ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিবেদিত কবিতায় বঙ্গবন্ধু

মতিন রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৬, ৩০ এপ্রিল ২০২১  
নিবেদিত কবিতায় বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ কবিতা রচিত হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলা কঠিন। তবে এ-কথা জোর দিয়েই বলতে পারি, বিশ্বে এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই যাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে এত বিচিত্র কবিতা! কেন এত কবিতা রচিত হয়েছে তাঁকে নিয়ে? এ প্রশ্নের জবাব খুব সহজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাঁর প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা, নেতৃত্বগুণ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রসবোধ ইত্যাদি তাঁকে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাও সংবেদনশীল কবিদের ভীষণ মর্মাহত করেছে। এর ফলেও রচিত হয়েছে অসংখ্য মর্মস্পর্শী কবিতা।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতা দুটো মোটা দাগে ভাগ করা যায়। একটি তাঁর জীবদ্দশায় অর্থাৎ ১৯৭৫ পূর্বকালে রচিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয়বহ কবিতাবলী, অন্যটি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বেদনামথিত উচ্চারণগাথা। সত্তরের দশকের শুরুতে অর্থাৎ পঁচাত্তর পূর্বকালে তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় কবিরা। এ তালিকায় আছেন কবি জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ। বাদ যাননি পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকরাও। দক্ষিণারঞ্জন বসু, অন্নদাশঙ্কর রায়, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র চক্রবর্তী, সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শান্তিকুমার ঘোষ, বিনোদ বেরা, বনফুলসহ আরও অনেকে জনপ্রিয় কবি-সাহিত্যিক শেখ মুজিবকে নিয়ে রচনা করেছেন কবিতামাল্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখে কারাবন্দি হন পাঞ্জাবি কবি আহমেদ সালিম। লাহোর ডিস্ট্রিক জেলে বসে লেখা তাঁর ‘সিরাজউদ্দৌলা ধোলা’ কবিতাটি তিনি উৎসর্গ করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিব তাঁর চোখে সিরাজউদ্দৌলার মতো স্বাধীনতার রক্ষক। ভারতের প্রথিতযশা উর্দুভাষী কবি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ প্রখ্যাত ভারতীয় অভিনেত্রী শাবানা আজমির পিতা কাইফি আজমি ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক যে কবিতাটি রচনা করেন, সেখানেও উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বীরগাথা। ভারতের আরেক কালজয়ী চিন্তানায়ক ও মানবতাবাদী সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে রচনা করেন অমর পঙ্‌ক্তিমালা: 
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা 
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার 
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা 
রক্তগঙ্গা বহমান 
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, 
জয় মুজিবুর রহমান।’
(বঙ্গবন্ধু: গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা)

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন স্বদেশে ফিরে এলেন। শুরু করলেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ধ্বংস্তূপের মধ্যে যেন জেগে উঠলো অগণন লড়াকু প্রাণ। বাংলাদেশ যেন ফিরে পায় তার সঠিক গন্তব্য। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন করেন স্বমহিমায়। তাঁকে নিয়ে রচিত হতে থাকে অজস্র কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক আর গান। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা খুব সহজ ছিল না। কারণ স্বৈরাচারী সেনাশাসকের রক্তচক্ষু শাসিয়ে বেড়াচ্ছিল পুরো দেশ। ১৯৭৭ সালে বিপুল প্রতিকূল পরিবেশে অসম সাহসে কবি নির্মলেন্দু গুণ উচ্চারণ করলেন: ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শীর্ষক কবিতাটি। একুশের ভোরে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রকাশ্যে পঠিত প্রথম কবিতা এটি।

আমাদের স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা করেন কালজয়ী কবিতা ‘ধন্য সেই পুরুষ’। কবি দীপ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেন: 
‘ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে মু্ক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সমাধিস্থ করার পর তাঁর বাল্যবন্ধু মৌলভী শেখ আবদুল হালিম গভীর মর্মযাতনা থেকে আরবি ভাষায় রচনা করেন একটি কবিতা। তিনি কবিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি করেছিলেন। যদিও তা দুরাচারী রাষ্ট্রপ্রধানের কর্ণকুহরে ঢোকেনি। ভারতের বিহারে জন্ম-নেওয়া বাংলাদেশের উর্দুভাষার শীর্ষস্থানীয় কবি নওশাদ নূরীও বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে মর্মাহত হয়ে রচনা করেন ‘উত্থান-উৎস’ শীর্ষক কবিতা। কবির ভাষায়:
‘সে আছে, সে আছে-
সর্বদা হাজির সে যে, অফুরান শক্তি হয়ে সে আছে,
সে আছে সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার।’

