ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আদমের পায়ের ছাপ দেখতে হবে পূর্ণিমা রাতে!

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদমের পায়ের ছাপ দেখতে হবে পূর্ণিমা রাতে!

আদম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত মন্দির। যেখানে আদমের পায়ের ছাপ রয়েছে।

আদম পাহাড়। অ্যাডামস পিক। এতো কাছে! হাত ছোঁয়া দূরত্বে। দশ বারো হাত উঠলেই পৌঁছে যাব পাহাড়ের চূড়ায়; যেখানে নেমেছিলেন সৃষ্টির প্রথম মানব আদম (আ.)। তার নামের সঙ্গে মিল রেখেই ওই পাহাড় চূড়ার নাম হয়েছে অ্যাডামস পিক।

রাত পৌনে তিনটার দিকে রওনা হয়েছিলাম। সকাল ৬টা ২৮ মিনিটে চূড়ার কাছাকাছি। মিনিট খানেক পথ বাকি। কিন্তু শরীর এতোটাই ক্লান্ত যে, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলাম। ওইটুকু পথই মনে হচ্ছিলো অনেক দূর। সহকর্মী মিলটন আর ফিরোজ আমার দিকে তাকিয়ে। তারা কিছুটা আগেই উঠে গেছে অ্যাডামস পিক এ। অপেক্ষা করছিলেন কখন আমি পা রাখব। এরপর একসঙ্গে নামতে শুরু করব।

পাহাড়ের মাথায় বেশ কিছু স্থাপনা আছে। দুতিনটে ছোট ভবন। যেখানে পূঁজারী, সিকিউরিটির লোকজন এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য কিছু মানুষ থাকেন। পূর্ব পাশের ভবনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সহকর্মীরা। আমাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায়! এসে গেছি! আমি সফল। আমি পেরেছি! এরকম এক জোশে উঠে গেলাম শেষ প্রান্তে! মিনিট দুয়েক লাগলো। আহা, স্বপ্নের সামিট!

পর্বতারোহীরা মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠে যেরকম প্রশান্তি বোধ করেন, সেরকম উপলব্ধি হচ্ছিলো আমারো। উঠেই একটা পরিষ্কার শান বাঁধানো জায়গা দেখে বসে পড়লাম। মিলটন আর ফিরোজ আলম তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত।

র্দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা শেষ হলো। কতবার স্বপ্নে দেখেছি অ্যাডামস পিকে গিয়েছি। অবশেষে সেই স্বপ্ন সত্যি হলো! কত রকমের ইচ্ছে থাকে মানুষের! আমারো এরকম একটা ইচ্ছে ছিলো- জীবনে একবার আদম পাহাড়ের চূড়ায় পা রাখতে চাই। আদম যেখানে প্রথম পা রেখেছিলো, সেখানে আমার পা-ও থাকবে। বিষয়টা আমার জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ এটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। যে বোঝার সে এমনিতেই বুঝবে।

অ্যাডামস পিক এর মূল গেট

বেশ কিছু কিশোর তরুণ হৈ চৈ করছিলো। লম্বা লাঠির মাথায় ক্যামেরা বসিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত ছিলো তারা। অনুমান করলাম তারা শ্রীলঙ্কান। হয়তো কোনো কলেজ থেকে গিয়েছিলো। তাদের আওয়াজে পাহাড়ের ঘুম ভাঙলো যেন। তাকিয়ে দেখছিলাম আশপাশের সব পাহাড়গুলো মেঘে ঢাকা। সূর্যের আলো পেলে কোনো এক মোহময়ী দৃশ্য নিশ্চয় দেখতে পেতাম। এই পাহাড়টির চারপাশে ছোট বড় আরো অনেকগুলো পাহাড়। এই জায়গাটা সবচেয়ে উঁচু বলে মেঘেরা ওখানে গিয়ে ধাক্কা খায়। ছড়িয়ে পড়ে, গড়িয়ে পড়ে, ঝরে পড়ে বৃষ্টি হয়ে।

অ্যাডামস পিক নিয়ে রেফারেন্স বই খুব একটা নেই। ‘দি সেক্রেট ফুট প্রিন্ট- এ কালচারাল হিস্ট্রি অব অ্যাডামস পিক’ নামে একটি বই রয়েছে। লেখক মার্কোস এ্যাকোসল্যান্ড। যাতে ওই পাহাড়ের নানা অজানা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বইটি এক রকমের দুষ্প্রাপ্য।

