আশির দশকের মাধ্যমিক শিক্ষা
এসএসসি শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান। ছবি: লেখকের সংগহ
একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আরেকটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ছিল তিন থেকে ছয় মাইল। স্বাভাবিক সময়ে হেঁটে আর বর্ষায়-নৌকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতো। কিছু কিছু স্কুলে হোস্টেল থাকতো। সেখানে ছাত্ররা থেকে পড়াশোনা করতো। আর ঐ সময় একটা দারুণ প্রথা প্রচলিত ছিল, সেটা হচ্ছে লজিং থাকা বা জায়গীর থাকা। স্কুলের আশপাশের অবস্থাসম্পন্ন বাড়ি বা যাদের টাকা পয়সা বেশি ছিল তারা এক, দুইজন ছাত্রকে বাড়িতে জায়গা দিতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অন্যতম একটা দায়িত্ব ছিল, মেধাবি এবং দূরবর্তী ছাত্রদের জন্য স্কুলের কাছাকাছি জায়গীর বাড়ি খুঁজে দেওয়া। তখন এই প্রথা শিক্ষা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অবস্থাসম্পন্ন বাড়িগুলোতে ছাত্ররা থাকতো। এবং পরবর্তীতে পড়াশোনা করে এই ছাত্রদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এখনকার মতো বিনামূল্যে বই তখন দেওয়া হতো না। বই দুই ধরণের ছিল, টেক্সট বুক—সরকার কর্তৃক ছাপা হতো সেগুলোই লাইব্রেরি থেকে কিনতে হতো।এর সঙ্গে কিছু সহায়ক বই থাকতো। যেমন, বাংলা, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই। এই বইগুলোর আবার অপশন থাকতো। বিশেষত ওই সময় দুইটি কোম্পানি ছিল গ্লোব এবং পুঁথিঘর। এই দুইটি বই কোম্পানির বইগুলো বেশি চলতো।
তখন সবার আর্থিক সামর্থ্য বেশি ভালো ছিল না। ফলে সবাই নতুন বই কিনে পড়তে পারতো না। পুরনো বই কিনে পড়ার একটা চল ছিল। নতুন বই কেনার সময় যদি মোটামুটি সব বই কেনা হতো, তাহলে মলাট লাগানোর জন্য লাইব্রেরি থেকে একটা ম্যাগাজিন বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বিশেষত সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ম্যাগাজিন ছিল ‘উদয়ন’, সেটি দিত। তখন বাংলাদেশে কমিউনিজম আনার চেষ্টা করছিল রাশিয়া। তারা বাংলায় ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো এবং বিনামূল্যে দিতো। ওই ম্যাগাজিন দিয়ে মলাট লাগানো হতো আবার অনেক সময় ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়েও মলাট লাগানো হতো। মলাট লাগিয়ে সেগুলো আবার সুন্দর করার জন্য বালিশের নিচে একদিন বা একরাত রাখা হতো, যাতে মলাটটা ঠিক মতো হয়।
যাদের আর্থিক অবস্থা একটু খারাপ ছিল তারা এক ক্লাস উপরে যারা পড়তো তাদের কাছ থেকে পুরনো বই কিনতো। রীতিমতো এটা বছরের শুরুতে বিক্রি হতো। অথবা বছরের শেষেই বলে রাখতে আমাকে যেন বইটা দেওয়া হয়।
বছরের তিনটি পরীক্ষা হতো- প্রথম সাময়িক দ্বিতীয় সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা। এভাবেই তিনটি পরীক্ষা দিয়ে ষষ্ট শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী তারপর অষ্টম শ্রেণীতে পৌঁছাতো শিক্ষার্থীরা। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ভালো ছাত্র বাছাই করে সাত জন বা দশ জনের একটা গ্রুপ বৃত্তি পরীক্ষার জন্য মনোনীত হতো। মনোনীতদের ‘বৃত্তিবই’ নামের একটি বই কিনতে হতো। সাধারণত বৃত্তি পরীক্ষাগুলো জেলা সদরে অনুষ্ঠিত হতো।
