ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

স্মরণ : কাজী আবদুল ওদুদ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ১৯ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মরণ : কাজী আবদুল ওদুদ

কাজী আবদুল ওদুদ

শাহ মতিন টিপু : কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় সংঘটিত ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ এর একজন পথিকৃৎ । বিংশ শতকের টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়েও যখন মুসলিম সাহিত্যিকগণ নিজস্ব-বৈরী খোলস থেকে বের হতে পারছিলেন না, ঠিক সেই মুহূর্তে কাজী আবদুল ওদুদ অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে মুক্তচিন্তার পতাকাবাহক হয়ে এগিয়ে এলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

 

এই প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আর এর মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। ‘শিখা’ ছিল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে গঠিত বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিকত্ব ও অগ্রগতির অবিস্মরণীয় স্মারক। এই পত্রিকার স্লোগান ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ আমাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ইতিহাস মূল্যায়ন করতে হলে ফিরে তাকাতে হবে ওদুদের মতো মনীষার দিকেই।

 

কাজী আবদুল ওদুদের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭০ সালের ১৯ মে কলকাতায় মারা যান। এ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুরের পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তার বাবা কাজী সৈয়দ হোসেন ছিলেন রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার। তার মায়ের নাম খোদেজা খাতুন। আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৫ সালে আইএ ও ১৯১৭ সালে বিএ পাস করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ করেন।

 

কাজী আবদুল ওদুদ যে কেবল প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন সেই সময়ে সংঘটিত হিন্দু-মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা ও বিদ্বেষভাবাপন্নতারও একজন যুক্তিবাদী বিশ্লেষক। তিনি রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জার্মান কবি গ্যেটেকে জীবনের আদর্শরূপে গ্রহণ করে ছিলেন। শিখা গোষ্ঠী ছিল বাংলাদেশের একটি বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনের দল, যা ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শিখা পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে গঠিত হয়। শিখা গোষ্ঠীর কর্ণধার ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ এবং আবুল হুসাইন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মাত্র এক দশক চলেছিল এই ঢাকাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীটির কার্যক্রম।

 

আবদুল ওদুদ ছাত্রাবস্থায়ই সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ওই সময় তার গল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’ (১৯১৮) ও উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এমএ পাসের পর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন ছিলেন। এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই।

 

তবে তার চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’র প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তিনিও যুক্ত ছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, উনিশ শতকে একটি রেনেসাঁস সংঘটিত হয়েছে, যার একটি বক্তব্য হল ‘স্বদেশপ্রেমে দোষ নেই যতক্ষণ স্বাদেশিকতা না হয় বিশ্ববিমুখ’।

 

‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’ তাত্ত্বিক ও কর্মীপুরুষ হিসেবে অবদানের জন্য তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। কথাশিল্পী, সংগঠক, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, চিন্তানায়ক, সাময়িকপত্র-সম্পাদক, অনুবাদক, অভিধান-প্রণেতা প্রভৃতি পরিচয়ে তার অবদান স্বতন্ত্র ও তাৎপর্যময়। চিন্তার ক্ষেত্রে স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ওদুদের ভাষাকে ভাবগম্ভীর করলেও পরিচ্ছন্ন চিন্তার জন্য তা দুর্বোধ্য না হয়ে বরং প্রাঞ্জল হয়েছে।

 

কাজী আবদুল ওদুদ আলোচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘তরুণ’ (১৯৪৮), উপন্যাস ‘আজাদ’ (১৯৪৮), নাটক ‘পথ ও বিপথ’ (১৯৩৯) ও ‘মানব-বন্ধু’ (১৯৪১)। এ ছাড়া তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের বই লিখেছেন শাশ্বত বঙ্গ (১৯৫১), বাংলার জাগরণ (১৩৬৩), কবিগুরু গ্যেটে (১ম ও ২য় খন্ড ১৩৫৩), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম খন্ড ১৩৬৯, ২য় খন্ড ১৩৭৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩), নবপর্যায় (১ম খন্ড ১৩৩৩, ২য় খন্ড ১৩৩৬), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪২), ফান্ডামেন্টালস অব ইসলাম (১৩৫৭), স্টেট এ্যান্ড লিটারেচার (১৩৬৪), টেগোরস রোল ইন দ্য রিকন্ট্রাকশন অব ইন্ডিয়ান থট (১৩৬৮), আজকার কথা (১৩৪৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৩৫৮), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), নজরুল-প্রতিভা (১৩৫৬), শরৎচন্দ্র ও তারপর (১৩৬৮), ক্রিয়েটিভ বেঙ্গল (১৩৫৭), পবিত্র কোরআন (১ম ভাগ ১৩৭৩, ২য় ভাগ ১৩৭৪)।

 

এ ছাড়াও রয়েছে কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী (১ম খন্ড ১৯৮৮, ২য় খন্ড ১৯৯০, ৩য় খন্ড ১৯৯২, ৪র্থ খন্ড ১৯৯৩, ৫ম খন্ড ১৯৯৪ ও ৬ষ্ঠ খন্ড ১৯৯৫) এবং কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাবলী (১৯৯৯)। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’। আধুনিক বাংলা ভাষার এ জনপ্রিয় অভিধানে তার ভাষা সচেতন মনের পরিচয় মেলে। তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

 

কাজী আবদুল ওদুদ কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রিডারের পদ সৃষ্টি করে। তিনি ওই পদে কলকাতার শিক্ষা দফতরে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই পদের সঙ্গে রেজিস্ট্রার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। আবদুল ওদুদ এ পদ থেকে ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।

 

কাজী আবদুল ওদুদের লেখক হিসেবে পরিচিতি, প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির মূলে রয়েছে তার প্রবন্ধ ও সমালোচনা। বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কার থেকে মুক্তি এবং নবজীবনচেতনায় উত্তরণে ওদুদের অবদান অনস্বীকার্য। মননঋদ্ধ প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলার মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাসে তিনি অনুসরণীয় চিন্তানায়ক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৬/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়