ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ট্রাম্পের ১০০ দিনে উত্তর কোরিয়ার হালহকিকত

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৫, ২৯ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ট্রাম্পের ১০০ দিনে উত্তর কোরিয়ার হালহকিকত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এ বছরের  ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক হওয়ার সময় উত্তর কোরিয়া নিয়ে তার নতুন প্রশাসনের নীতিগত অবস্থান পরিষ্কার ছিল না।

সেই থেকে এখন তিন মাস পার করছে ট্রাম্প প্রশাসন। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত কোরিয়া ইস্যুতে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের বিষয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউস এ ইস্যুতে বলে দিয়েছে, দীর্ঘদিনের ‘কৌশলগত ধৈর্যের দিন শেষ’।

তাহলে কি যুদ্ধের পথে হাঁটবে ধৈর্যহীন যুক্তরাষ্ট্র? কোরিয়া ইস্যুতে কি পরিবর্তন এলো যুক্তরাষ্ট্রের? আর ট্রাম্প আমলে উত্তর কোরিয়ার কী কী পরিবর্তন হলো, তার হালহকিকত দেখে নেওয়া যাক।

জানুয়ারি
ট্রাম্পের শপথের আগের দিন ১৯ জানুয়ারি উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব তাদের নিজস্ব ঢঙে তাকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এ দিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট পিয়ংইয়ংয়ের কাছে চামজিন ক্ষেপণাস্ত্র কারখানার কিছু ছবি তুলতে সক্ষম হয়। দুটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের (আইসিবিএম) প্রস্তুতির তথ্য পাওয়া যায় স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ট্রাম্পকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নেয় উত্তর কোরিয়া।

ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের ১০ দিন পরে ২৯ জানুয়ারি নতুন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস মাট্টিস তার প্রথম এশিয়া সফরের ঘোষণা দেন। তখন উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী প্রকল্প ‘৩৮ নর্থ’-এর স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশটি তাদের ইয়ংবিয়ন পরমাণু স্থাপনায় প্লুটোনাম চুল্লি চালু করতে যাচ্ছে।

ফেব্রুয়ারি
কোরীয় উপদ্বীপ নিয়ে ট্রাম্প টিমের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ২ ফেব্রুয়ারি, যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাট্টিস সিউলের পাশে যুক্তরাষ্ট্রের ওসান বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন থেকে দিক্ষণ কোরিয়াকে রক্ষা করতে সেদেশে ‘থাড’ মোতায়েন করার পরিকল্পনা পাকাপাকি করা। থাড হলো এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

এর তিন দিন পর ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পূর্ব এশীয় মিত্র জাপান যৌথভাবে মধ্যপাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সফল হয়। এর উত্তর দিতে বেশি দিন দেরি করেনি উত্তর কোরিয়া। ১১ ফেব্রুয়ারি দেশটি দাবি করে, তারা নতুন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষায় সফল হয়েছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।

 



এরপর উত্তর কোরিয়ার ঘটনাপ্রবাহে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যায়। ১৪ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে বিমানবন্দরে দেশটির সন্দেহভাজন চররা কিম জং-উনের সৎভাই কিম জং-ন্যামকে নার্ভ এজেন্ট ‘ভিএক্স’ প্রয়োগ করে হত্যা করে।

এ ঘটনার পর উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় ও কোরীয় উপদ্বীপ নিয়ে বিবদমান উত্তেজনার মুখে উত্তর কোরিয়া থেকে কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করে চীন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়াকে চাপে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানায় চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

মার্চ
এ মাসে কোরীয় উপদ্বীপে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছিল। মার্চের ৬ তারিখ উত্তর কোরিয়া জাপান সাগরে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ ঘটনাকে ‘চরম ভয়ানক কাজ’ বলে উল্লেখ করেন।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কেসিএনএ জানায়, তাদের হোয়াসং আর্টিলারি ইউনিট জাপানে আমেরিকার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। চারটির মধ্যে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের জলসীমার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে আঘাত হানে।

উত্তর কোরিয়ার একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মুখে দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সরঞ্জামাদি আনে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই হুঁশিয়ার করে বলেন, দুই পক্ষ সংঘর্ষের মুখে রয়েছে।

১৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা হিসেবে জাপান সাগরে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। এর পরের দিন ১৫ মার্চ জাপান সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন।

