ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিস্মৃত ইতিহাস অন্তঃসারশূন্য অবকাঠামো

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১০:৪৮, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বিস্মৃত ইতিহাস অন্তঃসারশূন্য অবকাঠামো

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের নিভৃতপল্লী জব্বার নগর। ভাষা শহীদের নামে গ্রামের নাম জব্বার নগর। ভাবতেই ভালো লাগে। ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের স্মৃতি ও চেতনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে উনার বসতবাড়িতে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।

দৃষ্টিনন্দন এই জাদুঘর ২০০৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারিভাবে এই ভাষা শহীদের প্রতি যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।

আরো পড়ুন:

একেবারে নিভৃতপল্লীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এরকম স্থাপনা- আশা জাগানিয়া। সম্প্রতি গিয়েছিলাম জাদুঘরটি দেখতে। দুঃখের বিষয় গিয়ে দেখি তালাবদ্ধ। আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম এ জাদুঘরের স্টাফ যারা আছেন, তারা আসেন, কিছুক্ষণ  থেকে চলে যান। এখানকার গ্রন্থাগারে তেমন কেউ আসে না।

এই তথ্য আমার হৃদয়কে আহত করেছে। আমি ভাবছি আমরা এক ব্যর্থ প্রজন্ম। অথচ আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদের জন্য সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমরা দেখেছি কারও ব্যক্তি উদ্যোগে খোলা আকাশের নিচেও পাঠচক্র বসতো। শিশুদের জন্য নানা ধরনের সংগঠন ছিল। যেখানে বিভিন্ন পরিবারের ছেলে মেয়েরা অংশ নিত। অথচ এখানে এতবড় অবকাঠামো, গ্রন্থাগার আছে পাঠক নেই।

আমি মনে করি স্থানীয়ভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা থাকলে ছেলেমেয়েরা সংগঠিত হতো, তারা দেশ, জাতি, ভাষা, ইতিহাস সম্পর্কে জানতে উদ্বুদ্ধ হতো। এ চিত্র কেবল জব্বার নগরের নয়, সারা বাংলার চিত্র। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত- সময়কাল বিবেচনায় যেকোন সময়ের থেকে আমরা এখন সাংস্কৃতিক চর্চায় দৈন্যদশায় ভুগছি। 

আগে গ্রামের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে কবি গান, যাত্রাপালা, গাজীর গান, লাঠিখেলা এসবের আয়োজন করতো। এখন সেসব কোথায় যে হারালো! কিন্তু এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয় আমরা শেকড়ে থেকেও শেকড়কে ভুলতে বসেছি। শহরে তিন-চার দশক আগে যেভাবে কবিতা উৎসব হতো, আর এখন যা হয়; তুলনা করলে গুনে-মানে এতো নিচেই নেমে এসেছে সেটা কল্পনাও করা যায় না। সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায়, যেসব চেতনা নিয়ে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল, সেইসব চেতনা এখন অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। 

আমাদের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি মানে শহীদ দিবস ছিল, আমরা ভাষা দিবস  বা মাতৃভাষা দিবস বলতাম না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবারও বলে নাই বাংলা মাতৃভাষা থাকবে না, বা তুমি বাংলায় কথা বলতে পারবে না। সে বলেছিলো বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে না। মানে বাংলাটা প্রসাশনিক কাজে ব্যবহার করা হবে না। বাংলার প্রশাসনিক তথা রাষ্ট্রী মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষাসৈনিকরা জীবন দিলেন মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা  প্রতিষ্ঠার জন্য। 

এ সময়ের উচ্চশিক্ষিত বাবা মায়েদের অনেকে তাদের সন্তানকে শুরু থেকেই বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এজন্য নিজেরাও বাসায় বাংলায় কথপোকথন বনধ করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতি আমরা আমাদের মায়ের ভাষার বিপরীতে তৈরি করেছি। তাহলে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গান, গল্প, রূপকথা, মিথ  কোন ভাষায় রচিত হবে?

সমস্যা কিন্তু ইংরেজি ভাষা নয়, সমস্যা অন্য কোথাও। ইংরেজি ভাষার আধিপত্য আগেও ছিল। ব্রিটিশরা যখন আমাদের শাসন করেছে তখন সরাসরি রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। তারপরে পকিস্তান আমলেও ইংরেজির প্রশাসনিক আধিপত্য ছিল। কিন্তু বাংলাচর্চা ছিল জোরালো। ওই সময়ের মধ্যেই বড় মাপের বাঙালি কবি, লেখক, সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। ওই লেখকেরাতো ইংরেজিও জানতেন। তাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন, পরে বাংলা ভাষার কাছে ফিরে আসেন। আসতে বাধ্য হন। রবীন্দ্রনাথ কি ইংরেজি জানতেন না? তাতে কী উনি উনার মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করেছেন? 

আমরা যখন মাতৃভাষাকে দৈনন্দিন চর্চা থেকে সরিয়ে ফেলছি এতে ‘বাঙালি জাতিগতভাবে’ ক্ষতির মুখে পড়ছে। একটি শিশু মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করে। মায়ের কাছেই তার ভাষা শেখা শুরু হয়। এখন মায়েরা যদি শিশুকে শুরুতেই অন্য ভাষায় শিক্ষা দিতে শুরু করেন তাহলে বাংলা ভাষার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেমে যাবে!

ইতিহাস চর্চার ধারাবাহিকতা থাকে ভাষার মাধ্যমে। যদি ভাষাচর্চাই না থাকে তাহলে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কীভাবে পৌঁছাবে?

/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়