ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একটি হ্যান্ডশেক ও হাজার দীর্ঘশ্বাস

মঞ্জু সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৬, ১৫ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১৭:১০, ২৮ আগস্ট ২০২০
একটি হ্যান্ডশেক ও হাজার দীর্ঘশ্বাস

নেতা, দল ও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হলে কীরকম আত্মশক্তি বাড়ে,  সেটা আমি কৈশোরেই তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছিলাম বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে। সময়টা ছিল ১৯৬৯-৭০-এর আন্দোলন পর্ব।  সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে যে জাতীয় নির্বাচন হয় এবং যে নির্বাচনে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের নিরঙ্কুশ জনসমর্থন প্রমাণিত হয়, সেই নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু একদিন গিয়েছিলেন রংপুরে। উদ্দেশ্য জনসভা ও কর্মীসভা করা। কর্মীসভায় উপস্থিত হলে আমার সুযোগ হয় তাঁর সঙ্গে করমর্দন করার এবং ব্যক্তিগতভাবে নিকট-সান্নিধ্যে আসার। বড়জোর মিনিটখানেক বয়সী অবিস্মরণীয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি আমার পরবর্তী জীবনে কী দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছে, তরুণ বয়সে  যেসব কাণ্ডকীর্তি করেছি- আজ তোমাকে খুলে বলতে চাই।  তুমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের জোর নিয়ে গল্প লিখতে চাইছো। আমার জীবনের সত্য গল্প তোমার কাজে লাগতে পারে।

আমার ঘনিষ্ঠ এই লেখক বন্ধুটি মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ- জাতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক নিয়ে অনেকগুলি গল্প-উপন্যাস লিখেছে। কিন্তু আমাকেও তার গল্পের নায়ক করার অনাগ্রহে তাচ্ছিল্যে ও সন্দেহভরা দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ করে বলল, ‘তুমি তো কখনো তাঁর দল করোনি। সেভাবে রাজনীতিও করোনি জানি। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তাঁর দল রাষ্ট্রক্ষমতায়। সরকারিভাবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে। অতএব বন্ধবন্ধুর সঙ্গে একটা সম্পর্কের স্মৃতি বানিয়ে বলে কি ফায়দা লোটার মতলব করছো?’

সমাজসচেতন ও সৎ লেখক বন্ধুর এরকম সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনার পরও মতলববাজ বলায় রেগে জবাব দেই- কোনো মতলব নেই হে। বরং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামান্য এই ঘনিষ্ঠতার স্মৃতি আমাকে ক্ষমতা ও সুবিধাবাদী মতলববাজদের কাছ থেকে দূরে থাকতে প্রেরণা দিয়েছিল। সেটা বোঝানোর জন্য নিজের জীবনের সত্যি গল্প তোমাকে শোনাতে চেয়েছিলাম। শোনা কিংবা না-শোনা এবং লেখা কিংবা না-লেখা তোমার ইচ্ছে। 

সত্যসন্ধানী লেখক বন্ধু এবার আগ্রহ বোধ করে। তার কৌতূহল ও জেরার মুখে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্কের স্মৃতি খুঁটিনাটি বলতে হয়। শুরু করি  ছেলেবেলা থেকে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে, সত্তরের সেই নির্বাচনের আগে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ৬ দফা,  ১১ দফা, স্বৈরাচারি সামরিক শাসন ও শোষণ উচ্ছেদের ধারাবাহিক আন্দোলন হয়। আন্দোলনের  এই উত্তপ্ত সময় আমি ছিলাম রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন হাইস্কুলের ছাত্র। স্কুলটা ছিল যেহেতু শহরের কেন্দ্রীয় বাজার ও মেইনরোডের নিকটবর্তী, রাস্তায় মিছিল-আন্দোলন হলে তার উত্তাপ স্কুলের ভেতরেও পৌঁছে যেত। স্বৈরাচার-সামরিক শাসন হঠানো আন্দোলনে রাস্তায় দীর্ঘ লড়াকু মিছিল নামলে, একদিন কিছু ছাত্রনেতা আমাদের স্কুলে ঢুকে ক্লাস বন্ধ ও মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানায়। আমরা যারা নাইন-টেনের ছাত্র, সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকজন মিছিলে যাই। সেটাই আমার প্রথম মিছিল করা। হাতে ছিল বই, পরনে স্কুলড্রেস- ব্লু জামা আর সাদা পাজামা। মিছিলে নেমে কলেজ ছাত্রদের মতো গলা ফাটিয়ে স্বৈরাচারের গদিতে আগুন দিতে ইচ্ছে করে, আবার ভয়ও হয়। আমার এক বন্ধু পেছনে পুলিশের গাড়ি দেখিয়ে কানে কানে আরো ভয় দেখায়, গোয়েন্দা টিকটিকিরা কিন্তু আমাদের ফলো করছে রে! রিপোর্ট দেবে।

আন্দোলনের উত্তাপে দ্বিধা-ভয় কাটতেও সময় লাগে না। দীর্ঘ দুই সারি ছাত্র-জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক ছাত্রনেতা স্লোগানের প্রথম অংশ হাঁকে, বাকি ছাত্ররা সম্মিলিত কণ্ঠে জবাব দেয়। নেতার কৌতূহলী দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হলে, আমিও ক্রমে মৃদুমন্দ স্বর থেকে গলা সপ্তমে তুলি, স্লোগানের সঙ্গে হাতও তুলি। নেতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখেন। মিছিলের মুখচেনা এই ছাত্রনেতার সঙ্গে পরে কীভাবে কিছুটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত গড়ায়, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানে কিছুটা আত্মকথন জরুরি।

