ঢাকা     সোমবার   ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২২ ১৪৩১

সীমাহীন ভালোবাসা

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১২:০৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সীমাহীন ভালোবাসা

ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা কি আসলে কোনো দিবসে সীমাবদ্ধ? না ভালোবাসা তার ধার ধারে? কী এই ভালোবাসা আসলে?

বয়স অনুযায়ী পাল্টে যায় ভালোবাসা। সে যদি না বদলায় তো আধুনিক হবে কি করে? এই বদলে যাওয়া ভালোবাসা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আছি, আমরা সবাই ভালোবাসাতেই আছি।

আপনি উপমহাদেশের মানুষ অথচ আপনি রাধাকৃষ্ণের প্রেম জানেন না তা কি হয়? এই প্রেম এমনই যে তা কাহিনি থেকে ক্লাসিকে রূপ নিয়েছে। রাধাকৃষ্ণকে আমরা আদি প্রেম বা ভালোবাসা বলে মেনে নিতেই পারি। যা ধর্ম ধর্ম পেরিয়ে কাব্য, গান, ছবি সব জায়গায় হানা দিয়েছে। এটা যদি প্রচলিত স্বামী স্ত্রীর প্রেম হতো এতটা কি সাড়া জাগাতে পারতো? পারতো না। যে কারণে পেরেছে তার মূল জায়াগাটা অনিশ্চয়তা।  অর্থাৎ তাঁরা মিলিত হতেন গোপনে তাঁদের ভক্তিরস প্রেমরস সব বয়ে যেতো ফল্গুধারায়।  রাধা ঘর ছেড়ে যেতে পারছেন না অথচ শ্যামের বাঁশী তাঁকে ডাকছে এই বিরহ এই মধুর অপেক্ষা নিয়ে কত শত গান কবিতা। উপন্যাসের মতো বড় আকারের বইতেও এই প্রেম চিরন্জীব।

প্রেম কি শুধু দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মনের আদান প্রদান? ভালোবাসা অংকুরিত হয় পরিবারে। ছোট শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে মা যখন আদর করেন তখনই এক ভালোবাসার জন্ম হয়।  সে বাচ্চাটি বড় হতে হতে মা তাকে স্কুলে যাবার জামা পরিয়ে দেয়, ব্যাগ ঝুলিয়ে দেয় কাঁধে। পায়ের জুতার ফিতে বেঁধে দেয় পরম মমতায়। এর নাম কি ভালোবাসা নয়?

পিতা যে সারাদিনের ক্লান্তি আর শ্রমের পর ঘুমাতে যাবার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখে যায় তার মেয়েটি কি করছে, ঘুমাতে যাবার পূর্বে দেখা সন্তানের মুখের নামই ভালোবাসা।

আমাদের এই প্রযুক্তি আর ডিজিটাল জগতে অনেক কিছুর মতো ভালোবাসা ও বদলে গেছে। অন্তত: ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলে গেছে। যতটা না মন তারচেয়ে অধিক শরীর এসে ভর করেছে। সে ভালোবাসার নাম পরকীয়া। যার মানে আপনি এক শরীরে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। অবশ্য এ কথাও মানতে হবে মনের মিল বা মনজুড়ে কেউ আসলে সে ভালোবাসার একটা আলাদা রূপ থাকে। এই ভালোবাসাটির নাম সুন্দর। আমি হলপ করে বলতে পারি মানুষ তখনই সুন্দর যখন সে ভালোবাসে। খুব মারফতি কথার প্রয়োজন নাই, আপনি যে বয়সে যেভাবেই প্রেমে পড়েন না কেন আপনি সুন্দর হয়ে উঠবেন। চাইবেন পরিপাটি থাকতে। এতদিনের অগোছালো জামাটি ইস্ত্রিঘরে যাবে। পাতলুনের ভাঁজ হবে ঠিকঠাক। আপবার অবিন্যস্ত চুল আঁচড়ে আপনি বারবার আয়না দেখবেন এর নামই তো ভালোবাসা।

যারা তরুণ-তরুণী সময়টা তাদের। পৃথিবীর সব দেশে সব ভাষায় সব পরিবেশে তারুণ্যের কাছে যে ভালোবাসা তার কোনো তুলনা হয় না। আমি শফিক রেহমানকে দেখি না বা তাঁর কোনো খবর জানি না দীর্ঘদিন। কিন্তু এই মানুষটিকে আমার ভালোবাসা দিবস এলেই মনে পড়ে। আধুনিক মানুষটি আমাদের এই ধর্মান্ধ অনাধুনিক সমাজে এক ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। একটি লাল গোলাপ আর ভালোবাসার যায় যায় দিন ট্যাবলয়েড এখন ইতিহাস।  শফিক রেহমান বা যায় যায় দিন কিংবা তাঁর টিভি শো কিছুই নাই আছে ভালোবাসা দিবস।

