ঢাকা     শনিবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আলজাজিরার প্রতিবেদন: তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ২২:৫৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
আলজাজিরার প্রতিবেদন: তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঢাকার উপকণ্ঠে বৃহস্পতিবার জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন ‘জনগণের জন্য এবং দেশের জন্য আমার একটি পরিকল্পনা’ আছে।

এটি এমন একটি পরিকল্পনা যা ১৭ বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার, গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ব্রিটেন থেকে ঢাকায় ফেরেন। ব্রিটেনে তিনি ২০০৮ সাল থেকে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। তাকে স্বাগত জানাতে হাজার হাজার সমর্থক একটি সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন।

আরো পড়ুন:

তারেক রহমান তার ভাষণে বলেছেন, “আমরা শান্তি চাই। আমাদের দেশে পাহাড় ও সমতলের মানুষ আছে - মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান। আমরা একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে প্রতিটি নারী, পুরুষ ও শিশু নিরাপদে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে।”

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন এমন এক সময়ে হলো, যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে, বিশিষ্ট যুব নেতা ওসমান হাদি নিহত হয়েছেন এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। বিএনপিকে দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনে এগিয়ে দেখা হচ্ছে এবং তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কিন্তু হাদির হত্যার পর দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা - দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের অফিসে অগ্নিসংযোগ এবং একজন হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা আরো তীব্র হওয়ার ফলে নির্বাচনটি লাইনচ্যুত হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন এবং তার বক্তৃতা দেশের রাজনৈতিক জলস্রোতকে শান্ত করতে এবং বাংলাদেশের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের গতি আরো জোরদারে সহায়তা করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলে, “তার আগমন সুযোগের একটি নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। আমি মনে করি এটি নির্বাচন সম্পর্কে অনিশ্চয়তা হ্রাস করবে এবং দেশ যে স্থিতিশীলতার সন্ধান করছে তার অনুভূতি তৈরি করবে।”

স্থিতিশীলতার অনিশ্চয়তা

মা খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ থাকায় আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির ভবিষ্যৎ গঠনে দীর্ঘকাল ধরেই আশা করা হচ্ছিল তারেক রহমান নির্বাসন থেকে ফিরে আসবেন। তবে সম্প্রতি সময় পর্যন্ত, নির্বাসন থেকে তার প্রত্যাবর্তন অনিশ্চিত ছিল। তিনি নিজেই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিতে দ্বিধা করেছিলেন। 

অধ্যাপক শাহান জানান, তারেক রহমানের আগমন এখন সেই অনিশ্চয়তা দূর করেছে। কিন্তু একটি নতুন প্রশ্নের সূচনা করেছে। তিনি কি সত্যিই নেতৃত্ব দিতে পারবেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “যদি তিনি চরমপন্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন, জনগণকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তাদের উদ্বেগ বোঝেন এবং একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবেন, স্বাভাবিকতা আনার প্রতিশ্রুতি দেন এবং দলীয় ব্যবস্থার উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে শাসন পরিচালনা করতে প্রস্তুত বলে দেখান, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে।”

কিন্তু তারেক রহমান যদি স্পষ্ট বার্তা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে ‘পরিস্থিতির অবনতি হবে’ বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক শাহান।

ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ-এর সহযোগী গবেষক মুবাশ্বার হাসান জানান, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে বৃহস্পতিবার জনসাধারণের যে উৎসাহ দেখা গেছে তা ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি বিএনপির ঐতিহ্যবাহী ভোটারদের বাইরে থাকা সমর্থন থেকেও উপকৃত হতে পারেন।

মুবাশ্বার হাসান বলেন, “তার প্রত্যাবর্তনের প্রতি জনগণের আগ্রহ এবং প্রতিক্রিয়া কেবল বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সর্বস্তরের মানুষ এতে অন্তর্ভুক্ত।” 

তিনি জানান, গত ১৬ মাসের বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাংলাদেশের অনেকেই সম্ভবত দলটিকে একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে দেখছেন। এই বিশৃঙ্খলা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিশাল বিক্ষোভের পর থেকে শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে এবং বৃহত্তর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে এই সরকার।

তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে সমর্থকদের বিশাল সমাবেশ বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তিও প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে মুবাশ্বার হাসান জানান, আরো একটি বিষয় রয়েছে যা তারেক রহমানের পক্ষে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের রাস্তায় অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, খালেদা জিয়ার ছেলের সাথে অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল এবং তাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকা সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, তারেক রহমান বিভিন্ন অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে কিছু মামলায় তার অনুপস্থিতিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।

ছেলের প্রত্যাবর্তন

২০০৬ সালে বিএনপি শেষবার ক্ষমতা হারানোর পর, রাজনৈতিক জোয়ার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রবাহিত হয়েছিল। খুন থেকে শুরু করে দুর্নীতি পর্যন্ত একাধিক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তার অভিযুক্ত অপকর্মের গল্প বাংলাদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

তবে, তারেক রহমান তার দলের উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রাখতে এবং এর ঐক্য বজায় রাখতে সফল হন। ২০২৪ সালের বিদ্রোহ তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। গত দেড় বছরে তার বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল করা হয়েছে এবং দোষী সাব্যস্ততা স্থগিত করা হয়েছিল, যা তার প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করেছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশি ভূ-রাজনৈতিক কলামিস্ট শাফকাত রাব্বি বলেন, “একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তারেক রহমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হবে নীতির প্রতি তার মনোযোগ। তিনি তার অভ্যন্তরীণ মহলে একজন নীতিপ্রেমী হিসেবে পরিচিত এবং লাখ লাখ সমর্থকের সামনে আজকের বক্তৃতায় তিনি বারবার বলেছেন যে তার একটি পরিকল্পনা আছে।”

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তার পরিকল্পনার যে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে তা হচ্ছে ভারতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি।

‘ঘরে প্রাপ্তবয়স্ক’

ঐতিহ্যগতভাবে, বিএনপির সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশিরভাগ সময়েই শীতল ছিল। বাংলাদেশে যে দল যখনই ক্ষমতায় ছিল তখনই দিল্লি কার্যকরী সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। কিন্তু ভারত প্রায়শই স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে তারা হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগকে তাদের অংশীদার হিসেবে পছন্দ করে।

দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির কয়েক দশকের পুরনো জোট ভারতের সাথে সম্পর্ককে সাহায্য করেনি। জামায়াত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং ঐতিহাসিকভাবে ইসলামাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সমর্থন করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী মনোভাব দেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর তীব্র ভারতবিরোধী বক্তব্যের দিকে পরিচালিত করলেও, বিএনপি তুলনামূলকভাবে সংযত অবস্থান বজায় রেখেছে।

বিএনপি জামায়াতের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং নিজেকে একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। দলটি আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের শূন্য রাজনৈতিক স্থান দখল করতে আগ্রহী।

যদিও তারেক রহমান ‘বাংলাদেশ প্রথম’ স্লোগান গ্রহণ করেছেন, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, তার একজন জ্বলন্ত ভারতবিরোধী রাজনীতিবিদ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

শাফকাত রাব্বি বলেন, “তারেক বাংলাদেশে ফিরে আসলে ভারতের মূল ধারণা হবে যে, ভারতীয়রা অবশেষে এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ককে পাবে যার সাথে আলোচনা করার জন্য রাজনৈতিক শক্তি থাকবে।”

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক জরিপগুলোতে দেখা গেছে, বিএনপি এবং জামায়াত নির্বাচনী প্রতিযোগিতাায় খুব কাছাকাছি চলে আসছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেখানেও তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপিকে সাহায্য করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহান বলেন, “তার উপস্থিতি অবশ্যই দলীয় ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে এবং সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের বিএনপির পক্ষে যেতে উৎসাহিত করবে। যদি তিনি সফল হন, তাহলে আমরা খুব ভালোভাবে একটি ‘তরঙ্গ’ নির্বাচন দেখতে পাব যেখানে বিএনপি ব্যাপক ভোটে  জয়লাভ করতে পারে।”

তিনি বলেন, তবে এটি ঘটতে হলে, তারেক রহমানকে দেখাতে হবে যে “তিনি জনগণের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন, তাদের আশ্বস্ত করতে পারেন এবং সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য একটি স্পষ্ট পথ প্রদান করতে পারেন।”
 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়