ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘ভয়ঙ্কর সুন্দরে’ যাই মধু আহরণে

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ১৩ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৫:৫২, ১৩ জুন ২০২৩
‘ভয়ঙ্কর সুন্দরে’ যাই মধু আহরণে

মৌয়ালদের সঙ্গে লেখক

দ্বিতীয় পর্ব : মধু ও মৌয়াল পর্ব

মৌয়াল সুবোধদার কাছে গল্প শুনছিলাম- হরিণ এক লাফে যায় তেইশ হাত। আর বাঘ যায় এক লাফে বাইশ হাত। তাহলে অঙ্কের হিসাবে বাঘ কখনও হরিণকে ধরার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। বাঘের হাতে হরিণকে কাবু হতে হয়- কারণটা কী?

কারণ হলো হরিণ লাফাতে লাফাতে কখনও কখনও পেছন ফিরে তাকায়। বাঘের চাইতে সে কতোটা এগিয়ে আছে বোঝার জন্য। আর এটাই হয় সর্বনাশের মূল কারণ। পেছন ফিরতে গিয়ে এক লাফ কমলেই তেইশ হাত পিছনে চলে আসে। তাই চলার পথে কখনও পেছনে তাকাতে নেই। ভুলভ্রান্তি যাই থাকুক চোখ বন্ধ করে সামনে এগিয়ে যাবার নামই হচ্ছে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছানো। 

দাদারা মধু কাটতে গিয়ে অথবা সুন্দরবনে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় কত গল্প বলেন; আমি তাদের কাছে গল্পের ছলে জীবন শিখি! তিনি আরও বলেন, মধু নিয়ে কাজ কেবলই আমার ও মৌয়ালদের ব্যবসা নয়। এখানে আছে সংগ্রাম আর জীবনের নানা বাঁকের গল্প। 

মধু তো খাই কিন্তু মধু যিনি আহরণ করেন সেই মৌয়ালের কথা জানি আমরা? মৌয়াল জীবনের গল্প যে জীবনের গল্প সাধারণ অথচ অসাধারণ! গল্পগুলো সত্যি। আমি যা জেনেছি এই মানুষগুলোর সঙ্গে এতোটা সময় অতিবাহিত করে। “Seven Wonders of Commonwealth” এ জায়গা করে নেয়া এই মধু সংগ্রহের বিষয়টা আসলে এত সোজা না। প্রায় ৭০০ বছর ধরে সুন্দরবনে মৌয়ালদের বসবাস। আর এই ৭০০ বছরে ‘মামা’র সংখ্যা কমলেও, মধু সংগ্রহের সিস্টেমে একটুও পরিবর্তন আসে নাই। ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ তকমাটা শুধুই সুন্দরবনের অধিকার। শ্যামনগর নেমে সুন্দরবনকে সুন্দরবন বলা যাবে না। কিন্তু কেনো? স্থানীয়দের ভাষায় সুন্দরবন হচ্ছে ‘ব্যাদাবন’ বা ‘প্যারাবন’। তারা বাদাবন বলেই অভ্যস্ত!

মধুর চাক হাতে লেখকের কন্যা 

‘বাংলাদেশের ফুসফুস’ সুন্দরবন। সুন্দরবনের উৎপাদনের মূল কেন্দ্রবিন্দু মধু। দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত মোট মধুর ২০ শতাংশ সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু খলিশা ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।

আশেপাশের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস এই সুন্দরবন। এর একটা হচ্ছে বন থেকে মধু সংগ্রহ করা। যারা এই কাজের সাথে যুক্ত তাদের বলা হয় ‘মৌয়াল’। মৌয়ালদের বিচিত্র জীবনধারা খুবই ইন্টারেস্টিং। মধু সংগ্রহের মৌসুমে এরা নানা রকম নিয়ম মেনে চলেন। এ সময় যেহেতু বাড়ির পুরুষেরা বনে থাকেন তাই বাড়ির নারীদের নানান নিয়ম পালন করতে হয়। তারা এ সময় বাড়ির বাইরে খুব একটা দূরের এলাকায় যান না। নারীরা এ সময় মাথায় তেল-সাবান ব্যবহার করেন না। দুপুরবেলা কোনোভাবেই চুলায় আগুন জ্বালান না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বাড়িতে এ সময় আগুন ধরালে বন এবং মধুর চাকের ক্ষতি হবে। মধু কাটার মাসে মৌয়ালরা কারো সাথে ঝগড়া বিবাদও করেন না। মধু সংগ্রহের কাজটা কেবল যে মধু সংগ্রহেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, এর আগে ও পরে বেশ কিছু ঝামেলা পোহাতে হয় মৌয়ালদের। 

