ঢাকা     মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

পাঁচশতম প্রয়াণবর্ষে দ্য ভিঞ্চি

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ৬ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাঁচশতম প্রয়াণবর্ষে দ্য ভিঞ্চি

তপন চক্রবর্তী: বিগত ২ মে ১৫ শতকের ইতালিয় তথা ইউরোপিয় রেনেসাঁর অগ্রদূত বহুমুখী প্রতিভাধর প্রাতঃস্মরণীয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র (১৫ এপ্রিল ১৪৪২- ২ মে ১৫১৯) পাঁচশতম প্রয়াণ দিবস অতিবাহিত হলো। পৃথিবীতে সভ্য সমাজ ও সভ্য মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন হোমার, ভার্জিল, দাঁতে, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল, নিউটন, গ্যালিলিও, ব্রুনো, আর্কেমিডিস, শেক্সপিয়র, রোমা রোলাঁ, টলস্টয়, আইনস্টাইনসহ আরো অনেক মনীষীকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কারণ এঁরা সভ্যতার মাইলফলক। সেইসঙ্গে এঁরা বাতিঘর। মানুষের চলার পথে এঁরা মানুষকে নূতন নূতন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এঁদের সকলে বহুমুখী অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এঁরা ‘সাথে করে এনেছিলেন মৃত্যুহীন প্রাণ’।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে মানুষ ‘মোনালিসা’, ‘ইসাবেলা’, ‘স্যালভেটর মুন্ডি’সহ বহু অনন্য চিত্রের স্রষ্টা হিসেবেই জানে। পৃথিবীর ব্যাপক জনসাধারণের কাছে তিনি আজো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। অথচ তিনি একজন অঙ্কনশিল্পী, ভাস্কর, স্থাপত্যবিদ, বিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, অঙ্কশাস্ত্রবিদ, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, শারীরস্থানবিদ, ভূবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও প্রতিমাশিল্পী। তাঁকে অনেকে পুরাতত্ত্ববিজ্ঞান ও জীবাশ্মবিজ্ঞানের জনক বলেও মনে করেন। তাঁকে প্যারাস্যুট, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কের উদ্ভাবক বলা হয়। সার্বিকভাবে তাঁকে মানব আদর্শ পুনর্জাগরণের প্রতিনিধিরূপে চিহ্নিত করা যায়। শিল্প ইতিহাসবিদ হেলেন গার্ডনারের মতে, ‘লিওনার্দোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ এবং প্রতি বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ইতিহাসে তাঁর আগে কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তাঁর মনন ও ব্যক্তিত্ব মনে হয় অতিমানবিক। যদিও মানুষটির জীবন রহস্যাবৃত ও মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

লিওনার্দো ফ্লোরেন্সের ভিঞ্চিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আদালতের নোটারি পিওরো দ্য ভিঞ্চি ও মাতা কৃষক কন্যা ক্যাটেরিনার সন্তান। সন্তান হওয়ার আগে মা-বাবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। তিনি ফ্লোরেন্সের চিত্রশিল্পী অ্যানড্রিয়া ডেল ভেরেচ্চিওর স্টুডিওতে পড়াশোনা করেন। তাঁর ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় মিলানের রাজপুত্র লুডোভিকোর ফরমাশ খাটায় ব্যয়িত হয়।  রাজপুত্র শিল্পরসিক ছিলেন। পরে তিনি রোমের বোলোগনা ও ভেনিসে কাজ করেন।  ফ্রান্সের ফ্রান্সিস ১-এর পুরস্কার হিসেবে প্রদত্ত ফ্রান্সেরই এক ঘরে তিনি জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন।

আলোচনার শুরুতে বলেছি তিনি মুখ্যত চিত্রশিল্পী হিসেবেই বিশ্বখ্যাত। ‘মোনালিসা’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অননুকরণীয় শিল্পকর্ম। এটি পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত শিল্পকর্ম। তাঁর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় চিত্রকর্ম হলো ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ( শিষ্যদের সঙ্গে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের রাতে যিশুর নৈশভোজে অংশগ্রহণের দৃশ্য)। যিশু খ্রিষ্টের পুনরুজ্জীবন নিয়ে অঙ্কিত চিত্র ‘স্যালভেটর মুন্ডি’ ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর নিলামে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ৪৫০.৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া তিনি পৃথিবীর পরবর্তী প্রজন্মসমূহের জন্য বহু শিল্পকর্ম, স্কেচ ও বিজ্ঞান বিষয়ক চিত্রকর্ম রেখে গেছেন।

লিওনার্দোকে শুধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে নয়, তাঁকে প্রযুক্তি উদ্ভাবনার শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবেও গণ্য করা হয়। বিশ শতকে অরবিল ও উইলবার বা রাইট ব্রাদার্সের আকাশে ওড়ার প্রায় ৫০০ বছর আগে তিনি উড্ডয়ন মেশিনের নকশা তৈরি করেছিলেন। বিশ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কের অনুরূপ যুদ্ধযানের পরিকল্পনাও তিনি করেছিলেন। এর চেয়েও বিস্ময়কর তিনি সৌরশক্তি ব্যবহারেরও যন্ত্র নির্মাণ করেছিলেন। ইউরোপিয় রেনেসাঁকালে ধাতুবিদ্যা ও প্রকৌশলের শৈশব মাত্র। তিনি সেই সময়ে তুলনামূলকভাবে আধুনিক নকশা নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি অনেক ছোটখাট আবশ্যকীয় যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন যা ভিঞ্চি মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। তিনি শরীরস্থানবিদ্যা, সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং, ভূবিজ্ঞান, চক্ষুবিদ্যা ও তরল পদার্থের গতিসহ অনেক বিষয়ে অবদান রেখেছেন যা জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। 

এই মহা জীবন গণ্ডুষে পান করার নয়। লিওনার্দোর জীবন ও কর্ম নিয়ে শত শত গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে, হচ্ছে ও হবে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে ও হবে। তাঁর কর্মকাণ্ড ব্যক্ত করার জন্য যে ধরনের পাণ্ডিত্য ও প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয় এর কোনোটিই আমার নেই। যেহেতু তিনি আমাদের আহ্নিক ও বার্ষিক জীবনে এখনো প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক, সেহেতু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁকে তুলে ধরা আবশ্যক বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ নিয়েছি। কারণ তিনি মর্ত্যলোকের অমর্ত্য মানব।

লেখক: লেখক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়