ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘আমি কোন ঘরে থাকবো? আমার তো ঘর নেই’

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:০০, ৭ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আমি কোন ঘরে থাকবো? আমার তো ঘর নেই’

পঞ্চাশ পেরোনো মো. জামসেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ক্ষুদ্র ব্যবসা। সন্দ্বীপের সাতিকাইত এলাকায় বাঁধের ধারে তার ছোট্ট দোকান পরিবারের সাতজন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিল। টিকে থাকার পদক্ষেপ হিসেবে চা-বিস্কিটের দোকানের সঙ্গে যোগ করেছেন হোটেল। ঘাটে ভিড়ত মাছ ধরার নৌকা। ছিল মানুষের আনাগোনা। বেচাকেনা বেশ ভালোই হতো। কিন্তু করোনায় তার দোকান বন্ধ। রোজগার শূন্যে পৌঁছেছে। 

সমগ্র উপকূল অঞ্চলের লাখো কর্মজীবী মানুষের মধ্যে জামসেদ একটা উদাহরণ মাত্র। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে। করোনাভাইরাসের এই কাল তাদের জীবনে এনেছে চরম সংকট। কাজকর্ম বন্ধ। হাজার শ্রমিক বেকার। নি¤œ আয়ের মানুষের অনেকের ঘরেই খাবার ফুরিয়ে গেছে। অনেকেই চলছেন ধারদেনা করে। সংকট নিয়ে কথা বলতেই জামসেদ বলেন, ‘অনেক মহামারির নাম শুনেছি। করোনা মনে হয় একটু বেশি ভয়ের। আতঙ্কে আছি! কখন কী হয়। ধারকর্জ করে কোনোমতে চলছি।’

মনজিলা বেগমের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল সুন্দরবনে কাঁকড়া ও মাছ ধরা এবং চিংড়ির ঘেরে কাজ করা। স্বামী হাসান আলী বাঘের গ্রাসে প্রাণ হারানোর পর সাতক্ষীরার শ্যমনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনীর এই নারী নিজেই জীবিকার পথ খুঁজে নিতে বাধ্য হন। কঠোর পরিশ্রমে চলছিল জীবন। কিন্তু হঠাৎ করোনাভাইরাসের ছোবল যেন জীবনে এনে দিয়েছে স্থবিরতা। ওই এলাকায় রয়েছেন আরও অনেক নি¤œ আয়ের মানুষ; যাদের জীবিকা চলে দৈনন্দিন রোজগারের ওপর ভর করে। মনজিলা, রিজিয়া, আজিজুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন বলছিলেন, ‘এ এলাকায় সরকারি সাহায্য সহযোগিতা খুব একটা আসে না। আর ছিটেফোটা এলেও দশ-কুড়ি কেজি চালে আর ক’দিন চলে? কী হবে আমাদের জানি না।’   
 


স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সুন্দরবনের আশপাশের এলাকার বনজীবীদের অবস্থা শোচনীয়। ওই অঞ্চলে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ রয়েছে; যারা বনভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে। কাজ না করলে তাদের চুলোয় হাঁড়ি ওঠে না। কর্মজীবী নারীর সংখ্যাও অনেক। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জের বুলি দাসী মন্ডলের জীবন এখন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ক’দিন ধরে কোনো কাজকর্ম নেই। হাতে টাকাও নেই। বেশ কয়েক বছর আগে স্বামী অরুণ মন্ডলকে হারানোর পর সংসারের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে। করোনায় কাজ বন্ধ। ঘরে বসেই দিন কাটাচ্ছেন। করোনায় সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার কথা শুনেছেন। তবে পাননি। মুন্সিগঞ্জ বাজারের কাছেই বাগদী পাড়ার অনেকেই সহযোগিতা পাননি বলে জানালেন।