আন্দোলন-মিছিলের উত্তেজনা থেকে আনন্দ লাভের আগেই ক্লাস নাইন-টেনে থাকতেই বখে গিয়েছিলাম অনেকটা। মানুষ হওয়ার ধারণাতেও পরিবর্তন এসেছিল। ঘোর মফস্বলের ছেলে আমি। গ্রামে থাকলে মানুষ হবো না বলেই বাবা শহরে রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। একেবারে বালক বয়সে জন্মভূমি ও মায়ের আদর থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ায় কষ্টে কান্না পেত, লুকিয়ে কাঁদতামও। অন্যদিকে অভিভাবকের প্রত্যক্ষ শাসনমুক্ত ছিলাম বলে শহরে ঘোরাফেরার স্বাধীনতা ছিল বেশি। তাছাড়া  স্বভাবগতভাবে আমি ছিলাম ঘাড়তেঁড়া টাইপের। নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে বিদ্রোহী হওয়ার প্রবণতা নিয়ে জন্মেছিলাম সম্ভবত।

সাহিত্যের পোকার সঙ্গে মাথায় রাজনীতির উত্তেজনা ঢোকার পরপর শুধু মিছিলে নেমেই চুপচাপ থাকিনি। রাজনৈতিক সভা শুনতেও যেতাম। সন্ধ্যাবেলায় শহরের যেসব চায়ের দোকানে বয়োজ্যেষ্ঠ যুবকরা চা-সিগ্রেটের সঙ্গে আড্ডা জমায়, বন্ধুবান্ধব পেলে মাঝেমধ্যে আমিও সেরকম আড্ডা দিতে যেতাম। এক সান্ধ্য আড্ডায় আলাপ-পরিচয় হলো মিছিলে দেখা মুখচেনা ছাত্রনেতা হারেস ভাইয়ের সঙ্গে। তিনিই জানালেন, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, শিগগির তিনি রংপুরে জনসভা ও কর্মীসভা করতে আসবেন। তার আগে তোমরাও স্কুলে ছাত্রলীগের একটা কমিটি করে ফেল। তাহলে কর্মীসভায় তোমরাও উপস্থিত থেকে নেতার ভাষণ শুনতে পারবে।

হারেস ভাই বলার আগেই মুজিবের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আমার ধারণা হয়েছিল মুজিবভক্ত পিতার কারণেও। গ্রাম পর্যাযে সে বঙ্গবন্ধুর দলের নেতাও বটে। কাজেই এত বড় নেতাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগটি নেওয়ার জন্য স্কুলের কয়েক বন্ধুকে ছাত্রলীগের স্কুল শাখা বানাতে উৎসাহী করে ফেললাম। একদিন দশ পনেরজনের উৎসাহী ছাত্রের ঘরোয়া সভায় কমিটি করে দিতে হারেস ভাই এলেন। সভাপতি হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করলেন হারেস ভাই স্বয়ং। এক সহপাঠী মৃদু আপত্তি দেখাতে আমার কবি পরিচয়টাও ফাঁস করে দেয়। তাতে হারেস ভাই আরো উৎসাহিত হয়ে আমাকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্তের মতো দেশাত্মবোধক কবিতা লিখতে উপদেশ দেন। হারেস ভাই নিজে তো বটেই, বঙ্গবন্ধুও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত বলে জানান।

হারেস ভাই স্কুলে যে কমিটি করে দিলেন, সেই কমিটির কার্যক্রম স্কুলে তেমন না থাকায় স্কুলের আধিকাংশ ছাত্র-শিক্ষক জানতেন না। কাজেই নেতা হিসেবে স্কুলে নাম-প্রতিষ্ঠা তেমন হলো না আমার। তবে কমিটির সভাপতি হয়ে হারেস ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। ছাত্রলীগের এক কর্মী সভায় তিনি আমার লেখা কবিতা আবৃত্তি করারও সুযোগ করে দিলেন। সেই প্রথম বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্রদের ভিড়ে মাইকে কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে পা ও গলা দুটোই কেঁপেছিল। তবে প্রচুর হাততালি যে পেয়েছিলাম, সেই আওয়াজ কানে বাজে এখনও।

এখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিতে আসি। তারিখটি মনে নেই, তবে বঙ্গবন্ধুর আগমনে কর্মীসভার আয়োজন করা হয়েছিল রংপুরের মডার্ন, তথা বর্তমানের টাউন হলে। হারেস ভাইয়ের সৌজন্যে কর্মী সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আমাদের স্কুল কমিটির জন্যও দুটি পাশ দেয়া হয়েছিল। এই প্রথম বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখব, সরাসরি তার ভাষণ শুনব। উত্তেজনা-অস্থিরতা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মডার্ন হলে উপস্থিত হই।

একা আমি তো নই, বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা ও তার ভাষণ শোনার জন্য জেলার সব নেতাকর্মীরাই হলে ভিড় জমিয়েছে।  ঢাকার আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ টাউন হলে সন্ধ্যার পর বক্তৃতা করবেন তিনি। তার আগেই নেতা-কর্মীতে হল ভরে গেছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহরকে রাস্তা থেকে হল পর্যন্ত বরণ করে নেওয়ার জন্য যেসব ছাত্রনেতা-কর্মী অপেক্ষা করছিল, তাদের সঙ্গে ছিলাম আমিও। নেতার গাড়ি রাস্তায় থাকতেই তাঁর গাড়ির দুপাশে স্কট করে কর্মীরা স্লোগান দেয়- মুজিব তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সনে, জয় বাংলা,  জয় বঙ্গবন্ধু।

