানতে পারলাম এই দই তার হাতে গড়া নতুন কোন ব্যবসা নয়। বরঞ্চ তার পূর্ব পুরুষেরাও এই কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। হরেন্দ্র ঘোষের বয়স আনুমানিক ৬০ বছর পিতা ধীরেন্দ্র ঘোষ। পিতার কাছেই তার কাজের হাতে খড়ি ।

হরেন্দ্র ঘোষ জানান, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি দই তৈরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার বাপ দাদারাও বছরের পর বছর ধরে এই কাজ করে আসছে। দই তৈরীর কাজ কত সাল থেকে শুরু হয়েছিলো তার পক্ষে  সঠিক বলা সম্ভব হয়নি । কারন তার পূর্বপুরুষরাও দই তৈরী করতেন। হরেন্দ্র ঘোষের কথায় এটুকু বুঝা যায় যে, বাংলায় মিষ্টি খাওয়ার প্রচলনের শুরু থেকেই এই ঘোষ পরিবারটি দই তৈরী করে আসছে।

দই তৈরীর কাঁচামালের সহজলভ্যতার ব্যপারে  হরেন্দ্র ঘোষ বলেন,‘দই তৈরীর পর্যাপ্ত পরিমান কাঁচামাল, যেমনঃ দুধ, চিনি, জ্বালানি কালিহাতিতে খুবই সহজলভ্য। দইয়ের চাহিদা থাকলে তৈরী করতে আমার কোন সমস্যা হয় না। পরিবারের চার জন এবং একজন কর্মী নিয়ে কাজ করেই আমি প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরন করতে পারি।‘

তিনি আরও বলেন, ‘আমার তৈরি দই প্রতিদিন কালিহাতি উপজেলার বল্লা ইউনিয়নের বল্লা বাজারে নেওয়া হয়। অন্য কোথাও না নিলেও প্রতিদিন তৈরী করা দই শেষ হয় বল্লা বাজারেই।‘

বল্লার লোকেদের থেকে জানা যায় ইন্দুটির দই কালিহাতিতে এমন কি পুরো টাঙ্গাইলের মধ্যেও খুব মজার একটি দই। সকাল ৮ টায় দই নিয়ে ঘোষেরা হাজির হলে ১১ টা থেকে ১২ টার পর সেই দই আর পাওয়া যায় না। চাহিদা থাকায় সকালেই সব দই শেষ হয়ে যায়।

হরেন্দ্র ঘোষ আরও জানান, তিনি প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ হাড়ি দই তৈরী করেন। এই দই আবার ২ সাইজের হাড়ি করা হয় ১ কেজি ও ২ কেজি আবার কখনো কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী। তাছাড়াও বিয়ে,ঈদ, পূজা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় আলাদা অর্ডার আসে, যা তার অতিরিক্ত আয়। এমনকি প্রতি মাসেই এমন অর্ডার গুলো পেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, তার তৈরী দই দেশের কোন কোন এলাকায় গিয়েছে সে ব্যপারে সঠিক হিসেব নেই। তবে অনেক ক্রেতাই দই কেনার সময় বলে আত্মীয়ের বাসায় পাঠাবে। এমন অনেক ক্রেতা আছে যারা দই নিয়ে দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে উপহার পাঠায়।

নরেন্দ্র ঘোষের তৈরি দই দেশের বিভিন্ন এলাকায় গেলেও এই দই এখনো তেমন কোন প্রচার পায়নি। এমনকি ঘোষেরাও চেষ্টা করেনি তেমন কোন প্রচার বা প্রসারের। অল্প বিক্রিতেই টেনেটুনে সংসার  চালাতে পারত বলেই তারা সন্তুষ্ট ছিলেন।

ইন্দুটি গ্রামেই আরও সাত থেকে আটটি পরিবার দই তৈরী করে আসছে অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন জায়গায় তাদের দইয়েরও চাহিদা রয়েছে। এসব দই ইন্দুটি গ্রামে তৈরী হলেও অন্য নামে বাজারে বিক্রি হয়। কেবল মাত্র হরেন্দ্র ও তার বড় ভাই সুভাষ ঘোষের দই ইন্দুটি নামে বিক্রি হয়। বলা চলে কালিহাতি এলাকায় ইন্দুটি একটি ব্রান্ড হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।

শুধুমাত্র কালিহাতির ইন্দুটি নয় বরং টাঙ্গাইলে আরও অনেক দই তৈরি হয়।  যা দেশে মিষ্টান্ন তৈরীর শুরুর দিক থেকেই অনেক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। যেমন টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নের গৌড় ঘোষের দই। তাছাড়া এই অঞ্চলের সদরের জয়কালী ও গোপাল ঘোষের দইও খুব মজার । অনেকেই এসব দইয়ের নামও হয়ত জানে।