একদিকে বন বিভাগের অনুমতি, অন্যদিকে বন-দস্যুদের খপ্পর। তবে সবচেয়ে বড আতঙ্ক হলো ‘মামা’। স্থানীয়রা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকেই মামা ডাকে। প্রতিবছর প্রায় ৮০ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ হারান। এদিকের বেশির ভাগ মৌয়াল মুসলীম হলেও প্রচুর মৌয়াল রয়েছে যারা হিন্দু এবং তাদের রয়েছে নিজস্ব দেব-দেবী। ‘বনবিবি’ হলো তাদের প্রধান দেবী। দক্ষিণরায়ের মূর্তিতেও তাঁকে দেখা যায় বাঘের পিঠে বসা অবস্থায়। এছাড়াও আছে নারায়ণী, বিশালক্ষী, কালুরায়সহ আরও অনেক দেব-দেবী। এইসব দেব-দেবীর আশীর্বাদের পরেও বাঘের হাতে প্রাণ হারানোকে মৌয়ালরা এই ২০২৩ সালে এসেও নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে। তাদের মতে যখন তাদের হায়াত শেষ হয়ে যায় তখনই তারা বাঘের কবলে পড়ে।

জীবন বাজী রেখে বনের গহীনে মৌয়ালদের কার্যক্রম

লঞ্চে পিকনিক করতে গিয়ে যে সুন্দরবন দেখছেন, মধু সেখানে পাওয়া যায় না। যে সুন্দরবনে মধু আছে, সেটা ভয়ঙ্কর সুন্দর! কারণ তা বিপজ্জনক। সুন্দরবনে মধুর মৌসুম চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। মধু সংগ্রহের জন্য প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে তিন মাসের (এপ্রিল, মে ও জুন) জন্য বন বিভাগ মৌয়ালদের অনুমতিপত্র দেয়। সময় নষ্ট না করে শুরুর দিন থেকেই মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌয়ালরা। এ সময় খলিশার মধু বেশি পাওয়া যায় যেটা “পদ্ম মধু” নামে পরিচিত। তারপর গেওয়ার মধু এবং এর কিছুদিন পর বাইন, কেওড়ার মধু পাওয় যায়। 

সুন্দরবনের অনেক গাছপালার ভিড়ে ছোট থেকে মাঝারি গড়নের একটি গাছ হলো খলিশা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Algeciras corniculatum এটি গুল্ম বা ছোট বৃক্ষজাতীয় প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। প্রায় ৫-৭ মিটার পর্যন্ত বাড়ে। সুন্দরবনে খলিশা সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না। খলিশা ফুল ফুটলে সারা দিন মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য ভিড় করে। বহুদূর থেকে সৌরভ পেয়ে মৌমাছি, প্রজাপতি ছুটে আসে। সুন্দরবনের প্রজাপতিরও পছন্দের ফুল এটি। বিরল এই উদ্ভিদ সাধারণত সুন্দরবনে বিচ্ছিন্নভাবে জন্মে। সমষ্টিগতভাবে থাকে না। প্রচুর আলো পড়ে এমন পরিবেশে ভালো জন্মে। বনের অন্ধকার এলাকায় জন্মে না। লবণাক্ততার মাত্রা যেখানে বেশি সেখানে এরা ভালো থাকে। এটি ভারত, বাংলাদেশ, নিউগিনি, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ চীনসহ নানা দেশে জন্মে।

ফল দেখতে কিছুটা মটরশুঁটির মতো। লম্বায় প্রায় ৫-৮ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ফলে একটি বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা গজায়। খলিশার পাতা বিভিন্ন প্রজাতির মথ, ক্যাটারপিলারের খাবার। আদিবাসী কোনো কোনো গোত্রের লোকেরা পাতা কাঁচা বা তরকারি হিসেবে খায়। সিঙ্গাপুরের আদিবাসী মেয়েরা খোঁপায় খলিশা ফুল গুঁজে রাখে। একটা মজার তথ্য দেই- দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটা মৌ-পোকা মারলে ৫০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। যদিও এসব আইনের কথা মৌয়ালদের কাছে একেবারেই অজানা।

নারী মৌয়াল শ্রীমতি ঠাকুমা

মৌয়াল দলের প্রধানকে বলা হয় ‘সাজুনী’। জঙ্গলে যেতে হবে এই ভদ্রলোকের অনুমতি নিয়ে। সেই দলনেতা। নৈতিক অনৈতিক বিভিন্ন উপায়ে অসংখ্য মানুষ মধু সংগ্রহে নামে। ৭-৯ জনের নৌকার ফি দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। একটি সিঙ্গেল পাস এবং একটি BLC (Boat license certificate) পাস নিতে হবে। এ জন্য চেয়ারম্যান থেকে ছবি, জন্ম-নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র এসব কিছুর সত্যায়িত কপি লাগবে। এগুলো জোগাড়ও কম খাটনির কথা নয়।

