ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

করো কাছে তিনি ‘দেবী’, কারো কাছে ‘পিরানী’

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ২৩ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৬:৫০, ২৩ জুন ২০২৩
করো কাছে তিনি ‘দেবী’, কারো কাছে ‘পিরানী’

তৃতীয় পর্ব : সম্প্রীতির নাম বনবিবি 

পৌষের ৩০  তারিখ। প্রস্তুতি চলছে। কাকুতি মণ্ডল প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাঘের ১ তারিখ বনবিবির পুজোয় পুঁথি পাঠ করতে হবে। গত ৩৫ বছর ধরে তিনি পুঁথি পাঠ করে আসছেন। আমাদের বিগলিত হয়ে জানালেন এই পুজো কেবল হিঁদুর নয়, এই পুজো মুসলমানেরও। তিনি কলকাতা থেকে সেই প্রাচীন আমলের পুঁথি বের করে এনে আমাদের অগ্রীম শোনালেন কোথায় আল্লাহ-রসুলের নাম আছে। হামদ-নাত আছে। 
‘অদ্য কশ মোহম্মদের বাণী
মোহম্মদের কলেমা দিয়ে
বিষ করলাম পানি
পদ্মার সাথে বিশ ভাটি দিয়ে যা।’ 

যাহোক বুঝতে পারলাম এই পুজো হয় আসলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। বনদেবীকে তুষ্ট করবার জন্যই বনবিবির পালা পাঠ ও পুজো বা উৎসবের আয়োজন। বনবিবির পুজো করতে হয় উল্টো করে পুঁথি পড়ে। বনবিবির পুজোয় পুরোহিত নেয়ার চল নেই। 

‘বনবিবি’। সুন্দরবনজীবীদের কাছে পূজিত এক নারীশক্তি। বনজীবী বিশ্বাসী জেলে, বাওয়ালি আর মৌয়ালদের সুরক্ষার দেবী। এই সুরক্ষা বনের বাঘ এবং বাঘরূপী অপশক্তি ‘দক্ষিণ রায়’ বা ‘রায়মণির’ হাত থেকে। যেমনটি পেয়েছিল সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ শিশুচরিত্র দুঃখে, বহু শত বছর আগে। 

বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ এই অঞ্চলের যেসব স্থানে বনবিবির পূজা হয়, তার মধ্যে অন্যতম খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নের সুন্দরবনসংলগ্ন ঢ্যাংমারী গ্রাম। একটি খাল দিয়ে গ্রাম আর বনের সীমানা। বনবিবি, গাজী পীর, বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়, বনদেবী নারায়ণী, সন্তান রক্ষক পাঁচু ঠাকুর ও পেঁচো-পেঁচি, কুমির দেবতা কালু রায়, বাদাবনের রক্ষক আটেশ্বর, জ্বরনাশক জ্বরাসুর, সর্পদেবী মনসা, জঙ্গল জননী বিশালাক্ষী, ভাঙ্গড় পীর, গ্রামজননী বিবি মা, পশুরক্ষক মানিক পীর, মাছের দেবতা মাকাল ঠাকুর। এমন সব ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্রের রাজদরবার সুন্দরবন। কাজেই মানুষ রোগ-শোক-জ্বরা-আততায়ীর হাত থেকে বাঁচতে অহর্নিশি জপ করে এদের নাম।   

প্রতিমার কারিগর পরেশ মণ্ডল 

বনদেবী, বনবিবি, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী নানা নামে পরিচিত তিনি। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী। তাকে বলা হয় সুন্দরবনের রক্ষাকর্তী। মৌয়াল, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের ৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় মা বনবিবির পূজা। 

এই ঢ্যাংমারী গ্রামের পরশ মন্ডল মা বনবিবির প্রতিমা প্রতিষ্ঠাতা । এখন অবশ্য অনেকেই এই প্রতিমা প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন। বর্তমানে পুজোর আয়োজন করছেন শ্রীপতি, অশোক, ভবনাথ ,অনিমার মতো অনেকেই। শ্রী পদ্মা মণ্ডল বলেন, ‘বনবিবি হচ্ছেন জঙ্গলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আঠারো ভাটির মালিক। জোয়ার শুরুর পরে ভাটা শেষে ফের নদীতে জোয়ার লাগা মানে হলো- এক ভাটি। কথিত আছে, আঠারো ভাটির সময়ে কেউ যদি জঙ্গলে গিয়ে মাছ, কাঁকড়া ধরে কিংবা মধু-কাঠ ভাঙে, তা হলে তাকে দক্ষিণরায়ের হাত থেকে রক্ষা করেন স্বয়ং দেবী। বহু বছর হচ্ছে এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে মানুষ জঙ্গলে যায়।