স্থানীয় দোকানদারদের কেউ একটা বুদ্ধি দিতে পারবেন যে, পিক-এও বইটা রাখলে ওই বই বিক্রি করে ভালো উপার্জন করা যেতো। কারণ যারা গাঁটের পয়সা খরচ করে ওখানে যান, তারা অন্তত এর ইতিহাস জানতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। দোকনদারেরা নানা রকমের জিনিস বিক্রি করেন, আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা মন্দির বানিয়ে টাকা খসানোর ফাঁদ বসিয়েছেন; কিন্তু দরকারি জিনিসটা তাদের কারো মাথায় নেই।

অ্যাডামস পিক এর ইতিহাস নিয়ে নানা রকম ঘোলাটে তথ্য রয়েছে। কোনটা সঠিক সেটাও বোঝার উপায় নেই। বলা হয়, ১৮৫১ সালে আরবের সোলায়মান নামে এক পর্যটকরে চোখে এই পদচিহ্ন প্রথম ধরা পড়ে। ভালো কথা। কোনো কিছু না জেনে ওই দুর্গম পাহাড়ে ওই আরব কেন গিয়েছিলো? শোনা যায়, বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলাসহ অনেক নামকরা পর্যটক ওই চূড়ায় আরোহন করেছেন। ইবনে বতুতা ওখানে উঠেছিলেন রত্নপূরা হয়ে। যে পথটি চূড়ার পশ্চিম দিকে নেমে গিয়েছে। তারা উঠেছিলেন ১২৯২ সালে। তারা নাকি চিন থেকে ভেনিস যাবার পথে ওই পাহাড় ভ্রমণ করেন। অবাক বিষয় হলো, কোথায় চীন, কোথায় ইতালীর ভেনিস আর কোথায় শ্রীলঙ্কা। বোকা পেয়ে যা বলছে, তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছে।

অনেকেই বলেছেন, মাত্র তিন মাস এই পাহাড়ে উঠা যায়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। অন্য সময় নাকি মেঘ বৃষ্টি তুষারপাত হয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন, অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত এখানে সহজেই যাওয়া যায়। অন্য সময় যে যাওয়া যায় না, তা কিন্তু নয়। অন্য সময়কে অফ সিজন বলা হয়। তবু বৃষ্টি ছাড়া আর কোনো বাঁধা নেই। যারা বলেন তুষারপাত হয়, একদম মিথ্যা কথা। কারণ শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ঠান্ডা যায়গা হচ্ছে নুয়ারা এলিয়া, সেখানে কালে ভদ্রে বরফ জমে। তবে তুষারপাত হয় না। কারণ শ্রীলঙ্কা সমুদ্র বেষ্টিত সমভাবাপন্ন আবহাওয়ার একটি ভূখণ্ড।

অ্যাডামস পিক এ মিলটনের সেলফি

আরেকটু ইতিহাস কঁপচিয়ে নিই। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজ এক পর্যটক এই চূড়ার নাম দেন পিকুডি অব আদম। অর্থ্যাৎ আদম চূড়া। তার আগে স্থানীয় ভাষায় এর নাম ছিলো সামান্থাকুটা। যার অর্থ ভোরের উদীয়মান সূর্য। উঁচু জায়গা থেকে সবার আগে সূর্য দেখা যায়। কিম্বা সূর্য সবার আগে শ্রীলঙ্কায় এই পাহাড়কে সাক্ষাত দেয়- এজন্যই এরকম নামকরণ হতে পারে।

যাহোক, ১৮১৬ সালে লে. ম্যালকম আদম চূড়া পরিমাপ করেন। ম্যালকমের সাহেবের পরিচয় জানি না। হতে পারে তিনি ব্রিটিশ আর্মির কেউ। পাহাড়ের মাথায় যে জায়গাটুকু তার দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট ও প্রস্থ ২৪ ফুট। যদিও পুরোটা সমতল নয়। সেখানে একটি পাথরখণ্ড রয়েছে, যার উচ্চতা ৮ ফুট। ওই পাথরের উপরেই সেই পায়ের ছাপ। এছাড়া তিন চারটে ছোট ছোট ভবন রয়েছে। আছে একটা মন্দির।

বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে ভিড় কিছুটা কমেছিলো। তরুণের দল অন্য প্রান্তে। জিজ্ঞেস করলাম মিলটনকে, ব্যাড লাক কেন? ব্যাড লাক খারাপ কীভাবে!