এর পাঁচ দিন পর একটি রকেট ইঞ্জিন পরীক্ষা করে উত্তেজনার আগুনে আবার ঘি ঢালে উত্তর কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং জাপান উত্তর কোরিয়ার যেকোনো হামলা মোকাবিলায় সামরিক প্রস্তুতি জোরদারের ঘোষণা দেয়।

এদিকে, রকেট ইঞ্জিন পরীক্ষার কয়েক দিনের মাথায় আবার একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় সফল হওয়ার দাবি করে উত্তর কোরিয়া। এ ধরনের ইঞ্জিন আইসিবিএমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-৩৫বি মোতায়েন করবে। সামরিক মহড়ায় অংশ নেওয়ার কথা বলে এফ-৩৫বি দেশটিতে আনা হয়।

এপ্রিল
এই মাসের ২ তারিখে ট্রাম্পের কড়া হুঁশিয়ার মধ্য দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, যদি চীন পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একাই উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে যা করার তা-ই করবে।

এর দুদিন পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে উত্তর কোরিয়া আবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। ওই সময় সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক হামলার অজুহাত দেখিয়ে দেশটির সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ায়ও একই ধরনের হামলার ইঙ্গিত দেন।

 



১০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন কোরীয় উপদ্বীপে ভেড়ালে এর কড়া জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেয় উত্তর কোরিয়া। একে আগ্রাসী তৎপরতা হিসেবে অভিহিত করে দেশটি। কয়েক দিন পর ‘৩৮ নর্থ’ পর্যবেক্ষণ গ্রুপ দাবি করে, ষষ্ঠ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়েছে উত্তর কোরিয়ার পুঙ্গে-রি পরমাণুকেন্দ্র। ১৩ এপ্রিল জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে দাবি করেন, সারিন নার্ভ এজেন্টযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সক্ষমতা রয়েছে উত্তর কোরিয়ার।

এই উত্তেজনার মধ্যে আফগানিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সুড়ঙ্গ-আস্তান লক্ষ্য করে সবচেয়ে বড় অ-পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। কোনো হামলায় এ ধরনের বোমার ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম। এ হামলাকে উত্তর কোরিয়ার জন্য হুঁশিয়ারি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এর দুদিন পরে উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বিশাল সামরিক মহড়া ও সমরশক্তির প্রদর্শন করে দেশটি। এ দিনে নতুন মিসাইল ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণযন্ত্রও দেখানো হয়।

১৬ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। এর পরের দিন দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত পরিদর্শন করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তখন তিনি বলেন, কৌশলগত ধৈর্যের দিন শেষ। তিনি হুশিয়ার করে বলেন, ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে পরীক্ষা করো না।

মাইক পেন্সের বক্তব্যের জবাবে জাতিসংঘে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার উপ-রাষ্ট্রদূত কিম ইং রিয়ং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম ও হম্বিতম্বিতে পরমাণু যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র কার্ল ভিনসনের অবস্থান নিয়ে নতুন তথ্য দেয়। এটি যেখানে মোতায়েন করার কথা ছিল তার ঠিক উল্টো দিকে ৩ হাজার ৫০০ মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে সামরিক মহড়ার জন্য নেওয়া হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর স্ট্রাইক গ্রুপ এপ্রিলের শেষ নাগাদ কোরীয় উপদ্বীপে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কর্মকর্তা।

১৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র জানায়, মে মাসে তারা দুটি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখবে, সেগুলো উত্তর কোরিয়া থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারবে। ১৯ এপ্রিল জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে রাশিয়া তাতে ভেটো দেয়। ওই দিন চীনের পক্ষ থেকেও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়।

২০ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিক নিন্দা জানায়। তারা দেশটিকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা থেকে বিরত রাখার বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ মত দেয়।

বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যেই ২৯ এপ্রিল আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে উত্তর কোরিয়া, যা জাপান সাগরে পৌঁছানোর আগে তাদের নিজ ভূখণ্ডের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়েছে।

বিশ্ব সম্প্রদায় যতই হুমকি দিচ্ছে, উত্তর কোরিয়া ততই ফুঁসে উঠছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার নাকের ডগায় বারবার সামরিক মহড়া চালিয়ে দেশটিকে যতই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তারা ততই ক্ষেপে গিয়ে নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়, তা বলা মুশকিল।

তথ্যসূত্র : সিএনএন অনলাইন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ এপ্রিল ২০১৭/রাসেল পারভেজ/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়