বিস্মৃত জাতির অবিস্মরণীয় হুমায়ুন আজাদ
জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ। শুক্রবার। সেদিন মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগরে ভ্রমণে যাওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী সকালে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ড. হুমায়ুন আজাদের বাড়ি দেখা। এছাড়া শ্রীনগর থানার ভাগ্যকূল ও রাঢ়িখাল- এই দুই গ্রামের নাম অনেক শুনেছি। সে কারণেও সেখানে যাওয়া।
মনের মধ্যে এক ধরনের তাগিদ ছিলো ড. হুমায়ুন আজাদের বাড়ি ঘুরে দেখা। জানি, তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর সমাধি বাড়িতেই হয়েছে। একজন প্রথিতযশা এবং প্রথাবিরোধী, প্রতিবাদী লেখক তিনি। লেখক মানেই আপসকামী নন, লেখক মানেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলার লোক ছিলেন না তিনি। অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, স্পষ্টভাষী ছিলেন। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে কখনও দ্বিধা করতেন না তিনি।
তাঁর সঙ্গে জীবদ্দশায় আমার কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে একাধিকবার। কাছে থেকে দেখেছি। তাঁর অনেক লেখা পড়েছি। ফলে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, তিনি যে স্পষ্টভাষী- বিষয়গুলো আমাকে টানতো। সে কারণেই তাঁর বাড়ি যাওয়া।
আমরা সকালে রওয়ানা হয়ে গেলাম। এখন পদ্মা সেতু হয়েছে। সেতু ঘিরে আট লেনের রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। একসময় ডান দিকে শ্রীনগরের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়লাম। যাত্রাপথে আরেকজন প্রথিতযশা বাঙালির বাড়ির দেখা মিললো। তিনি স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি বেতার তরঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন। উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে সেটাও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর বাড়ি দেখলাম। তিনিও বিখ্যাত বাঙালি। এরপর আমার মূল গন্তব্য রাঢ়িখালে ড. হুমায়ুন আজাদের বাড়ি। জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি থেকে তাঁর বাড়ি বেশি দূরে নয়, দুই কিলোমিটারেরও কম দূরত্ব।
শুরুতেই দেখলাম মূল রাস্তার উপরে একটি তোরণ। সেখানে লেখা আছে ড. হুমায়ুন আজাদ কমপ্লেক্স। ইট বিছানো পথ। সেই পথে ঢুকে পড়লাম তাঁর বাড়ির ভেতরে। এগিয়ে যেতেই হাতের ডানে তাঁর সমাধি। সেখানে লেখা আছে ড. হুমায়ুন আজাদ সমাধি। ডানপাশে তাঁর ছবি আছে। সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। শ্রদ্ধা জানালাম।
হুমায়ুন আজাদের কবর
এরপরে গেলাম তিনি যে ঘরে থাকতেন সেখানে। বিক্রমপুর এলাকার মানুষ নিজস্ব প্যাটার্নে ঘর তৈরি করে। এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। কাঠ ও টিন দিয়ে, মাটি থেকে উঁচু এক ধরনের ঘর- সেরকমই একটি ঘরে বাস করতেন হুমায়ুন আজাদ। সেই ঘর এখনো টিকে আছে। যদিও বোঝা যাচ্ছে ঘরটির সংস্কার হয়নি বহু বছরেও। এখানে ড. হুমায়ুন আজাদের কিছু ছবি আছে। তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি বাঁধাই করে রাখা হয়েছে।
দুই.
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হন হুমায়ুন আজাদ। ২২দিন ঢাকা সিএমএইচে এবং ৪৮দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এরপর ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট তিনি জার্মানির মিউনিখে মারা যান। তাঁর মৃত্যর ১৯ বছর কেটে গেলো। আমরা দেখি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ তাকে নিয়ে লেখালেখি হয়, কিছু স্মৃতিচারণ হয়। অর্থাৎ আমরা ভুলে থাকি। তিনি যে উচ্চতার মানুষ ছিলেন, আমার মতে সেভাবে তিনি মূল্যায়িত হননি। আমি বলব, সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবেও তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। আমাদের সুশীলসমাজ, সাহিত্যিক তাদের পর্যায় থেকেও তাকে নিয়ে কিছু করা হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে।
তাঁর বাড়িতে যখন গেলাম, একটা তোরণ ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছু নেই! একটু দূরে আশেপাশে যারা ছিলেন, তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা বললেন, তাঁর সমাধি ও বাড়ি অবহেলায় পড়ে আছে। কেউ খুব একটা খোঁজখবর নেয় না। মৃত্যুদিবসে হয়ত কেউ আসেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তাকে ঘিরে এখানে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারত। লাইব্রেরি হতে পারত। অনেক কিছুই করা যেত। এখানে জায়গার অভাব নেই। কেউ সদিচ্ছা করলেই সেগুলো করা সম্ভব।
তিন.
আজ গণমাধ্যমে দেখলাম হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘মারা যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি কথা দিয়েছিলেন তাঁর সমাধিতে একটা কিছু করে দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কক্ষের নাম হবে তাঁর নামে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। তাকে মনে রাখেনি। তিনি ৭২টি বই লিখে গেছেন। বইয়ের মাঝেই বেঁচে থাকবেন তিনি।’
কথাগুলো দুঃখ করে তিনি বলেছেন। কিন্তু এখনো এটা না হওয়া দুঃখজনক। এই আক্ষেপের সঙ্গে আমিও সহমত পোষণ করছি। কারণ ড. হুমাযুন আজাদকে নিয়ে গবেষণার বিষয় আছে। তাঁর রচনাবলী নিয়ে গবেষণার দরকার আছে। সেগুলো করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক একটা রুপ দিতে হবে। তাকে নিয়ে গবেষণা, তাঁর বইপত্র, লেখালেখি আগামী প্রজন্ম কিংবা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে অবশ্যই একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। সেটা হতে পারে তাঁর গ্রামে, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বা দেশের যে কেনো জায়গায় হতে পারে।
আমি বলব, বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বাংলা ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। এখানে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজ এই প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখকের মৃত্যুদিন। এ দিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাই।
/সাইফ/