উত্তর যা পেলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শুনলাম মন্দির বন্ধ! মন্দির বন্ধ মানে আদমের পায়ের ছাপ দেখতে পাব না। কারণ ওই মন্দিরের ভেতরেই (পবিত্র) পায়ের ছাপ। কোথায় যে করেছিলাম পাপ!

কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেলাম। মন্দিরের ছোট্ট ছাউনি। তার সামনে ছোট্ট একটু খোলা যায়গা। সেটাও আবার লোহার শিক দিয়ে ঘেরাও করা। মূল ফটকে তালা। ওই তালা ঘিরে অসংখ্য মালা! সুঁতার মালা। নানা রঙের সুতা, কাপড়ের টুকরা বেঁধে রাখছিলো মানুষজন। নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান এই এলাকায় এসব রঙ্গিন সুঁতা বা কাপড়ের ব্যবহার দেখা যায়। মৃত প্রিয়জনকে স্মরণ করে এবং জীবিতদের মঙ্গল কামনায় এসব সুতা বাঁধেন পূঁজারীরা। মন্দিরের বেড়া জুড়ে ওইসব সুতা বা বস্ত্রখণ্ড। দেখলাম, মনে মনে মন্ত্র পড়ে কেউ কেউ ওই সতা বাঁধছিলেন। কেউ হাত জোড় করে মনোকামনা জানাচ্ছিলেন। ওম শান্তি! জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক।

আদমের পায়ের ছাপ

শুনেছিলাম, অ্যাডামস পিক এ উঠতে অনেক ভীড় থাকে। সেটা অবশ্য সিজনে। আমরা গিয়েছিলাম পুরো অফ সিজনে। সিজনে সেখানে মানুষের ভিড়ে নড়াচড়ার উপায় থাকে না। লোকজন উঠে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেয়- আর ওই কারণেই আরো ভিড় হয়। উপরে উঠতে অনেক সময় পর্যটকদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেজন্য সিঁড়িতে রেলিং দিয়ে দুটো ভাগ করা। উঠা নামার লাইন ঠিক রাখার জন্য।

জোরে বাতাস বইছিলো। বাতাসের সঙ্গে ছিলো মেঘ। ঘেমে যাওয়া শরীর জুড়িয়ে গেলো। একটু পরই ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলো। চলে গেলাম মন্দিরের পশ্চিম পাশে। সেদিকে আরেকটা পথ রয়েছে। সম্ভবত কেউ চাইলে পশ্চিমের ওই পথ দিয়েও অ্যাডামস পিক এ ওঠতে পারে। তবে ওই পথটি যে খুব কম প্রচলিত তা বোঝা যাচ্ছিলো। মনে হলো ওখান দিয়ে না যাওয়াই ভালো। অবশ্য ওই পথে কাউকে দেখলাম না। নিচে নেমে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলো পথটি। সেই তরুণের দলটি ওখানে গ্রুপ ছবি তুলছিলো। ওদের সুযোগ দিয়ে সরে গেলাম।

দাঁড়ালাম মূল বেদির সামনে। একেবারে প্রধান ফটকের সামনে। নিচু ছোট্ট মন্দির। বন্ধ যে বোঝা যাচ্ছিলো না কিছুই। ঘন মেঘ গিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলো সব। কাছের জিনিসও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো না। বাতাস ক্রমে বাড়তে শুরু করছিলো।

একবার ইউটিউবে দেখেছিলাম, হেলিকপ্টারে করে প্রেসিডেন্ট না কোন ভিআইপি ওখানে নেমেছিলেন। সেটি হয়তো অনেক আগের। তখন মন্দিরের সামনে একটু খোলা জায়গা ছিলো। আশপাশে আর কোনো স্থাপনা ছিলো না। কিন্তু এখন সম্ভব না। মন্দিরের সামনে হেলিকপ্টার নামার মতো খোলা যায়গা এখন আর নেই। আশপাশে ইটের ভবনও কয়েকটা উঠে গেছে।

খারাপ খবরতো আগেই বলেছিলাম। এবার শুনুন মূল কাহিনী। অফ সিজনে কেবল পূর্নিমা রাতে মন্দির খোলা থাকে। সুতরাং আদমের পায়ের ছাপ দেখতে হলে যেতে হবে পূর্ণিমা রাতে!

**




শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়