ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কোহিনূর : রক্ত, রহস্য এবং দ্বন্দ্বের ইতিহাস

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৩ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোহিনূর : রক্ত, রহস্য এবং দ্বন্দ্বের ইতিহাস

হুমায়ূন শফিক: শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা। সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ। তিনি একবার সাগরপাড়ে বসে সূর্যদেবতার আরাধনা করছিলেন। দেবতা প্রার্থনায় খুশি হয়ে তাকে স্বরূপ দেখালেন। কিন্তু সত্রাজিৎ দেবতাকে ঠিকমতো দেখতে পারছিলেন না। তিনি দেবতাকে বললেন, ‘প্রভু, আকাশে আপনি আগুনের পিণ্ডের ন্যায় হাজির হন। আমার সামনে একইভাবে হাজির হলে এই চক্ষু কি আপনাকে দেখতে পাবে?’

সূর্যদেবতা তখন স্যমন্তক নামে একটি উজ্জ্বল মণি গলায় পরেছিলেন। ভক্তের কথা শুনে তিনি মণিটি খুলে ফেললেন। সত্রাজিৎ তখন তাকে দেখতে পেলেন। সূর্যদেবতার চোখের রং বাদামি হলুদ, শরীর ছোট এবং তামাটে। সত্রাজিৎ মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করলেন। খুশি হয়ে দেবতা তাকে বর চাইতে বললেন। সত্রাজিৎ তখন ওই স্যমন্তকটি চাইলেন এবং পেয়েও গেলেন।

এরপর সত্রাজিৎ গর্ব এবং খুশিতে দ্বারকাবাসীগণকে সেই মণি দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। চারপাশে মণিটির প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। শ্রীকৃষ্ণও সেই মণির কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি যখন স্যমন্তক মণি দেখতে চাইলেন তখন সত্রাজিৎয়ের ভয় হলো। তিনি ভাবলেন, বাসুদেব মণির কথা শুনে প্রলুব্ধ হয়েছেন এবং সেটি অপহরণ করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেখতে চেয়েছেন। ভয়ে ভয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তিনি মণিটি দেখালেন বটে, কিন্তু মনে মনে শ্রীকৃষ্ণের নামে কলঙ্ক রটানোর পরিকল্পনা করলেন। সত্রাজিৎয়ের বাড়ি থেকে যাওয়ার পথে সত্যভামার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ ঘটে। সত্যভামাকে দর্শন করা মাত্র শ্রীকৃষ্ণ পরম প্রীত হন এবং তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে তাকে কামনা করেন। সত্রাজিৎতনয়াও শ্রীকৃষ্ণের বলদৃপ্ত, তেজোদীপ্ত অপূর্ব মনোহর কান্তি দেখে এবং তাকে সুচতুর বাকপটুত্বের সঙ্গে রসালাপ করতে দেখে বিমুগ্ধ হন এবং তাকে পতিরূপে কামনা করেন।

সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন

ওদিকে শ্রীকৃষ্ণ বাড়ি থেকে প্রস্থান করামাত্র সত্রাজিৎ তার ভাই প্রসেনকে স্যমন্তক মণিটি দিয়ে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে বললেন। এরপর তিনি দ্বারকায় প্রচার করে দিলেন, স্যমন্তক মণি অপহৃত হয়েছে এবং দ্বারকেশ্বর দেবকীনন্দন মণিটি দেখে চলে যাওয়ার পরেই মণিটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। একথা শ্রবণমাত্র শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঘটনার প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন। বহু অন্বেষণের পর তিনি এক দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ভল্লুকরাজ জাম্ববানের কাছে স্যমন্তক মণির সন্ধান পেলেন। শ্রীকৃষ্ণ মণিটি তার কাছে প্রার্থনা করলে জাম্ববান দিতে অস্বীকার করলেন। জাম্ববান বললেন, যদি যাদবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ তাকে মল্লযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারে তবেই তিনি মণি দেবেন। শ্রীকৃষ্ণ শর্তে সম্মত হলেন এবং বললেন, যদি জাম্ববান মল্লযুদ্ধে তার কাছে পরাভব স্বীকার করে, তবে স্যমন্তক মণির সঙ্গে জাম্ববানের পরমাসুন্দরী কন্যা জাম্ববতীকেও বাসুদেবের কাছে সমর্পণ করতে হবে। যথানিয়মে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। জাম্ববান বীর হলেও মহাবলবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পারলেন না। ফলে স্যমন্তক মণি এবং জাম্ববতীকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। দ্বারকার পৌর পরিষদে শ্রীকৃষ্ণ যখন সকল কথা বিবৃত করলেন তখন দ্বারকার সকল বিশিষ্ট নাগরিক এই রায় দিলেন যে এই মণি এখন শ্রীকৃষ্ণের, সত্রাজিৎয়ের এর উপর আর কোনো অধিকার নেই। তখন সত্রাজিৎ ভুল স্বীকার করলেন এবং বললেন যে, প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তিনি তার একমাত্র কন্যা সত্যভামাকে শ্রীকৃষ্ণের হাতে প্রদান করবেন। শ্রীকৃষ্ণও মনে মনে তাই চাইছিলেন। তিনি সত্যভামাকে গ্রহণ করলেন কিন্তু স্যমন্তক মণি ফিরিয়ে দিলেন।

দুই.

অনেকের ধারণা এই স্যমন্তক মণি আর কোহিনূর একই। পাঁচ হাজার বছর আগেই পুরাণে এভাবেই কোহিনূরের উল্লেখ ছিল। অনেকে মনে করেন, কাকাতিয়া রাজবংশের দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে কোহিনূর ব্যবহার করা হতো। সবার বিশ্বাস, আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিয়েই কোহিনূর এখনো পৃথিবীবাসীর কাছে ঐতিহাসিক এক রহস্যের নাম।

কোহিনূর হীরার সন্ধান পাওয়া যায় তেরো শতাব্দীতে। গবেষকদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার সন্তোষনগর অঞ্চলের কল্লর খনি থেকে এই হীরা উত্তোলন করা হয়। কোহিনূরের সঙ্গে ‘দরিয়া–ই–নূর’ নামে আরেকটি হীরাও তখন উত্তোলন করা হয়। এটিকে কোহিনূরের যমজ বলা হয়ে থাকে। এর অর্থ ‘পর্বতের আলো’। কোহিনূরের প্রাথমিক ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। কিন্তু ভেনিসের হীরা কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস অদক্ষতার কারণে কোহিনূর কেটে ছোট করে ফেলেন। এর বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট। ১৩০৪ সালে রাজা মালওয়া এই হীরা অধিকরণ করেন। তার আগ পর্যন্ত কেউ এই হীরাকে কোহিনূর নামে ডাকত না। ১৩০৪ সালেই দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির হাতে চলে আসে কোহিনূর। ১৩৩৯ সালে হীরাকে সমরখন্দ শহরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে এটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে অবস্থান করছিল। ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দি লিখনে, যারা হীরাটি পরেন তাদের একটি অভিশাপ দেয়া হয়: ‘এই হীরার যে মালিক হবে সে তার দুভার্গ্য সম্পর্কেও জানতে পারবে। শুধু ঈশ্বর বা কোনো মহিলা পরলে তার উপর কোনো অভিশাপ কাজ করবে না।’  মোগল আমলে এটি সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। যে কারণে মোগল শাসকবৃন্দ কোহিনূরের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। শাসকদের অধিকারে কোহিনূর ২১৩ বছর ছিল। পরে আফগানদের কাছে ৬৬ বছর ও ব্রিটেনের অধিকারে ১৩৪ বছর পার করে হীরকখণ্ডটি। এটি বর্তমানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে।