গাড়ির উইন্ডোগ্লাস খুলে বঙ্গবন্ধু হাত নাড়েন। অনেক কর্মীর সঙ্গে হাতও মেলান। নেতার চোখে পড়ার জন্য এবং তাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য উদগ্রীব সবাই। এ জন্যে গলা ছেড়ে স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি গাড়ির সঙ্গে দৌড়ায় সবাই। আমিও ছিলাম এই  দৌড় প্রতিযোগিতায়। গাড়ি থেকে নামার পর স্থানীয় নেতা-কর্মী পরিবেষ্টিত ভিড়ের দিকে সহাস্য তাকান তিনি। হাত মেলান অনেকের সঙ্গে। গাড়ির সঙ্গে দৌড়েছিলাম বলে ঐ সময় আমার অবস্থান ছিল বঙ্গবন্ধুর একান্ত সামনে। অভিভূত হয়ে দেখছি নেতাকে। নেতা-কর্মীদের মাঝে বয়সে ও চেহারায় ছোটখাটো কিশোর হওয়ার কারণেই সম্ভবত, আমি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হই। আমার দিকেও হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। হ্যান্ডশেক করেই হাত ছাড়িয়ে নেন না, কৌতূহলী দৃষ্টিতে কী যেন জিজ্ঞেস করেন। পাশে উপস্থিত ছাত্রনেতা জবাব দেয়, ও আমাদের কর্মী মুজিব ভাই, স্কুল কমিটিতে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে কী যেন বলেন, ওই সময়ে ছাত্ররা স্লোগান তোলায় ভালো শুনতে পাই না। এরপর স্থানীয়  নেতাদের স্বাগতম-ধ্বনির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতাদের নিয়ে হলের ভেতরে সরাসরি মঞ্চে চলে যান।

মঞ্চে বসা বঙ্গবন্ধুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি নিজের হাতে তাঁর হাত ছোঁয়ার শিহরণ অনুভব করি। যে নেতার বজ্রহুঙ্কারে আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানের মতো দুর্ধর্ষ সামরিক শাসকরাও ভয়ে গদি ছেড়ে ইঁদুরের মতো পালায়, ভেবেছিলাম তাঁর হাত লোহার মতো শক্ত হবে। কিন্তু আমার হাত চেপে ধরায় তাঁর হাতের নরম ও উষ্ণ স্পর্শ জীবনেও ভুলব না আমি। মঞ্চে পাশে উপবিষ্ট তাজউদ্দিনের কানে কানে কী যেন বলছেন বঙ্গবন্ধু। আমার কানেও বাজে তার কণ্ঠস্বর: এই ছেলে কে? কোথায় পড়ো? লেখাপড়া ভালো করে করবা। স্নোহভরা কণ্ঠে এরকম কিছু তিনি বলেছেন নিশ্চয়। আহা! আমার মুজিবভক্ত পিতা যদি তার ছেলের সঙ্গে নেতার এই সম্পর্কের দৃশ্যটা স্বচক্ষে দেখত আজ, আমার মানুষ হওয়া নিয়ে কোনো সংশয় জাগত না আর!

বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেয়ার আগে অন্য নেতারা ভাষণ দেন।  নেতাদের ভাষণ শুনলেও আমার দৃষ্টি বঙ্গবন্ধুর দিকে একাগ্র। ভাষণের মাঝে মঞ্চে উপস্থিত ছাত্রনেতারা মাইকে স্লোগান হাঁকলে, জবাবে কর্মীদের সম্মিলিত কণ্ঠের স্লোগানে হলঘর গমগম করে। আমিও হাত ছুড়ে গলা সপ্তমে তুলে স্লোগানে শরিক হই। কিন্তু অতদূর থেকে বঙ্গবন্ধু কি আমাকে শনাক্ত করতে পারছেন?

অবশেষে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু। পঞ্চাশ বছর আগে শোনা সেই ভাষণের সব কথা মনে নেই আজ। তবে ভাষণের দুটি কথা অসংখ্যবার মনে করেছি বলে এখনো হুবহু কানে বাজে। কথাগুলো নিজের জীবনের সঙ্গে খুব মিলে গেছে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করেছি বলেই হয়তো-বা।

প্রথম কথাটি ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বাঙালি চরিত্র প্রসঙ্গে বলেছিলেন- ‘মনে রাখবা, বাঙালির মন বর্ষার কাদার মতো নরম, কিন্তু এই মাটি যখন চৈত্রমাসের রোদে শুকিয়ে শক্ত ঢেলা হয়, তাকে মুগুড় মেরেও শেষ করা যায় না।’ শুনেই  মনে হয়েছিল, নিজে ষোল আনা বাঙালি বলে বঙ্গবন্ধুর মনটাও আসলে এরকম। একটু আগে হ্যান্ডশেকের সময় যেমন তাঁর দরদি নরম মনটার পরিচয় পেয়েছি, এখন ভাষণের সময় বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রশ্নে সেই মনটাই যেন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। পরে নিজের এবং পরিচিত বহু বাঙালির কোমল-কঠিনের আবেগময় প্রকাশ দেখেও মনে পড়েছে, বঙ্গবন্ধু খাঁটি কথাই বলেছিলেন।