বঙ্গবন্ধুকে দাফনের পর সতেরোই আগস্ট আরও একটি কবিতা লেখেন কবি নওশাদ নূরী। কবিতার শিরোনাম ‘নজম টুঙ্গিপাড়া’। কবির উচ্চারণ:
‘তোমরা কি জানো? তোমরা কী জানো?
পথের শুরুটা হয়েছিল এইখানে,
পথ খোয়া গেল, হায়, সেও এইখানে।’

নওশাদ নূরীর উদ্ধৃত দুটো কবিতারই অনুবাদক কবি আসাদ চৌধুরী। পঁচাত্তর সালে আরও একটি কবিতা রচিত হয় সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষ গুপ্তর কলমে। শিরোনাম ‘রক্তাক্ত প্রচ্ছদের কাহিনী’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কতিপয় প্রতিবাদী তরুণ প্রকাশ করেন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?’ শীর্ষক একটি কবিতা সংকলন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এটিই প্রথম সংকলন। এই দুঃসাহসিক সংকলনের পরিকল্পক ছিলেন ছড়াকার আলতাফ আলী হাসু। সংকলনে সম্পাদক হিসেবে কারও নাম ছিল না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অজ্ঞাত সংগঠন ‘সূর্য তরুণ গোষ্ঠী’র নামে এটি প্রকাশিত হয়। আরও একটি সাহিত্য সংকলন-গ্রন্থ প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। শিরোনাম ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৯)। এর সম্পাদক ছিলেন কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী। এটিও ছিল এক দুঃসাহসী সম্পাদনা।

সেই প্রতিকূল সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কবি কামাল চৌধুরী লিখলেন ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম’ শীর্ষক অনবদ্য কবিতা। ক্রমশ আরও অনেক কবি বঙ্গবন্ধুকে কবিতার বিষয় করে তুললেন। রচিত হতে থাকলো একের পর এক মর্মস্পর্শী কবিতা। সত্তরের দশকের শেষদিকে মনিপুরের বিশিষ্ট কবি এলাংবম নীলকান্ত বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লিখলেন ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’। কবি উচ্চারণ করেন:
‘হে বঙ্গবন্ধু
নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছো শুনে
পেরিয়েছি আমি এক অস্থির সময়
খোলা জানালা দিয়ে সুদূর আকাশের দিকে
পলকহীন তাকিয়ে থেকেছি
উত্তরহীন এক প্রশ্ন নিয়ে
বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়ে তুলেছিলে স্বদেশ তোমার
কিন্তু এ কোন প্রতিদান পেলে তুমি?’

কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেন মনিপুরী ভাষার আরেক কবি এ. কে. শেরাম। এটি কবি এলাংবম নীলকান্তের ‘তীর্থযাত্রা’ (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে। আর এই কাব্যগ্রন্থের জন্যে কবি এলাংবম নীলকান্ত লাভ করেন ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭)।

বঙ্গবন্ধুর মর্মন্তুদ মৃত্যুর পর কবি-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচনা করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক কবিতাটি। এ কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে বেদনাঘন উচ্চারণ, অন্যদিকে ঝরে পড়েছে তীব্র ক্ষোভ। তাঁর ভাষায়: 
‘আজ বাংলার ভাগ্যবিধাতা মাটির কবরে শায়িত
দশকোটি বাঙালি আজ রাজাকার দ্বারা শাসিত
কুকুর এখন মসনদে বসে
সিংহচর্ম গায়ে দেয় কষে
বিদেশি প্রভুর সেবায় এখন পদানত দাস নিহত
তুমি তো হয়েছ শহীদ বন্ধু বাঙালি হয়েছে নিহত।’

‘এই সিঁড়ি’ শীর্ষক কবিতায় মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ রচনা করেছেন এক করুণ বেদনাগাথা। তাঁর উচ্চারণটি ঠিক এরকম:
‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।’

শহীদ কাদরীর ‘হন্তারকদের প্রতি’ শীর্ষক কবিতায় হন্তারকদের নিখুঁত ছবি অঙ্কন করা হয়েছে সূক্ষ্ম শ্লেষের মধ্য দিয়ে। কবির ভাষায়: 
‘তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা
মানুষের মতো দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।’

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক যেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের সুলুকসন্ধান করেছেন। কবির ভাষায়:
‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
 যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে ঊর্বর পলি।’

উদ্ধৃত কবিরা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন আবুল হোসেন, হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কায়সুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, মনজুরে মওলা, হায়াৎ মামুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বেলাল চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, মহাদেব সাহা, অসীম সাহা, রবিউল হুসাইন, হেলাল হাফিজ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হুমায়ুন আজাদসহ ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, প্রথম বা শূন্য দশক, এমনকি দ্বিতীয় দশকের কবিরাও। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কবিতা লিখেছেন কথাসাহিত্যিকরাও। এ তালিকায় আছেন মনীষ ঘটক, বনফুল, শওকত ওসমান, মাহমুদুল হক, রাহাত খানসহ আরও অনেকে। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