পুজোর দিন সকালে সাজসাজ রব পড়ে গেলো। আমরা অতিথি। আমাদের সম্মানে আরও চমৎকার করে সাজিয়েছে শ্রীপতিদের বাড়ির পুজো। প্রাণেশরা সবাই মিলে ডাকতে চলে এলো মাকে প্রতিষ্ঠার আগেই। সন্তোষদা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন লোকায়ত বনবিবির গান বা পুঁথির মানে। জঙ্গলে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হলে খাওয়া-দাওয়া তো করতে হবে। সে জন্য গ্রামের অল্পবয়সী কোনও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যান মৎস্যজীবীরা। সেই ছেলে বিপদে পড়লে গেয়ে ওঠে: 

‘কাঁচা কাষ্ঠ, ফাটা হাঁড়ি/ কেমনে ভাত রাঁধব আমি/ বনবিবি মা, আমায় উপায় বল না...।’ ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়লে মাঝিমাল্লার গেয়ে ওঠে, ‘ঈশাণ কোণে করেছে ডাকছে শোঁ শোঁ শোঁ/ পাল ছিঁড়ে যায় নৌকো মোদের ডোবে বুঝি ওই...।’

বেলা পড়ে আসছিল। জল-জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলো মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে, জোড় হাতে বুঁদ হয়েছিলেন দেবীর সামনে। সহায়সম্বলহীন মানুষগুলোর কাছে জঙ্গলের গভীরে বনবিবির প্রতি বিশ্বাস আর আকুতিটুকুই বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল যে!

পুজো মণ্ডপ থেকে ফিরতি পথে তখনও কানে ভেসে আসছিল, ‘বাবা দুখেরে, বারবার যাচ্ছিস কীসের দায়ে/ আমি ভাঙা ঘরে কষ্ট করি, যাদুধন তোর আশায়...।’ 
দক্ষিণরায়ের খাস তালুকে ছেলে গেলে এই গানই গেয়ে ওঠেন মা, ফিরে না আসা পর্যন্ত বাকি দিনগুলো কাটে দুর্ভাবনায়। আর বনবিবির পুজোর গান গেয়ে বুকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করেন নিজেকেই।

ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মনোবাসনা পূর্ণ করতে মান্নত করেন। এবং মৌয়াল, বাওয়ালগণ বনে যাবার প্রস্তুতি হিসেবেও এই পুজোকে এক অন্যরকম মাত্রা দিয়ে থাকেন। এই পুজোর দিন শুভ দিন। অশোকদা জানালেন যে তারা পুজোর আগের ও পর দিন কোনো শুভ কাজ রাখেন না। এমনকি তারা আমিষও খান না। 
এছাড়াও দিনভর বনবিবি পূজা উপলক্ষে মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, মিষ্টি, ধুপ, ধুনো, খেলনা, চা বিস্কুট, শাখার দোকানসহ নানা ধরনের দোকান দিয়ে গ্রামীণ মেলা বসে সর্বত্র। হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত গ্রামের মেঠোপথ। পূজা উপলক্ষে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও নদীতে নৌ ভ্রমণে বের হন। আমরাও বের হয়েছিলাম। নদীর পরতে পরতে সেদিন কেবল উৎসবের ছোঁয়া লেগে আছে যেনো। 

অনির্বাণদা বলছিলেন, জন্মের পর থেকে আমরা মা বনবিবি’র পূজা করছি। এ পূজা করলে সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর বাঘ, কুমির, সাপসহ বিভিন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন মা বনবিবি। বনের পাশের মানুষদের রক্ষা করেন বনবিবি। এ অঞ্চলে ১৮৯৬ সাল থেকে বনবিবির পূজা হয়।

ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আরব এক ফকির পরিবারে জন্ম নেন বনবিবি। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, মতান্তরে বেরাহিম, মায়ের নাম গুলান বিবি। কথিত আছে, ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনো সন্তান না হওয়ায় চিন্তিত ছিলেন তারা। পরবর্তীতে ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবি মতান্তরে গোলালবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি মনোবাসনা অবশ্যই তাকে পূরণ করতে হবে।

গুলানবিবি গর্ভধারণ করলে ফুলবিবি হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। তার সেই জমিয়ে রাখা ইচ্ছে পূরণের শর্ত এবার সে আদায় করে নেয় গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে সেই জঙ্গলেই গুলানবিবির ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি বা শাহ জঙ্গুলি। শাহাজঙ্গুলি বনবিবির ছোটভাই নাকি যমজ ভাই, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তাদের দেখাশোনার জন্য নাকি স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার দাসীকে। বনবিবি সেখানে বড় হয় এক মাদী হরিণের কাছে। সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবিকে দুই শিশু সন্তানসহ মক্কাতে ফিরিয়ে নিতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সাথে তার এমন হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের ছেড়ে বাবার হাত থেকে চলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বোনের টানে বনবিবির সাথেই জঙ্গলে রয়ে যায় শাহাজঙ্গুলি।

অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি। এখানেই জন্ম হয় বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলী দুই ভাইবোনের। এই দুই সন্তানের জন্মের পরে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ইব্রাহীম পরিবার। ‘বনবিবির কেরামতি’ বা ‘বনবিবির জহুরনামা’ নামক গ্রন্থে বনবিবির এমনি আরও অসংখ্য গল্পের কথা বর্ণিত আছে। বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি খুঁজে পায় দুটি জাদুর টুপি। এই জাদুর টুপিতে চেপে তারা ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্তানের আঠারো ভাটির দেশে। অন্য একটি মতানুসারে হযরত জিবরাঈল (আ.) তাদের আঠারোটি দেশ ঘুরিয়ে দেখান। হিন্দুস্তানে পৌঁছে আযান দেন শাহাজঙ্গুলি।

বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি যখন সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিল নিষ্ঠুরতার প্রতীক দক্ষিণ রায় বা রায়মণি। শাহাজঙ্গুলির সেই আযানের ধ্বনি কানে যায় দক্ষিণ রায়ের। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠান রাজা। সনাতন এসে দুই ভাইবোনের কথা জানালে নিজ সাম্রাজ্য থেকে তাদের উৎখাত করতে উদ্যত হয় দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায় নিজে যুদ্ধের ময়দানে যেতে চাইলে তার মা নারায়ণী তাকে থামিয়ে দেন। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বনবিবি আর শাহাজঙ্গুলির সাথে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা। কাজেই দীর্ঘযুদ্ধের পরে হার মানতে বাধ্য হয় নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে দয়াপরবশ হয়ে বনবিবি তার অর্জিত সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে নারায়ণী ও তার পুত্রকে। নারায়ণীর সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় বনবিবি, দক্ষিণ রায় রাজত্ব করে জঙ্গলের গহীন কোণে।

কাকতি মণ্ডলের সঙ্গে লেখক 

বনবিবিকে নিয়ে শুরুর দিকে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে বায়ানুদ্দিন আর মোহাম্মদ খাতের অধিক জনপ্রিয়। তাদের দুজনের লেখায় বেশ মিলও পাওয়া গেছে। কবিতা বা গল্পগাথাগুলোয় দুটি প্রধান কাহিনী উঠে এসেছে, রাজা দক্ষিণ রায়ের সাথে বনবিবির যুদ্ধ এবং দুখের সাথে তার দেখা হওয়ার ঘটনা। 

২০০৪ সালে অমিতাভ ঘোষ তার ‘দ্য হাংগ্রি টাইড’ নামক পরিবেশবাদী উপন্যাসে এই ঘটনা দুটিকে ‘দুখে’স রিডাম্পশন’ বা ‘দুখের মুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ক্বেরাতুল হায়দার এক পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন বনবিবি আর কেউ নন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর কন্যা ফাতিমা (রা)! তবে এই কথার কোনো প্রমাণ নেই। জঙ্গলে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের মুখে মুখে তিনি বনের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাকারী বনবিবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

নদী ভ্রমণে যেতে যেতে হিমাংশুদা বনবিবির পুঁথির গল্প করলেন আমাদের কাছে। তার ভাষায় ‘কথিত আছে বহু বছর আগে সুন্দরবনের পাশের বাজিরহাটি নামক এক গ্রামে এক দরিদ্র মায়ের সাথে তার শিশু থাকত। শিশু ছেলেটির নাম ছিল দুঃখে। তাদের প্রতিবেশী ছিলো দুই মৌয়াল ভাই ধোনা আর মোনা, মতান্তরে ধানাই আর মানাই। ধোনা একবার পরিকল্পনা করে সাতটি নৌকা নিয়ে আঠারো ভাটির দেশের মহলে বা একদম গভীরে যাবে মধু সংগ্রহ করতে। তার ভাই মোনা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কাজেই একলা ধোনা গরীব এক রাখাল বালক দুখেকে সাথে নিয়ে যাবে বলে মনস্থির করে। জঙ্গলে যাওয়ার আগে দুখের মা তাকে বলে দেয়- বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছে, কোনো বিপদে পড়লে তাকে স্মরণ করবি। 

নির্ধারিত সময়ে যাত্রা শুরু করে নৌকার বহর কেন্দোখালি চরে পৌঁছায়। সে সময় ঐ অঞ্চলের রাজা ছিল দক্ষিণ রায়। ভুলক্রমে রাজাকে ভেট বা উপহার দিতে ভুলে যায় ধোনা। কাজেই নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী তিনদিন মধু বা মোম সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকতে হয় তাদের। 