স্মৃতিতে অম্লান তাঁর দ্বিতীয় উক্তিটা ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার প্রসঙ্গে। নিজেকে বাঙালি দাবি করে তিনি ধর্মান্ধ রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘পানির জন্য নদীর ঘাটে ও খালে-বিলে না গেলে আমার বাঙলার মা-বোনদের চলে না, আর তোমরা তাদের বোরখা পরানোর কথা বলো!’ বঙ্গবন্ধুর এই কথাটাকেও খুব খাঁটি মনে হয়েছিল কিশোর বয়সেও। এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার দেখে, এমনকি বিসমিল্লাহ ইনসাল্লাহও হাতিয়ার হয়ে উঠলে যেমন মনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শ, তেমনি দেশের মেয়েদের সম্পর্কে মোল্লা-মওলানাদের ফতোয়া শুনে অনেকবার মনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটা। কৈশোর-যৌবনে নিজের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র গঠনে বঙ্গবন্ধুই প্রেরণার বড় উৎস ছিলেন অবশ্যই। গ্রামে ধর্মান্ধ পরিবারে গৃহবন্দি এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়ার স্বার্থেও বঙ্গবন্ধুর উক্তিটাকে ব্যবহার করেছিলাম আমি। কিন্তু মহাপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব বোঝাতে সেই প্রেমের গল্প তোমাকে আর শোনাতে চাই না।

এ পর্যন্ত শুনে আমার লেখক বন্ধুটি হাসে। বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে আমার কথা, এবার বাঁকা হাসি দিয়ে মন্তব্য করল, ‘শৈশব-কৈশোরের বহু স্মৃতি মানুষের জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকে। মানলাম বঙ্গবন্ধুকে জীবনে প্রথম দেখা ও তাঁর প্রথম ভাষণ মনে দাগ কেটেছিল, যা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। কিন্তু এই সম্পর্কের জোর তোমার জীবনে এমন কি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, যার ফলে দেশ ও মানুষের স্বার্থে সামান্য ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখেছো? কবিতায় দেশপ্রেম ফলানো ছাড়া কী এমন কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছো যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে নিয়েও গল্প লিখতে হবে?’

এ প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার জন্য আমার জীবনী কিংবা আমাকে নিয়ে উপন্যাস তোমাকে লিখতে হবে না। আমি নিজের সামান্য ব্যক্তিজীবনে এবং আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বাঙালি জাতির উপরে বঙ্গবন্ধুর যে জাদুকরি প্রভাব দেখেছি, তার কয়েটি ছোটখাটো তথ্য ও সত্য গল্প তোমাকে শোনাতে চাই।

বঙ্গবন্ধুর মতো কিংবদন্তি ও প্রভাবশালি নেতার সঙ্গে হাত মেলানোর পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কবিতা লেখার পাশাপাশি রাজনীতিও করব। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা হতে পারব না ঠিক, কিন্তু বাঙালি প্রেমিক মাঝারি নেতা-কর্মী হতে পারলেও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে কি কম বড় মানুষ হওয়া হবে? বঙ্গবন্ধুর সেই মিটিং-এর পরই নিজের কবি নামটিরও বাঙালিকরণ, অর্থাৎ নামের আগে যুক্ত আরবি নাম মোহাম্মদও বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রবীন্দ্র-নজরুলের মতো মাথায় ঝাকড়া চুল নয় শুধু, যুবা বয়স থেকে মুজিবের মতো গোঁফটাও রাখব। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার মতো মাথার হাউসের বাবড়ি উধাও হয়ে গেছে। গোঁফের নিশানা এখনো আছে কিন্তু।

যা হোক, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বলি এবার। হাই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ছিলাম, ম্যাট্রিক পাশের পর সত্তরেই কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হলাম আর্টস বিভাগে। কলেজে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানগম্যি বাড়ানো ও ছাত্ররাজনীতি করাটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। তারচেয়েও কলেজ পড়ার বড় কারণ ছিল, বাড়ি থেকে পিতার কাছে নিয়মিত টাকা পাওয়া। কিন্তু কলেজে সাহিত্য বা রাজনীতির অঙ্গনে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার আগেই এলো একাত্তরের মার্চ মাস। মার্চের প্রথম সপ্তাহের আন্দোলন-উত্তেজনায় একাত্ম থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। কারণ লেখাপড়া, মানুষ হওয়ার ধারণা ও শহরে থেকে অর্থ অপচয়ের অভিযোগ ওঠায় বাবার সঙ্গে বিরোধ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বাড়ির রেডিওতে বাবার সঙ্গে মুজিবের দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ শুনে দূরত্বটা কমাতে  চেয়েছিলাম। আমার পিতা ছাড়াও গ্রামে মুজিবভক্ত লোকের অভাব ছিল না, যারা আমার মুজিবের সঙ্গে হাত মেলানোর গল্প শুনে যোগ্য পিতার উপযুক্ত ছেলে বলে বাহবাও দিয়েছিলেন আমাকে।

রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য আমাদের বাড়িতে ছোটখাটো জনসভার মতো ভিড় তৈরি হয়েছিল। গাঁয়ের নিরক্ষর সাধারণ চাষী-মজুরদের বঙ্গবন্ধুর উপর অগাধ আস্থা এবং লড়াকু আবেগ দেখে অবাক হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এলাকায় স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছিল যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন থেকেই। আর এই লড়াইয়ে বাবার চেয়ে আমার তৎপরতাই ছিল বেশি, বলতে পারো নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছি। গাঁয়ের লোকজন যেহেতু যুদ্ধের সময়েও ফসল ফলানো ও ঘরগেরস্তি সামালানোর কাজে ব্যস্ত থাকে, অন্যদিকে একমাত্র আমি যেহেতু সারাদিন রেডিও শুনি ও খবরের কাগজ পড়ি, শহরের আন্দোলন, পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন এবং যুদ্ধের খবর শুনিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গ্রামবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ও চাঙ্গা রাখাটাই হয়ে দাঁড়ায় আমার বড় কাজ। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় আট মাস পর্যন্ত নিজগ্রামে থেকে এই দায়িত্ব পালন করেছি।

লেখক বন্ধু আবার খোঁচা দিলো, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষণা করে যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার ডাক দিয়েছিলেন। তুমি তাহলে রেডিও শুনেই নিরাপদে গ্রামে থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা পার করেছো, মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর চেষ্টাও করোনি?’

আগে সবটা শোনো আমার কথা। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম বলেই তো লাখো যুবকের উপর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের প্রভাব-পরিণতির অনেকটাই চাক্ষুষ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ সম্পর্কে তোমাকে বলার আগে নিজের ব্যক্তিগত একটি দুর্বলতার কথাও এখানে কবুল করছি। মুক্তিযুদ্ধের সাত-আট মাস আমি যে গ্রামে বসে শুধু রেডিও শুনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চাঙ্গা করেছি তা নয়, লুকিয়ে-চুরিয়ে একটা প্রেমও করেছি। সেই প্রেমিকার টানও ছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার একটা কারণ। ব্যক্তিপ্রেম ও দেশপ্রেমের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের আহ্বান শোনার পর কতো ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে প্রাণ হাতে যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর বাঁচা-মরার খবর নিশ্চিত কেউ জানে না। পাকবাহিনী আমাদের গ্রামেও হানা দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে সবকিছু। আর এই আতঙ্ক ও টেনশনের মাঝেও আমি গ্রামে বসে প্রেম করার আনন্দ খুঁজছি। অবশেষে গ্রামে দেশি রাজাকারদের উপদ্রব ও অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় আমার ব্যক্তিপ্রেমেরও মোহমুক্তি ঘটে। গাঁয়ের কয়েকটি ছেলেকে সঙ্গী করে অস্ত্র ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ইন্ডিয়া রওয়ানা হলাম। মুক্তিযুদ্ধ তখন প্রায় আট মাস অতিক্রম করেছে। গ্রামে বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেসব গান-কবিতা লিখেছি, সেই খাতাটাও সঙ্গে নিয়েছি। কোনোভাবে যদি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে স্বরচিত গান-কবিতা প্রচার করাতে পারি, দেশ স্বাধীন হলে লেখালেখির লাইনেও মানুষ হওয়াটা সহজ হবে।

দুদিনের ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর যাত্রা শেষে, বর্ডার পেরিয়ে কুচবিহার শহরে পৌঁছলে রাস্তায় দেখা হয় রংপুরের পরিচিত ছাত্রনেতা হারেস ভাইয়ের সঙ্গে। রিকশায় চড়ে একটা ব্যাগসহ কোথাও যাচ্ছিলেন তিনি। আমি চেঁচিয়ে ডাক দেয়ায় থামলেন। সব খবর জেনে বললেন, দেরিতে এসেছো। এখন তো তোমার জন্য কিছু করতে পারবো না। আমি আজ উত্তরাঞ্চলের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এমএন ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতা যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গেও মিটিং হবে। তোমাদের হয়তো ট্রেনিং নিয়ে আর যুদ্ধে পাঠানোর প্রয়োজন হবে না। ইন্দিরা গান্ধী স্বীকৃতি দিলে ইন্ডিয়ান আর্মি অচিরেই ওপেনলি যুদ্ধ করবে। এসেছো যখন, তোমরা আপাতত কুচবিহারের একটি ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তি হয়ে অপেক্ষা করো। ক্যাম্পের ইনচার্জকে তুমি আমার কথা বলো। বহুকষ্টে ইন্ডিয়ায় গিয়েও মুক্তিযুদ্ধ বা কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম না। ইন্ডিয়া ঘুরে দেখাও হলো না। একটি যুব শিবিরে মাসদেড়েক বন্দি-শরণার্থীর জীবন কাটিয়ে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ঘোষিত হওয়ার পর, আবার দেশে ফিরে এলাম।

স্বাধীনতার পর বাড়িতে পিতার সঙ্গে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। দল ক্ষমতাসীন হওয়ায় গ্রামে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে। রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। বাড়িতেও একদিন রিলিফের লোটা-কম্বল দেখে মায়ের সামনে বেশ চোটপাট করি। ‘রিলিফচোর’ কথাটা বাবার কানেও যায়। অন্যদিকে আমার বিরুদ্ধেও তার রাগ-ক্ষোভ জমে ছিল বিস্তর। শহরে থেকেও লেখাপড়ায় গোল্লা খাওয়ার লক্ষণ দেখিয়েছি। অর্থের অপচয় করেছি আরো বেশি। বাবার সার্টিফিকেট নিয়ে ইন্ডিয়ায় গিয়ে সলিমুদ্দি-করিমুদ্দির ছেলেরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, কিন্তু ইন্ডিয়া গিয়ে আমি না হয়েছি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, না শোনা গেছে স্বাধীন বাংলা বেতারে আমার নাম। তারওপর গ্রামে থেকে অবাঞ্ছিত প্রেমে জড়িয়ে বদনাম কুড়িয়েছি। এই অবস্থায় আমার উপর পিতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো-  লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট ও মানুষ হওয়ার গেরান্টি দিলে বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পাবো। কিন্তু কাব্য-সাহিত্যের পাগলামি, পলিটিক্স কি প্রেম করার স্বাধীনতা চাইলে, এ বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না আমার।