দলের সবাই সাজুনীর নেতৃত্বে আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মৌমাছির গতিপথ দেখে বনের কিনারে নৌকা রেখে বনের ভেতর চাকের সন্ধান করে। চাক খোঁজার সময় মৌয়ালদের দৃষ্টি উপরের দিকে থাকে বলে মৌয়ালরাই বাঘের আক্রমণের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। মৌচাক পাওয়া মাত্র আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করে বাকিদের জানিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া মামাকে দূরে রাখারও একটা কৌশল এই চিৎকার।

একটি বড় মৌমাছির চাকে অন্তত ১০০ পাউন্ড মধু জমা হয়। এমন একটি চাক ঘিরে থাকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মৌমাছি। এদের একেকটি লম্বায় প্রায় আধা ইঞ্চি। মধু সংগ্রহ সবার কাজ নয়, অল্প কয়েকজনের পক্ষেই কাজটা সম্ভব। মধুর (মৌমাছির) চাক কোথায় আছে, তা বোঝার জন্য বায়ুর দিক, মৌমাছির ওড়াওড়ি এবং গাছের পাতায় তাদের পুরীষ কী পরিমাণে জমেছে, তা খেয়াল করা হয়। যেখানে পুরুষ মৌমাছির পরিমাণ বেশি, বুঝতে হবে তার আশপাশেই কোথাও আছে মধুভাণ্ড। এরপর জঙ্গলে নেমে খোঁজা হয় কোন গাছে জমেছে সেই চাক। কোনো গাছের মগডালে হয়তো হাজারো মৌমাছি ঘিরে রেখেছে কোনো চাক। এত সহজে তাদের কাছে যাওয়া যায় না। 

মধু সংগ্রহের সময়ও মৌয়ালরা বেশ কিছু নিয়ম পালন করে। প্রথমে মুখ ও শরীরের খালি অংশ গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হয়। এরপর লাঠির আগায় বাঁধা গাছের পাতায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তাতে ধোঁয়া ওঠে। সেই ধোঁয়ায় মৌমাছিরা সরে যেতে থাকে। অন্য কোনো মৌয়াল তখন চাক কাটতে শুরু করে। সবার মধ্যেই একটা তাড়া কাজ করে তখন। একজন মৌয়াল সে সময় ষাঁড়ের শিঙায় ফুঁ দিতে থাকে। এতে বাঘ তাড়ানো  সহজ হয়। এর মধ্যেই চাক কাটা শেষ হয়ে যায়। বাঁশের ঝুড়িতে এগুলো সংগ্রহ করা হয়। 

তবে হ্যাঁ কেউই ৭৫ কেজির অধিক মধু সংগ্রহ করবে না, কেবল এই শর্তে তাদের অনুমতি দেয়া হয়। BLC দেয়া হয় সাজুনীকে। বনবিভাগই ঠিক করে দেয় কোন দল কোন অংশে মধু সংগ্রহে যাবে। প্রতি ২০ কেজির অধিক মধু স্থানান্তরেও লাগে ট্রানজিট পারমিট।

মধু সংগ্রহের পথে। ইনসেটে খলিশা ফুল

গহীন অরণ্যে মধু সংগ্রহের বিষয়টি আর দশটা টুরিস্ট স্পট ভ্রমণের মতো নয়। এই এক্সপেরিয়েন্সের প্রতিটি পরতে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। মোটরচালিত নৌকায় আট-দশ জনের একটা দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে যেতে হবে বনের ভেতরে। নৌকা থেকে নামতেই পা হয়ত চলে যাবে এক হাত কাদার ভেতরে, ঘন শ্বাসমূলে ভরা কাদামাখা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে কিন্তু চোখ থাকবে গাছে গাছে, হয়ত কোথাও বুক সমান পানি, গন্তব্যের ঠিক নাই।

কিন্তু এত কষ্টের পরেও মৌমাছিবিহীন চাক থেকে ঝরঝর করে মধু ঝরে পরার দৃশ্যের থ্রিল আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব না। কখনো বাঘ, কখনো জলদস্যু, কখনো ঝুম বৃষ্টি; এই থ্রিল, অস্বাভাবিক সুন্দরের মধ্যে এই ভয় শুধু নিজে সেখানে থেকে অনুভব করা যায়। 

পড়ুন প্রথম পর্ব: ‘বাংলার ফুসফুস’ সুন্দরবন এক বিস্ময়ের নাম 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়