করোনাকালে মধ্য-উপকূলের মানতা জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও চরম সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের যেন দেখার কেউ নেই। উপকূলীয় জেলা বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর অববাহিকায় এদের বসবাস। এই সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে পরিবারসহ নৌকায় বাস করে। এরা সমাজের মূলধারা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। নদীতে মাছ ধরেই চলে জীবিকা। কিন্তু পহেলা মার্চ থেকে এমনিতেই মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। তার ওপর করোনাকালের এই সংকট। ফলে এদের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। এই সম্প্রদায়ের অনেকের নাম নেই ভোটার তালিকায়। আবার অনেকের নাম ভোটার তালিকায় থাকলেও তারা সবসময় অবস্থান করেন এলাকার বাইরে। ফলে সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন।
 


ভালো নেই পূর্ব উপকূলের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী জলদাস সম্প্রদায়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় এই সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে। এই সম্প্রদায়ের অন্তত ৯০ শতাংশ পরিবার দিন আনা দিন খাওয়া। নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরাই এদের প্রধান পেশা। করোনাকালে মাছ ধরা বন্ধ। অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ। ফলে এদের অনেকের পরিবারেই তিনবেলা খাবার যোগার কষ্টকর হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকু-ের বড় কুমিরা জলদাস পাড়ার সরদার কৃষ্ণপদ জলদাস বলেন, ‘দিন আনি দিন খাই। এখন তো সব বন্ধ। কীভাবে চলবো? সরকার কিছু বরাদ্দ দিলেও  আমরা তা চোখেও দেখতে পারি না।’

দ্বীপ জেলা ভোলার সর্বদক্ষিণের উপজেলা চরফ্যাসনের ঢালচরের বাসিন্দা এম এ আবদুর রহমান বিশ^াসের কণ্ঠেও দীর্ঘশ্বাস। জানালেন, নদী ভাঙনের কারণে এখানকার মানুষ দিশেহারা। এখানে ধনী-গরিব বলে কিছু নেই। সকলেই বাড়িঘর, গবাদিপশু, বাড়ির গাছপালাসহ অন্যান্য মালামাল সরিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত। লোকজনে ঘরে রাখতে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় মানুষ কোনো বিকল্প উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক মানুষ প্রশ্ন করছেন, আমি কোন ঘরে থাকবো? আমার তো ঘরই নেই। অনেকে আবার বলছেন, আমার ঘর তো ভাঙনের মুখে, কই যাবো? এখানকার বহু মানুষ ভাঙাচোরা ঘর নিয়ে খোলা আকাশের নিচে কোনো রকম ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন।
 


ঢালচরের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জাটকা মৌসুমে পহেলা মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ। এ কারণে অধিকাংশ মানুষের রোজগার শূন্যে নেমেছে। মাত্র ১০০ পরিবার এ পর্যন্ত সাহায্য পেয়েছে। আরও হয়তো কিছুসংখ্যক পরিবার সাহায্য পাবে। তবে বাস্তব অবস্থার আলোকে এখানে সকল পরিবারকেই সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন। সংকটের এই সময়ে গোটা ঢালচরের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের দাবি উঠেছে; তা না হলে সেখানকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

একই চিত্র পাওয়া যায় পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর দ্বীপ-চরগুলোতে। করোনা নিয়ে বিশেষ সচেতনতা চোখে পড়ে না। শহরের খোঁজ রাখেন; এমন কিছু মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত থাকলেও অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা তিনবেলা খাবার। মাছ ধরা, কৃষিকাজ, বন্দরে মালামাল ওঠানামা, লঞ্চঘাট-খেয়াঘাটে কাজ, পণ্য পরিবহন, লঞ্চ-বাসে পরিবহন শ্রমিক হিসেবে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজ বন্ধ। উপকূলীয় গ্রামীণ ব্যবসা-বাণিজ্যও প্রায় অচল। ফলে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকে ধারদেনা করে চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে আর ক’দিন পারবেন কেউই জানেন না।

 


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়