টাকার জন্য বাবার সঙ্গে আপোস করতে রাজি ছিলাম না আমিও। অতএব ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার মতো বেদনা ও অভিমান নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের আশ্রয়ে গেলাম। পুরনো বন্ধুদের অনেকেই মুক্তিফৌজ ও মুজিববাহিনী হয়েছে। অনেকে অস্ত্র জমা দেয়নি তখনও। এদের সঙ্গেও বেশিদিন বনল না। উপরন্তু বাড়ি থেকে আগের মতো টাকা না পাওয়ায় শহরে স্বাধীনভাবে চলা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায়  প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জনে আর সময় নষ্ট না করে কবি-সাহিত্যিক হওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মতো প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের রাজনীতি করাটাকেই জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য করলাম। এমন মহৎ লক্ষ বাস্তবায়নের জন্য নিজের গ্রাম-শহরকে মোটেও উপযুক্ত স্থান বিবেচিত হচ্ছিল না। অতএব স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এলাম স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায়।

বঙ্গবন্ধু সরকার-প্রধান হয়ে ততদিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন করেছেন। তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরেপক্ষতা রাষ্ট্রের মৌলিক চার আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ঢাকায়  থেকে যদি নিজের কাব্যপ্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে পারি, আমার কবিতায় সোনার বাংলার প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন একদিন বঙ্গবন্ধুর চোখেও পড়তে পারে। ঢাকায় থাকলে একদিন না একদিন ছেলেবেলার মতো তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আসতেও পারে। আর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে  কোনো সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আমার পিতা ও বন্ধুরাও নতুন করে আমার মূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে।

সত্যি বলতে কী, ঢাকা আসার আগে তারুণ্যের আবেগে এরকম দিবাস্বপ্নও বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, সেটা ঢাকায় আসার পরই হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে লাগলাম। এমনিতে দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে নিঃস্ব হয়েছে, তারওপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা তখন সর্বক্ষেত্রেই এমন নাজুক যে, দৈনন্দিন বাঁচার সংগ্রামেই নাভিশ্বাস ওঠে অধিকাংশ মানুষের। সহায়-সম্বলহীন দশা আমারও। কবিতা কিংবা রাজনীতির পথে হাঁটব কি, ঢাকায় টিকে থাকার পথ খুঁজতেই বছর কাটে। এই অবস্থাতেও, এমনকি ফুটপাতে রাত কাটিয়েও আমার কবিতার খাতার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছিল কিন্তু। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এক বছরে নানা ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে একটি আধা সরকারি সংস্থায় ইন্টারভিউ দিয়ে কেরানির চাকরি পেলাম। মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা হলো, এবার আমাকে ঠেকায় কে? কবিতা নিয়ে সাহিত্য-সম্পাদকদের দফতরে যাতায়াত শুরু করি। কিন্তু সম্পাদকরা অখ্যাত নবীন প্রতিভার কদর কি সহজে করতে পারে? আমার কবিতায় কোথায় যে ঘাটতি-দুর্বলতা ছিল, দেখব ছাপব করেও শেষ পর্যন্ত ছাপে না কেউ।

কবিতা ছাপা না হলেও সাহিত্য ক্ষেত্রের নবীন-প্রবীণ অনেকের সঙ্গে মুখচেনা পরিচয় হতে থাকে। একসঙ্গে অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিককে দেখার সুযোগ পাই ১৯৭৪-এ বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে। কলকাতা থেকেও এসেছেন অনেক বিখ্যাত লেখক। বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলন উদ্বোধন করবেন শুনে সব কাজ ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে। কৈশোরে কর্মী-সভার আকস্মিক সাক্ষাতের মতো বন্ধবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই যদি!  এই আশা নিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলাম। বিখ্যাত সব লেখক-সাহিত্যিক পরিবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুকে জীবনে দ্বিতীয়বার, প্রায় হাত দশেক দূরে থেকে এক ঝলক দেখার সুযোগ হয়েছে। লেখক-কবিদের ভিড়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেননি, দেখলেও চিনতে পারতেন না অবশ্যই। আর আমি নিজে আরো কাছে এগিয়ে মুখ দেখাই কোন লজ্জায়? তখন পর্যন্ত একটা কবিতাও কোথায় ছাপা হয়নি আমার। কিন্তু আমার এটুকু চোখের দেখাও ভবিষ্যতে তাঁর আরো কাছাকাছি হওয়ার স্বপ্ন-সাধকে  জোরালো করেছিল। কারণটা ওই সময়ের রাজনীতি।