রানী এলিজাবেথের মুকুটে শোভা পাচ্ছে কোহিনূর

কোহিনূর নামটি মোগলদের দেয়া। ফারসি শব্দ কোহ–ই–নূর শব্দটি থেকে শব্দটির উদ্ভব। পর্তুগিজ চিকিৎসক ও দার্শনিক গার্সিয়া দা ওরতো’র রচনায় কোহিনূর সম্পর্কে বলা হয়েছে। তিনি ১৫৬১ সালে প্রকাশিত ‘কোলোকুইজ অন দ্য সিম্পলস অ্যান্ড ড্রাগস অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ভারতবর্ষের বৃহত্তম হীরা বিজয়নগরে সংরক্ষিত আছে। ধারণা করা হয়, তিনি কোহিনূরের কথাই হয়তো বলেছেন।

‘বাবরনামা’তে কোহিনূর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে বাবর লিখেছেন, গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিতের পরিবারকে গ্রেফতার করার পর তারা হুমায়ূনকে কিছু রত্ন দিয়েছিল। বাবরের প্রশংসাকারীরা বলেন, এই রত্নের মধ্যে থাকা একটি হীরার মূল্য দিয়ে পুরো দুনিয়ার মানুষকে আড়াই দিন খাওয়ানো যাবে। বাবর বর্ণিত এই একটি হীরাই হচ্ছে কোহিনূর। মোগল আমলে এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলা হতো। পানিপথের যুদ্ধের পর বাবরকে কোহিনূর হীরা উপহার দিয়েছিলেন পুত্র হুমায়ূন। হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশা নামদার’ উপন্যাসেও এই ঘটনার উল্লেখ আছে। বাবর বা হুমায়ূন কেউ এ হীরাকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেননি। সম্রাট শাহজাহান এসে প্রথমবারের মতো ময়ূর সিংহাসনের অলঙ্কার হিসেবে কোহিনূর ব্যবহার করেন। পরে পারস্যের নাদির শাহ কোহিনূর লুট করেন। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহর মৃত্যুর পর এটি আফগানিস্তানের আমির আহমদ শাহ দুররানির কাছে ছিল। পরবর্তীতে কোহিনূরের মালিক হন আহমদের বংশধর শাহ সুজা দুররানি। বহু ঘটনা শেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত জয় করলে কোহিনূর চলে যায় ব্রিটেনের রানীর দরবারে। গবেষকরা স্থান বিবেচনায় কোহিনূরের ভ্রমণ পথ চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, কোহিনূর বহু দেশ ও স্থান ভ্রমণ করেছে। কোহিনূর খনিতে তৈরি হয় পাঁচ হাজার বছর আগে, গুল্টারে। তারপর ১৩০৪ সালে এটি মালওয়া, ১৩০৬ সালে অরুগাল্লু, ১৩২৩ সালে দিল্লি, ১৩৩৯ সালে সামরখান্দ, ১৫২৬ সালে দিল্লি, ১৭৩৯ সালে পারস্য, ১৮০০ সালে পাঞ্জাব, ১৮৪৯ সালে লাহোর, ১৮৫০ সালে যুক্তরাজ্য এবং বর্তমানে এটি টাওয়ার অব লন্ডনে রয়েছে।

তিন.

পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে লুটে নেন ময়ূর সিংহাসনসহ এই কোহিনূর। কিন্তু কোহিনূর বেশি দিন ভাগ্যে সইল না তার। আত্মীয়দের হাতে খুন হন নাদির শাহ। হীরা চলে যায় আফগান জেনারেল আহমেদ শাহ দুররানীর কাছে। নাদির শাহর লাশ দেখার সময় কায়দা করে তার সিলটা হাত করেন দুররানী এবং সেই সূত্রে মালিক হন কোহিনূরের। তার মৃত্যুর পর হীরা আসে তার সন্তান তিমুর শাহ-এর কাছে। তিমুরের কাছ হতে জামান শাহর হাত হয়ে কোহিনূর চলে যায় সুজা উল মূলকের কাছে। তিমুর শাহর ছোট সুজা উল মূলক সৎ ভাই মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়ে কাশ্মীরের গভর্নর আতা মুহাম্মদ খানের কাছে বন্দি হন ১৮১১ সালে। কিন্তু পাঞ্জাবের শিখ রাজা রঞ্জিত সিং সুজাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে পরিবারসমেত লাহোর পাঠিয়ে দেন। বদৌলতে সুজা উল মূলক ১৮১৩ সালে রঞ্জিত সিংয়ের হাতে তুলে দেন কোহিনূর। রঞ্জিত সিং মারা যাওয়ার পর হীরার মালিক হন তার ১১ বছরের ছেলে মহারাজ দিলীপ। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করে নেয়। সেই সঙ্গে দিলীপের হাত থেকে কেড়ে নেয় কোহিনূর।

পারস্যের নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসনসহ কোহিনূর লুট করেন

কোহিনূরের অভিশাপ নিয়ে প্রচুর গল্প বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। বলা হয়, যে শাসকের অধীনে এ হীরাটি ছিল সেই হারিয়েছে তার সাম্রাজ্য, ধন–দৌলত। সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রাজা পর্যন্ত, যিনিই এ হীরাটির অধিকারী হয়েছেন তার জীবনে নেমে এসেছে দুর্গতি। সিংহাসনচ্যুত, সংঘাত, রক্তারক্তি, খুনাখুনির ইতিহাস তাই কোহিনূরের সাথে গাঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। কোহিনূরকে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে নেয়ার পথে কম ভোগান্তি হয়নি ব্রিটিশদের। এই ইতিহাসটুকু না বললেই নয়।

১৮৫০ সালের ১২ জানুয়ারি ডালহৌসি কোহিনূর ব্রিটেনে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ৬ এপ্রিল কোহিনূরকে নিয়ে জলপথে রওনা দেয়া হয়। কোহিনূর নেয়া হচ্ছিল ব্রিটেনের রানীর জাহাজ মিডিয়ায়। যাত্রার কদিন পরেই জাহাজে যেন অভিশাপ লাগে। কলেরার মহামারিতে এসময় ১৩৫ জন ক্রু মারা যান। এটাই শেষ নয়। জাহাজটি এরপর ঝড়ের কবলে পড়ে। অনেক বিপত্তি শেষে ৩০ জুন মিডিয়া প্লাইমাউথ বন্দরে পৌঁছে। ওই সময় বিট্রিশ ও অন্যান্য সংবাদপত্রগুলো কোহিনূরের অভিশাপ নিয়ে লিখতে থাকে। ব্রিটেন যাওয়ার পর কোহিনূরের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হয়। সেটি হলো— কোহিনূর কেবল পুরুষ শাসকদেরকেই অভিশাপ দিয়ে থাকে। নারীরা তার অভিশাপ থেকে আনুকূল্য পায়। যার কারণে কোহিনূরের অভিশাপ রানী এলিজাবেথের ক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগেনি। কোহিনূরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— এর ৩৩টি পাশ রয়েছে। এর রং শ্বেতশুভ্র। কোহিনূরকে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাটা হীরা মনে করা হয়। এর বর্তমান মূল্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১২ শ’কোটি টাকা। এটির মালিকানা নিয়ে এখনো দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভারতবাসী মনে করে, ব্রিটিশরা কোহিনূর চুরি করে বা পাচার করে নিয়ে গেছে। ১৯৩৭ সালে আরো ২৮০০টি হীরার সাথে কোহিনূর ব্রিটিশ রাজ মুকুটে যুক্ত করা হয়। বর্তমানে লন্ডন টাওয়ারে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনীর জন্য অন্যান্য বিখ্যাত হীরা ও রত্ন পাথরের সাথে কোহিনূর রাখা আছে।