ওই সময় সবাই জেলা সদরে গিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা দিত। কেউ কেউ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেতো আবার কেউ কেউ সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেতো। আবার অনেক সময় একটি স্কুল থেকে দেখা যেত, একজনও বৃত্তি পায়নি। এভাবে ধীরে ধীরে তারা নবম শ্রেণীতে উঠতো, এরপর নতুন দশম শ্রেণীতে উঠতো। নতুন দশম শ্রেণীর শেষে টেস্ট পরীক্ষা হতো। টেস্ট পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতো তাদেরকে বলা হতো এক্স টেন বা পুরোনো দশম শ্রেণী।
স্বাভাবিকভাবেই এসএসসি পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসতো। এই সময় যারা টেস্ট পরীক্ষায় পাস করে- এস এসসির জন্য মনোনীত হয়েছে তাদেরকে স্কুলের তরফ থেকে বিদায় জানানো হতো। এই অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পালন করতো নবম শ্রেণীর ছাত্ররা। অনুষ্ঠানে বিদায়ী ছাত্রদেরকে বিভিন্ন ধরণের উপহার সামগ্রী দেওয়া হতো। বিশেষত তখন কাগজের মালা তাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হতো। বিদায়ী ছাত্ররাও আবার শিক্ষকদেরকে মালা পরিয়ে বিভিন্ন রকম উপহার সামগ্রী দিত। ওই অনুষ্ঠানে আলোচনা পর্বও থাকতো।
সমস্ত স্কুলের ছাত্রদের খাওয়ানোর জন্য বিস্কুট কেনা হতো। টিন ভর্তি বিস্কুট— নাবিস্কো কিংবা হক কোম্পানির বিস্কুট। সেগুলোকে অ্যাসোর্টেড বিস্কুট বলা হতো। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা অনুাযায়ী বড় বড় দুই টিন বিস্কুট এনে ছাত্রদের দুই, তিনটি করে বিস্কুট দেওয়া হতো। যাদেরকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে তাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো, শিক্ষকদের জন্যও খাবার ব্যবস্থা থাকতো। অনুষ্ঠানটি বেদনাবিধূর একটা পরিস্থিতি তৈরি করতো। বিদায়ী ছাত্ররা তাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের স্মৃতি বিজড়িত স্কুলকে বিদায় জানানোর সময় স্মৃতি তুলে ধরতো, শিক্ষকরা নানাভাবে আশীর্বাদ করতো। যারা ছোট ক্লাসে পড়ে তাদের জন্য তারা শুভেচ্ছা জানাতো। ছোট ক্লাসের ছাত্ররাও বিদায়ী ছাত্রদের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে সাফল্য কামনা করতো।
এসএসসি পরীক্ষাগুলো সাধারণত থানা সদরে অনুষ্ঠিত হতো। কেন্দ্রে যাওয়া-আসার একটা ঝামেলার ব্যাপার ছিল। অনেকেই পরীক্ষাকেন্দ্রের আশেপাশে থাকার ব্যবস্থা করতো। সেখান থেকে তারা পরীক্ষা দিত। সে সময় সাধারণত দুই বেলা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র একই দিনে দুই বেলায় অনুষ্ঠিত হতো। ইংরেজি প্রথম পত্র এবং দ্বিতীয় পত্রও একই দিনে হতো। পরীবর্তী বিষয়গুলোর পরীক্ষা অনেক সময় এক বেলায়ও থাকতো আবার দুই বেলায় দুইটা হতো। পরীক্ষা শেষে সায়েন্সর শিক্ষার্থীদের জন্য প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকতো। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাধারণত তিন মাস পরে পরীক্ষা ফল প্রকাশ হতো। এবং সেই সময়ে বোর্ড ছিল চারটি। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর—এই চারটি বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকা প্রকাশ করা হতো। এ ছাড়া আবার প্রত্যেক বোর্ডের আলাদা মেধা তালিকা প্রকাশ করা হতো।
এক হাজার নম্বরের মধ্যে কেউ সাতশো পঞ্চার মার্কস পেলে সে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হতো। আর কোনো বিষয়ে সে যদি আশির ওপরে নাম্বার পেত তাহলে সেটা লেটার হিসাবে গণ্য করা হতো। ছয়শো নম্বর পেলে প্রথম বিভাগ, চারশো পঞ্চাশ বা তার বেশি নম্বর পেলে দ্বিতীয় পেয়ে উত্তীর্ণ হতো। এভাবে তারা তাদের মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করতো। পরবর্তীতে তারা এই ফলাফল নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হতো।
ঢাকা/লিপি