যারা বলেন এটা পাশ্চাত্য থেকে আমদানি তারা ভুল বলেন না। কিন্তু কেন বলেন সেটা বোঝেন না। এই যে আপনি গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন গণতন্ত্র কি আমাদের ঘরের তন্ত্র? একদা যারা লাল গোলাপ আর সমাজতন্ত্রকে মিলিয়ে স্বপ্ন দেখতেন তাদের সাম্যবাদ কি আমাদের দেশের তন্ত্র? এমন কি আজকের পোশাক থেকে ল্যাপটপ কিছুই আমাদের নয়। আমরা তাদের আপন করে নিয়েছি। আমাদের মতো করে ভালোবেসে কাছে নিয়েছি। ভালোবাসা দিবস যে দেশের যে ইতিহাসের অংশ হবে হোক সে এখন আমাদের তারুণ্যের উৎসব।

ভ্যালেনটাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস নিয়ে বাণিজ্য হয় এটা ঠিক। যেসব কুমতলবীরা বলেন এর ভেতর আছে নগ্নতা বা এর মাধ্যমে তারুণ্য নগ্নতাকে প্রশ্রয় দেয় তারা ভুলে যায় এই সমাজে বছরের আর সবদিন যে পরিমাণ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন হয় অন্তত: এই দিনে তা হয় না। বরং এই একটি দিনে সবার সাথে থাকার জন্য লোক দেখানোর জন্য হলেও কেউ ফুল কেনে। সে ফুল পৌঁছে যায় তার প্রেমিক প্রেমিকার কাছে। বাঙালি তো এ কাজ আগে করতো না। আমাদের অবরুদ্ধ সমাজে আমরা যদি কাউকে বলি গুড তার মানে আমরা বলতে চেয়েছি চমৎকার। যদি ভুলে বলে ফেলি ভালো হয়েছে তার মানে বুঝতে হবে অসাধারণ হয়েছে। মন খুলে বলতে না পারা মন খুলে ভালোবাতে না পারার দেশে ভালোবাসা দিবস তো আঁধারের পর একটুকরা সূর্যোদয়। যার আলোতে মনের বরফ গলে পড়ে। ঝকঝকে এক আকাশ এসে বলে, আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো ...

আমি ভালোবাসা দিবসে আপত্তি দেখি না। হোক তা ফুল বাণিজ্য।  বুকে আত দিয়ে বলুন তো আপনি বাঙালিকে পূজা বা শহিদ দিবস ব্যতীত আর কোনদিন এমন ফুল কিনতে দেখেন? তাও গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ? এই একদিনে রক্তে নয় গোলাপের লালে ভেসে যায় আমাদের সমাজ।  যে সমাজে মারধর নিষিদ্ধ নয় যেখানে নারী নিত্য অবমাননার শিকার যে দেশে চুমু খাওয়া অপরাধ বিদায়ী বা আগমনী চুম্বন ও নিষিদ্ধ সেখানে এই ভালোবাসা দিবস একটি সুখের নাম। এক পলক দেখা আর এক পশলা বৃষ্টির নাম।

ঘৃণা আমাদের ভালোলাগার বিষয়। আমাদের পছন্দ নিন্দা। আমরা অন্যের মন্দে উৎফুল্ল হতে ভালোবাসি: এমন একটা সমাজে ভালোবাসা দিবস নামে একটা দিন থাকলে কিসের ভয়? বরং মনে হবে আছে, একটি দিন তো আছে। যেদিন গামে ভেজা শরীরে এক তরুণ ছুটতে ছুটতে এসে তার প্রেমিকার হাঁটুর কাছে বসে বিদেশি ছবির কায়দায় বলবে, আই লাভ ইউ। ঘরে ফেরা মাঝবয়সী মানুষটি সন্তানদের চোখ এড়িয়ে বৌয়ের খোঁপায় বা আতে ফুল তুলে দিয়ে বলবে, তোমার লাইগা আনছি ....।

ভালোবাসা দিবস থাকল ভালোবাসা থাক আরো বেশি।

সিডনি থেকে

/এসবি/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়