করটিয়া ইউনিয়নের ফনিন্দ ঘোষের দইও অনেক জনপ্রিয় টাঙ্গাইল জেলার মানুষের কাছে। এছাড়াও এই অঞ্চলের মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লার মন্টু ঘোষের দইয়ের কথাও রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। টক স্বাদের দইয়ের মধ্যে কালিহাতি থানার আউলিয়াবাদের ঝগরমানের দইও নাম করা।

অন্যরা এই অঞ্চলের দইয়ের ব্যপারে অতটা না জানলেও টাঙ্গাইলের চমচমের মতই এই জেলার মানুষের কাছে দইও জনপ্রিয়। দই ছাড়া চলে না তাদের কোন উৎসব ও পূজা পার্বণ। দই যে কেবল মুখরোচক খাবার তা কিন্তু নয় । দইয়ে আছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গুণ। যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি। যা হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। তাছাড়াও দই ত্বক মসৃণ করে এবং ওজন কমাতে পরিমিত মাত্রায় দই খাওয়া যেতে পারে। দই খাবারে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। খাওয়ার সময় বাঙালির ঘরে শেষ পাতে দই না হলে খাওয়াই যেন অসম্পূর্ণ। তীব্র গরমে দই হজম সহায়কের কাজ করে এবং  শরীরে এনে দেয় আলাদা প্রশান্তি ।

দই সাধারণত হালকা টক স্বাদের আবার কখনো পরোপুরি মিষ্টি হয়। দইয়ের স্বাদ যেরকমই হোক না কেন পুষ্টি গুণ অটুট থাকে। দই তৈরীর প্রসেস দূর থেকে সহজ মনে হলেও কষ্টসাধ্য। সারাদিন আগুনের তাপ থাকে ঘোষেদের বাড়িতে।এদের রান্না ঘরের বাইরে থেকেও তীব্র তাপ অনুভব হয়। ভিতরে তো অসহ্য তাপ বিরাজ করে সবসময়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাশাপাশি চার থেকে পাঁচটি বড়  চুলায় বিশাল আকারের কড়াইতে দইয়ের জন্য দুধ জাল করা হয়। তারপর সেই দুধ হাড়িতে পাতা হয়। হাড়ির নিচে পাটের ছালা/ চট দেওয়া হয়। দইয়ের দুধ হাড়িতে দেওয়ার পরও এই গরমে ঘোষেরা দই নাড়তে থাকে বার বার। রাতে দইয়ের উপর চাপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সকালে হাড়ি খুলে জমে যাওয়া দই পাওয়া যায়। এরপর তা সকালে  হাটে নেওয়া হয় বিক্রির জন্য। তাদের জন্য হাট বাজারই একমাত্র দই বিক্রির স্থান। আবার হোটেল রেস্টুরেন্ট গুলোও এই দই কিনে নেয় বিক্রির জন্য।

নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরের চাহিদা মিটিয়ে ঘোষেরা হয়তো কোন রকম তাদের সংসার চালাতে পারে। কিন্তু এমন ভালো জিনিস গুলো জেলার বাইরেও পরিচিতি পাওয়া দরকার। ভালো ও উপকারী পণ্য গুলো দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছানো উচিত। 

টাঙ্গাইলের দইয়ের প্রচারে ই-কমার্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বগুড়ার দই বাংলাদেশে নামে সেরা হলেও দেশের সর্বত্র  দই তৈরী হয়। বর্তমানে ই-কমার্সে জায়গা করে নিয়েছে বগুড়ার দই। সকলের স্বার্বিক প্রচেষ্টা আর নিজ জেলার উদ্যোক্তারা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে টাঙ্গাইল জেলার দইকেও সারাদেশে পরিচয় করানো সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব দেশের আনাচে কানাচে সব জায়গায়। টাঙ্গাইলের দই তৈরীতে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা ও পর্যাপ্ত জনবল।

এমন কাজে  দেশি পণ্যের একমাত্র প্লাটফর্ম উই ( উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম)   গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারন উই মানেই হচ্ছে ই-কমার্সে দেশি পণ্যের সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরী। অন্যান্য দেশি পণ্যের মতই টাঙ্গাইলের দইও দেশের ৬৪ জেলায় পরিচিত করাতে উইয়ের বিকল্প নেই।

লেখক : স্বত্বাধিকারী, জিয়া'স কালেকশন এবং টাঙ্গাইল জেলা সহপ্রতিনিধি, উই

টাঙ্গাইল/নহরে জান্নাত/সিনথিয়া

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়