ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘বিষাদ’ যাপন করে মীর মশাররফ হোসেনের পিতৃভিটা

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ৯ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৪:২৬, ৯ জানুয়ারি ২০২৫
‘বিষাদ’ যাপন করে মীর মশাররফ হোসেনের পিতৃভিটা

মীর মশাররফ হোসেনের পিতৃভিটা। ছবি: লেখক

কুষ্টিয়াকে বলা যায় ‘বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার উর্বর ভূমি’। এই মাটিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কুঠিবাড়ি’, লালনের আখড়া, গগণ হরকরার জন্মভিটা ও  কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা। কুষ্টিয়াতেই জন্ম বাংলা ‍উপন্যাসের প্রথম সার্থক মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের। উনিশ শতকের অন্যতম বাঙালি সাহিত্যিক তিনি। আজীবন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছেন। মীর মশাররফের জন্ম ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর, কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ায়। জানা যায় মীর মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার।  

এই সাহিত্যিক তিনি নিজ বাড়িতে আরবি ও ফারসি শেখেন। এরপরে পাঠশালায় গিয়ে বাংলা ভাষায় পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। মীর মশাররফ হোসেন পরে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ইতি ঘটে। কর্মজীবনের শুরুতে পিতার জমিদারি দেখাশোনা করতেন মীর মশাররফ। পরে তিনি ফরিদপুর নবাব এস্টেট এবং১৮৮৫ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করেন। দেলদুয়ারে বসেই রচনা করেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’।

আরো পড়ুন:

মীর মশাররফ প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ এবং কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করেন। সংবাদ প্রভাকরে তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেন, যুক্ত ছিলেন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এর সঙ্গেও। মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যিক গুরু ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। 

মীর মশাররফ হোসেন হিন্দু প্রধান সাহিত্য সমাজে তিনি উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। মুসলিম পরিবারগুলোতে মীর মশাররফ হোসেনের উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ অনেকটা ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদায় পড়া হতো। মধ্যবিত্ত পরিবারের অল্প শিক্ষিত বউ-মেয়েরাও অবসরে পাঠ করতেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। কল্পনা ও বাস্তব এই দুইয়ের অসাধারণ সংমিশ্রণ রয়েছে তার লেখায়। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ইসলামের ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত। তার উপন্যাস ‘গাজী মিয়ার বস্তানীও’ পাঠক সমাজে সমাদৃত। তার রচিত নাটক ‘বসন্ত কুমরাী ও ‘জমিদার দর্পন’ অসামান্য সৃষ্টি। ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই প্রবাদ পুরুষ মারা যান। 

পেশাগত কারণে মীর মশাররফ হোসেনকে পিতৃভিটা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এমনকি তার দাফনও কুষ্টিয়ায় হয়নি। মীর মশাররফ হোসেনের পিতৃভিটা কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায়। এই ঔপন্যাসিকের নামে সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ছোট আকারের একটি লাইব্রেরী রয়েছে।একটি মসজিদ ও ঈদগাহ পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। এক দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি শুনশান নিরবতা বাড়িটা ঘিরে রেখেছে। বলতে গেলে মীর মশাররফ হোসেনের নীল রঙের বাড়িটি একা একাকীত্ব যাপন করে। এই বাড়িতে কেউ থাকে না। বাড়ির লাইব্রেরিতে কাউকে দেখলাম না। বাড়ির উঠানে মীর মশাররফের ব্যবহৃত একটি ইঁদারা বা কূপ। পুরনো কূপকে আধুনিক টাইলস দিয়ে নতুনত্ব দিয়েছে জেলা কার্যালয়। 

বাড়িটিতে ঢোকার জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের কেউ কুষ্টিয়াতে এলে কখনো-কোনো একদিন এই বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ান। বাড়ির দেয়াল থেকে চুনকাম খসে পড়ছে। সৌন্দর্য হারিয়ে রংচটা রূপ নিচ্ছে বাড়ি ঘর-দরজা-জানালা। সব মিলিয়ে তৈরি করেছে আরেক ‘বিষাদের দৃশ্য-একাকীত্বের নমুনা।’ তবুও বাড়িটি অনেক গল্প বলে সেই গল্প গৌরবের ও বিষাদের।

জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেনের দুইজন স্ত্রী ছিলেন। মাত্র আঠার বছর বয়সে তার পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় মীর মশাররফ হোসেনের। কিন্তু তার প্রথম স্ত্রী আজিজুন্নেসার গর্ভে কোনো সন্তান জম্নগ্রহণ করেনি। দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমের গর্ভে জন্ম নেয় পাঁচ পুত্র ও ছয় কন্যা। ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর নিজ বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে মীর মশাররফ হোসেন মারা যান। এরপর বিবি কুলসুমের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়