দেশপ্রেম কিংবা বিপ্লবের বারুদ তরুণপ্রাণে যেটুকু ছিল, কবিতায় প্রকাশ ঘটিয়ে তোমাদের মতো খ্যাতি বা স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি সত্য, কিন্তু ওই সময়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেকে বিস্ফোরিত করার পরিবেশটা বেশ অনুকুলে এসেছিল আমার। আর ঢাকায় এসেছিলাম তো কবিতা ও রাজনীতিকে জীবনের ধ্রুব সত্য করে তোলার বাসনা নিয়েই। বঙ্গবন্ধুর সংগঠিত ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের উপর আস্থা হারিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। বঙ্গবন্ধু পারছে না, কিন্তু বৈজ্ঞানিক পন্থায় অল্প সময়ে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে তারা। আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, এই নতুন দলে আমার একজন ঘনিষ্ঠ পুরনো ও নতুন বন্ধু ছিল কয়েকজন। বন্ধুরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসেবে পাওয়ার জন্য আমাকে টানাটানি করতে থাকে। সেই টান উপেক্ষা করতে না পেরে অনেকটাই জড়িয়ে গেছিলাম তাদের সঙ্গে। এছাড়া ঘটনাচক্রে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির এক তাত্ত্বিক নেতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে সেই সময়ে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের ভুল অবস্থান এবং নিজেদের লাইনকে সঠিক প্রমাণের জন্য তিনি আমাকে, এমনকি আমার অফিসে এসেও মার্ক্স-লেনিন শ্রেণিসংগ্রাম বোঝান। বিপ্লবী তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে আমার মাথাকে বিপ্লবের বোমা বানিয়ে ফেলিয়েছিলেন প্রায়। বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই আমাকে রক্ষা করেছে বঙ্গবন্ধুর ওই সমেয়ের এক যুগন্তকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একাত্তরে স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার মতো স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ধাঁচে বাংলাদেশেও একটিমাত্র রাজনৈতিক দল রাখার বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী ও হঠকারি রাজনীতির বিশৃঙ্খলা কঠোর হস্তে  দমন করে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কায়েম  হয়েছিল। নানারকম বিপ্লবী দল-গ্রুপের টানাটানিতে বিভ্রান্ত ও অতিষ্ঠ আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি যেন। কয়েক ডজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল ও গ্রুপের মধ্যে কে সঠিক আর কে ভুল, তাত্ত্বিক বিতর্কে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু  নিজের সাধারণ জ্ঞানে বুঝেছিলাম, দেশের মানুষের কল্যাণ-উপযোগী রাষ্ট্র ও সমাজ বঙ্গবন্ধু যদি গড়ে তুলতে না পারেন, তবে নানা রঙের বামপন্থীরা হাজার বিপ্লব করেও তা পারবে না। বামপন্থী বিপ্লবী কিংবা ডানপন্থী নেতাকর্মীদের কাছে এবং দূরে থেকে যতটা চিনেছিলাম, তাতে বঙ্গবন্ধুর আঙুলের নখের যোগ্য মনে হয়নি কাউকে, ষোল আনা আস্থাও জাগেনি কারো প্রতি।

বঙ্গবন্ধুর নতুন বাকশাল দলে সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ যোগ দিয়ে দেশগড়ার স্বার্থে ভূমিকা রাখবে। রাষ্ট্রের সম্পদ থাকবে জনগণের মালিকানায়। উৎপাদন ও বণ্টন হবে সমবায়ী ব্যবস্থাপনায়। নিজ দল ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাকশালে বঙ্গবন্ধুর পুরনো দল ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টিসহ অনেক বামপন্থী দল যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমিও সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রাজনীতি যদি করতেই হয়, কবি হিসেবে হোক আর আধাসরকারি সংস্থার কর্মী হিসেবে হোক, সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধুর নতুন দলে যোগ দিয়ে দেশ গড়ার রাজনীতি করব। তাতে করে একদিন না একদিন বঙ্গবন্ধুকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও চেনার সুযোগ অবশ্যই পাবো আমি। দুর্ভাগ্য আমার, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার তরুণ বয়সের  সেই স্বপ্ন-সাধও নিহত হয়েছে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে যে তীব্র শোক অনুভব করেছিলাম সেদিন, তারপর আর কোনো রাজনৈতিক দলে ভেড়ার কিংবা কোনো নেতার সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি কখনো। এই ট্রাজিক ঘটনার পর কবিতা লেখাও বন্ধ হয়েছে আমার।

আমার গল্প শেষ হওয়ায় লেখক বন্ধু নড়েচড়ে বসল। কণ্ঠে আবার অবিশ্বাসের সুর, জানতে চাইল, ‘তোমার এরকম পরিণতি দেখিয়ে তুমি কি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে তোমার শোকের গভীরতা বোঝাতে চাইছো?’
আমি কিছুই বোঝাতে চাইছি না হে। নিজের জীবনে যা ঘটেছে, যা অনুভব করেছি, অকপটে সেসব কথাই তোমাকে বললাম আজ। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টে আমি রামপুরায় এক শিল্পী বন্ধু তপনের সঙ্গে মেস করে থাকতাম। দুজনেই ছিলাম বঙ্গবন্ধু ভক্ত। খবরটা শোনার পর আমরা আশা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর দল ও বঙ্গবন্ধুর অগণিত ভক্ত-সমর্থকরা অবশ্যই প্রতিবাদী মিছিল করে বত্রিশ নম্বরের দিকে ছুটে যাবে। মিছিলের সঙ্গে আমরাও যাব। কিন্তু রাস্তায় নেমেও পরিচিত কোনো নেতা-কর্মী কিংবা মিছিল চোখে পড়েনি। অতঃপর ঘরে নেশায় বুদ হয়ে দুজনেই ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি সেই দিনটিকে। এরপরে মিরপুর রোড দিয়ে যাতায়াত করার সময় বত্রিশ নম্বরের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে, এমনকি এখনো বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের স্মৃতি-সাধ মনে হলে একা একা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি অনেকবার। আমার এই দীর্ঘশ্বাস দিয়েই শেষ করতে পারো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের জোর বিষয়ক গল্পটা।