কোহিনূরের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। এর বড় কারণ হচ্ছে কোহিনূর কখনো বিক্রি হয়নি। কখনো উপহার দেয়া হয়েছে, কখনোবা কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। তারপরও আমরা কিছু ধারণার জন্য পাশাপাশি অন্য বিখ্যাত হীরার সাথে তুলনা করে দেখতে পারি। গ্রাফপিংক হীরা (Graff Pink) যার ওজন ২৫ ক্যারেটের কম, যা কোহিনূর হীরার ৪ ভাগের এক ভাগ। প্রায় ৬০ বছর আগে হংকং-এ হীরাটি বিক্রি হয়েছিল ৪৬ মিলিয়ন ডলার। ৫০ বছর পূর্বেও কোহিনূরের আনুমানিক মূল্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ধারণা করা হচ্ছিল। যদিও ব্রিটিশ রাজ পরিবার কোহিনূরের মূল্য ১০ থেকে ১২.৭০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। আসলে এর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

পাঞ্জাবের শিখ রাজা রঞ্জিত সিং সুজার মণিমুক্তা 

চার

কোহিনূরের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। ভারত, পাকিস্তান, ইরান এবং আফগানিস্তান মনে করে কোহিনূর তাদের। ইংল্যান্ডের কাছে তারা বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছিল এই ব্যাপারে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। ১৮৫০ সালে দিলীপ সিংহ ছিলেন নাবালক। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নাবালক রাজাকে চাপ দিয়ে কোহিনূর ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং সেই যুক্তিতেই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার সময় এবং ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দেও বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় কোহিনূর প্রত্যার্পণের দাবি তুলেছে ভারত। কিন্তু চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তা খারিজ করে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এরপর ২০০০, ২০১০ এবং ২০১৬ সালেও ভারত কোহিনূর ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ইউকে সরকারের কাছে গেলে তারা খারিজ করে দেয়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন বলেছেন, ‘যদি কখনো বিট্রিশ মিউজিয়াম খালি করা লাগে তখনো বলব হীরাটি রেখে দাও।’ ২০১৩ সালে তিনি প্রায় একই কথা বলেন। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান হীরাটির মালিকানা দাবি করে। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইউকের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই দাবি করেন। ২০০০ সালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলেন, ‘কোহিনূর মূলত এবং আইনত আফগানিস্তানের। তাই তিনি ইউকের কাছে কোহিনূর ফেরত চান। কিন্তু বিট্রিশ সরকার সে কথা আমলে নেননি।’

পাঁচ.

কোহিনূর নিয়ে প্রথম সিনেমা বানানো হয় ১৮৬৮ সালে উইল্কি কলিন্স’র উপন্যাস দ্য ‍মুনস্টোন থেকে। এই উপন্যাসকে বলা হয় প্রথম ফুল-লেন্থ গোয়েন্দা উপন্যাস। কলিন্স বলেন, মুনস্টোন হচ্ছে দুটি হীরা নিয়ে লেখা, একটি হচ্ছে ওরলোভ-১৮৯.৬২ ক্যারেট(৩৭.৯ গ্রাম) এবং অন্যটি কোহিনূর। আগাথা ক্রিস্টিও ১৯২৫ সালে সিক্রেট অব চিমনিতে কোহিনূরকে নিয়ে আসেন। কাহিনিটা এমন যে, একটি দেশে হীরা লুকানো আছে, কেউ জানে না কোথায়? উপন্যাসের শেষে যখন জানতে পারবে তখন দেখা যাবে হীরাটা টাওয়ার অব লন্ডন থেকে চুরি করা হয়েছিল। একটি পারসিয়ান গ্যাং অন্য আরেকটা নকল হীরা রেখে কোহিনূর চুরি করেছিল।

এরকম আরো অনেক উপন্যাস ও সিনেমা হয়তো বানানো হয়েছে। বলিউড সিনেমায়ও কোহিনূরের নাম শোনা যায়। হৃতিক রোশানের ‘ব্যাং ব্যাং’ কোহিনূরকে কেন্দ্র করেই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ আগস্ট ২০১৯/তারা/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়