তৃতীয় রাতে ধোনার স্বপ্নে দেখা দেয় দক্ষিণ রায়, ভুলের মাশুল হিসেবে নরবলি দেয়ার আদেশ দেয় তাকে। বেশ বাকবিতণ্ডার পরে শেষ পর্যন্ত দুখের প্রাণের বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে মধু আর মোম নেয়ার অনুমতি আদায় করে লোভী ধোনা। কাজেই পর্যাপ্ত মধু আর মোম নিয়ে দুখেকে একা ফেলে রেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিজ গ্রামে চলে আসে ধোনা। বাঘরূপী রাজা দক্ষিণ রায় যখন দুখেকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়, তখনই দুখের মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। মনে মনে সে সাহায্য প্রার্থনা করে বনবিবির কাছে। তার সেই ডাক শুনে ভাই শাহাজঙ্গুলিকে সাথে নিয়ে ছুটে চলে আসে বনবিবি। 

সম্মুখ যুদ্ধে বাঘবেশী দক্ষিণ রায়কে হারিয়ে দেয় শাহাজঙ্গুলি। হেরে গিয়ে বড় খান গাজীর কাছে আশ্রয় নেয় দক্ষিণ রায়, সবার কাছে তিনি গাজী পীর নামেই খ্যাত। শেষ পর্যন্ত গাজী পীর গিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বনবিবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে তারা নিষ্ঠুর রাজার কোনো ক্ষতি করবে না।

বিনিময়ে গাজী দুখেকে সাত নৌকাভর্তি মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দেন। বনবিবির পোষা কুমির সেকোর পিঠে চড়ে গ্রামে ফিরে যায় দুখে। নিজ গ্রামে এসে বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে দুখে। তার কথায় অভিভূত হয়ে সে গ্রাম তো বটেই, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও শুরু হয়ে যায় বনবিবির উপাসনা। 
ধোনা তার ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের বিয়ে দেয় এবং দুখেকে গ্রামের চৌধুরী বা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

এমন নানা কাহিনীতে বনবিবিকে সুন্দরবনজীবী মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পেয়ে পূজিত হতে শুরু করেন। ১৪ শতকের প্রথমাধের্র দিকে দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্যের প্রতাপশালী রাজা মুকুট রায়। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়ের সেনাপতি। মুকুট রায়ের মেয়ে বনবিবি। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। তবে মুসলমানরা মনে করেন এই বনবিবি হলো গাজীর স্ত্রী। যার নাম চম্পাবতী। কাজেই তারা চম্পামাই বলেও সম্বোধন করে থাকেন।  

প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ জানুয়ারি সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা। খ্রিষ্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

জঙ্গলে ও গ্রামে দুই জায়গায়ই বনবিবির পুজো হয়। সুন্দরবনের মানুষের কাছে হিন্দু- মুসলমান উভয়েরই এই বনবিবির পুজো খুবই জাগ্রত ও অর্থবহ। তাই তারা কিছু নিয়ম কানুন মানেন। নিয়ম-কানুন নিয়ে কথা বললেন শ্রীপতি বাছার দাদার বাবা গোপাল চন্দ্র বাছার কাকু বলেন, ‘‘জঙ্গলে যাওয়ার আগে, সে মৌয়াল হোক বা বাওয়াল হোক তারা শুদ্ধভাবে থাকেন। স্ত্রী-সংসঙ্গ করেন না। স্নানের পরে ময়লা বা বাসি কাপড় পরেন না। জঙ্গলে যাওয়ার আগে তারা বাড়িতে বনবিবির পুজো করেন- হিন্দু-মুসলাম নির্বিশেষে। যতদিন জঙ্গলে থাকেন, নারীরা আমিষ খান না, সিঁথিতে সিঁদুর পরেন না, চুলে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান না। স্বামীরা ফিরে এলে সকলে মিলে বনিবির পুজো করেন। প্রতিবছর মাঘ মাসের ১ তারিখ গ্রামজুড়ে সবাই একসাথে সাড়ম্বরে এই বনবিবির পুজোর উৎসব করেন। সকলের বিশ্বাস আজও বাঘের হাত থেকে গ্রামের মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন ‘বনবিবি’। বনবিবিকে তিনি জঙ্গল ও সুন্দরবনের গ্রামগুলোর রক্ষা কর্তা দেবী ‘ব্রাঘ্যবাহনা বনবিবি’ নামে আখ্যা দেন।’’  

সুন্দরবনের সাধারণ, সরল, সাহসী মানুষসহ বনবিবি’র সাথে একদিন উৎসবে দিনে বুঝতে পেরেছিলাম, বনবিবি এক শক্তির নাম। তাকে নিয়ে উদযাপন এক ঐক্যের নাম। র্ধম-বর্ণ নির্বিশেষে এক সম্প্রীতির নাম ‘বনবিবি’।

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : ‘ভয়ঙ্কর সুন্দরে’ যাই মধু আহরণে 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়