লেখক এবারে স্পষ্ট আপত্তি ও হতাশা ব্যক্ত করে বলল, ‘ধ্যাৎ! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের জোর দেখাতে যদি গল্প লিখতে হয়, তবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত মানুষের অভাব আছে? শুধু ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্মৃতি নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় দেশ ও মানুষের জন্য তোমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অবদান রেখেছেন, আত্মত্যাগও করেছেন তারা।’

আমি সম্মতি দিয়ে বলি, হ্যাঁ, রাজনীতিতে এমন দৃষ্টান্ত অবশ্যই খুঁজে পাবে তুমি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের জোর ও ত্যাগ নিয়ে গল্প লিখতে চাইলে তাদের আপোস এবং সুবিধাবাদও দেখাতে হবে তোমায়। কারণ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেখে যাচ্ছি তো, রাজনীতি মানেই রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়ি, দেশ বিক্রি করে কিংবা দেশবাসীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে হলেও ক্ষমতায় যেতে চায় কিংবা টিকে থাকতে চায় তারা। আদর্শ-নিষ্ঠা ও ত্যাগের বদলে আপোস ও সুবিধা লোটার হাজারো সত্য দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবে তুমি। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করে যারা শহীদ হয়েছে, সম্পর্কের জোর দেখাতে এমন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েও লিখতে পারো গল্প।

‘বন্ধবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের জোরে তুমি না হয়েছো সফল মুক্তিযোদ্ধা, না হয়েছো কোনো স্বীকৃত কবি। বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকারী কোনো বিপ্লবী দলের ক্যাডার-কর্মীও হতে পারোনি। চাকরিবাকরি করেও তেমন উন্নতি হয়নি তোমার।  ছাপোষা কেরানি হয়েই কাটালে জীবনটা। বঙ্গবন্ধুর মতো মহাপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের জোর দেখাতে তোমার জীবনের একটি হ্যান্ডশেক আর হাজার দীর্ঘশ্বাস-এর  গল্প  তেমন জমবে না হে।’

আমি  লেখক বন্ধুকে উৎসাহ যোগাতে বলি, গল্পের নামকরণ তো ভালোই করলে। আমি কিন্তু নিজের জীবনকাহিনি শোনাতে গিয়ে কোনো অতিরঞ্জন করিনি। গল্পের স্বার্থে তুমি দরকার হয় কিছুটা বানিয়ে নিও, লেখকের কল্পনার স্বাধীনতা তো আছেই।

উত্তেজিত লেখক জবাব দিলো, ‘বানাতে যাবো কেন? বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের জোরের সবচেয়ে জীবন্ত ও সত্য দৃষ্টান্ত তো এখন জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যার কথা চিন্তা করো। তুমি ১৫ই আগস্টের স্মৃতি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ো। সেই শোকে রাজনীতি ও কাব্য চর্চাও ছেড়ে দিয়েছো। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা বাবা-মা-ভাইসহ এতগুলো আপনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে যে বেদনা পেয়েছিল, তার গভীরতা কল্পনা করে মাপতে পারবে তুমি? সেই শোককেও শক্তিতে রূপান্তরিত করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেছেন, বঙ্গবন্ধুর  সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে অনেকটাই বাস্তবায়িত করে ফেলেছেন। এ শুধু রক্ত সম্পর্কের জোর নয় হে! বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ছিল, সেইরকম ভালোবাসা নিয়ে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছেন বলে এটা সম্ভব হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে দেশ যে এখন অনেক দিক দিয়েই উন্নত এবং এগিয়ে যাচ্ছে, অস্বীকার করতে পারবে?’

আমি বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গল্পের নায়ক হতে চাওয়ায় লেখক যেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল, তেমন সন্দেহ আমারও জাগে। দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সংস্পর্শে থাকতে আগ্রহী এবং ক্ষমতার তোষণকারী লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। সুযোগ-সুবিধা লোটার ধান্ধায় থাকে তারা। কিন্তু আমার এই সৎ লেখক বন্ধুটিকে সেরকম মনে করি না বলেই আজ নিজের গল্প তাকে শোনাতে এসেছি। তার জোরালো বক্তব্যে সম্মতি দিয়ে বলি, বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে নিয়ে লিখতে চাইলে অবশ্যই লিখবে। কিন্তু আমরা যারা ছাপোষা অতি সাধারণ মানুষ, জীবনে বড় কোনো কীর্তি রাখতে পারিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি ও সোনার বাংলা দেখার আশা-হাতাশা নিয়ে বেঁচে আছি এখনো, তাদের জীবন কি তোমার গল্পেও সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে না?

অভিন্নহৃদয়  লেখক বন্ধু এবার আমার জন্য চোখে স্পষ্ট সহানুভূতির আলো জ্বেলে হাসিমুখে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, নবীন যৌবনে তোমার নিহত স্বপ্নসাধের জন্যও কিছুটা সহানুভূতি জাগছে বটে।’

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়