নাইন ইলেভেন ও একজন সাংবাদিকের দেখা কাবুল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম
ক্যাথি গ্যানন
নাইন ইলেভেনের ঘটনার দিন ও পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন ক্যাথি গ্যানন। বর্তমানে তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নিউজ ডিরেক্টর। তিনি নাইন ইলেভেনের ঘটনা ও আফগানিস্তানে পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর ১১: দ্য ৯/১১ স্টোরি, আফটারম্যাথ অ্যান্ড লিগ্যাসি’ নামে একটি বই লেখেন। সেই বই থেকে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
ক্যাথি গ্যানন লেখেন, সেদিন আফগান রাজধানীতে সংবাদ কর্মী হিসেবে কাজ করার সময় তিনি তার বসের কাছ থেকে একটি কল পেয়েছিলেন যা তার ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের শেষ বিকেলে, যখন আফগানিস্তানে সকাল আমি নিউইয়র্ক থেকে একটি ফোন পেয়েছিলাম। ফোন করে ছিলেন আমার বস এবং এপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক স্যালি জ্যাকবসেন। তিনি আমাকে জানালেন একটি বিমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ারে আঘাত করেছে এবং এটি একটি দুর্ঘটনা হতে পারে। কিন্তু এটা বলতে না বলতেই তিনি আবার বলেলেন আর একটি বিমান দ্বিতীয় টাওয়ারে আঘাত হেনেছে। তিনি নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন…
আমি সেদিন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ছিলাম যখন দুই তরুণ আমেরিকান নারীসহ ছয় জন খ্রিস্টান সাহায্যকর্মীর জেলে পাঠানো নিয়ে পরিবেশ বেশ গরম ছিল। এর দুই দিন আগে, আত্মঘাতী হামলায় আহমদ শাহ মাসুদকে হত্যা করা হয় যিনি ১৯৯৬ সাল থেকে তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য লড়ে আসছিল।
তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে তখন কোনো টেলিভিশন ছিল না। সঙ্গীতও নিষিদ্ধ ছিল। রেডিও ছিল খবরের একমাত্র উৎস। নিউইয়র্ক থেকে ফোনের ত্রিশ মিনিট পরে, আমার আফগান সহকর্মী আমির শাহ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় আমাদের এপির ছোট অফিসে আসেন। তথন আরেকটি বিমান পেন্টাগনে ভেঙে পড়ে। কি হতে যাচ্ছিল? নিউইয়র্কে এপি সম্পাদকদের কাছে সেটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এটি সন্ত্রাসবাদ এবং আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হচ্ছিল। তিনি ১৯৯৬ সালে তালেবানদের ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই আফগানিস্তানে বসবাস করে আসছিলেন। তিনিই ছিলেন এর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী।
কয়েক মিনিট পরে আমির শাহ জানালেন চতুর্থ একটি বিমান অবিশ্বাস্যভাবে মাঠে বিধ্বস্ত হয়েছে। তখন আমির শাহ ও আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এবার আফগানিস্তানে আগুন লাগবে।
ওই দিন রাতে ১৫ লাখ মানুষের শহর কাবুল ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। কোথাও বিদ্যুৎ ছিল না। বেশিরভাগ রাস্তা ছিল নিস্তব্ধ । হাতে গোণা দুই একটি দোকান খোলা ছিলো।
কাবুলে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিউইয়র্ক কোথায় বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার কোথায় তারা তা জানে না। তবে তারা আমেরিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। তারা আসন্ন যুদ্ধ, ভয় এবং ক্ষতির বিষয়ে বুঝতে পেরেছিল।
১২ সেপ্টেম্বর তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াকিল আহমদ মুত্তাওয়াকিল কাবুলের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন তারা জানেন না বিন লাদেন কোথায় আছেন।
তালেবান সরকার ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বিদেশীদের এমনকি রেড ক্রস সোসাইটির কর্মীদের আফগানিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। আমিও আফগানিস্তান ছেড়ে ইসলামাবাদে চলে যায়।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ৭ অক্টোবর, ২০০১ আফগানিস্তানে বোমা হামলা শুরু করে। পাশাপাশি স্থানীয় নর্দার্ন অ্যালায়েন্স তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে যুদ্ধ শুরু করে।
কাবুলের আশেপাশের পাহাড়ে তালেবানরা বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র রেখেছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা পেতে। রাতে লাইটও বন্ধ রাখত। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা পেতো না।
আমির শাহ প্রতি রাতে আমাকে ফোন করে সর্বশেষ খবর জানাতেন। যোগাযোগের জন্য আমরা তালেবানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করতাম।
২৩ অক্টোবর আমির শাহ আমার এবং এপি ফটোগ্রাফারের জন্য কাবুলে প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করে। আমরাই একমাত্র পশ্চিমা সাংবাদিকদের মধ্যে তালিবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিলাম। শত শত সাংবাদিক তখনও প্রতিবেশী পাকিস্তানে বা তাজিকিস্তানে শিবির স্থাপন করে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তারা তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পাননি।
এই সময় কাবুল হয়ে ওঠে ভয়ের শহর। দিনের বেলায় বোমা হামলা কম হতো এবং এই সময় কিছু মানুষ বের হতো। কিন্তু রাতে বোমা হামলা তীব্রতর হয় এবং রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে পড়ে।
১৩ নভেম্বর, নাইন ইলেভেনের হামলার দুই মাস দুই দিন পর অবশেষে তালেবান কাবুল থেকে পালিয়ে যায়। আগের রাতে, ২০০০ পাউন্ডের একটি বোমা এপি হাউজের এক কোণায় বসিয়ে রেখে যায়। যা পরে আমার রুম উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেয়। ১৩ নভেম্বর আফগানিস্তান তালেবানমুক্ত হয় এবং হিন্দু কুশ পর্বতমালা এলাকায় নতুন সূর্য উদিত হয়।
ঢাকা/মুকুল/ইভা
আরো পড়ুন