লক্ষ্মীপুরে ৩৪টি বিদ্যালয়ে পাঠদান নিয়ে শঙ্কা
জাহাঙ্গীর লিটন || রাইজিংবিডি.কম
করোনাসৃষ্ট কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আগামীকাল খুলছে দেশের স্কুল-কলেজ। কিন্তু ভবন নির্মাণ শেষ না-হওয়ায় লক্ষ্মীপুরের ৩৪টি বিদ্যালয়ে পাঠদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ ছুটির পর বিদ্যালয় খুলে দেয়া হলেও শিক্ষকরা পড়েছেন বিপাকে। শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য বিদ্যালয়ের পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা এবং নতুন ভবন নির্মাণ না-হওয়ায় এ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যায়ে মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার শেল্টার প্রজেক্ট (এমডিএসপি) এর আওতায় লক্ষ্মীপুরে ৩৪টি ভবন নির্মাণের কাজ পায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নাভানা কনস্ট্রাকশন। গত ২ বছরে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৪৮ ভাগ। কিন্ত মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে বেশির ভাগ নির্মাণাধীন ভবনের কাজ হয়েছে ২০-২৫ ভাগ।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্ব টুমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে একটি ১ তলা ভবন ছিল। ৬ মাসের ভেতর ৩ তলা ভবন নির্মাণ শেষ হবে এমন আশায় পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু গত ৪ বছরে গ্রেট বীমের পর পিলার ওঠানোর কাজ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। বিদ্যালয় খুলে দিলে ছাত্রছাত্রীরা কোথায় বসে ক্লাশ করবে এ নিয়ে চিন্তিত প্রধান শিক্ষিকা ফেরদৌসী বেগম। তিনি জানান, ছাত্রছাত্রীরা বসতে না পারলে স্কুলে আসবে না। ফলে তাদের উৎসাহ হারিয়ে যাবে। এমনিতেই লেখাপড়ায় যে ক্ষতি হয়েছে আমরা আরো পিছিয়ে যাব।
স্কুল ভবনের এই অবস্থার কথা উপজেলা এবং জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও লাভ হয়নি বলে মন্তব্য করেন ফেরদৌসী বেগম।
নির্মাণাধীন ভবনের তথ্যবোর্ড থেকে জানা যায়, ত্রিতল পাকা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। এরপর নাভানা কনস্ট্রাকশন স্কুল কর্তৃপক্ষকে কাজ বুঝিয়ে দেবে। অথচ ২০২১ সালে এসেও কেউ বলতে পারছেন না ভবন নির্মাণের কাজ কবে শেষ হবে।
এই প্রকল্পের অধীন কমলনগর উপজেলার চর পাগলা পাটওয়ারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজেও একই রকম গাফিলতি লক্ষ্য করা গেছে। ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের জন্য রডের যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে তা গত ২৭ মাস ধরে সেভাবেই আছে। নির্মাণাধীন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল উল্লাহ জানান, তিন বছর ধরে বিদ্যালয়টির কাজ ঝুলে আছে। ঠিকাদার ভবন নির্মাণ না করেই বিল নেয়ার পায়তারা করছেন। তিনি আরো জানান, ভবনটি নির্মাণকালে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার জন্য যে অস্থায়ী টিনশেড ঘর তৈরি করা হয়েছিল সেটিও ভেঙে গেছে। ফলে স্কুল খুললে ছাত্রছাত্রীরা কোথায় লেখাপড়া করবে এ নিয়ে পুরো কমিটিই পড়েছে বিপাকে।
৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ত্রিতল এই ভবনটি ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন। এতদিন পরেও ভবনের একটি ছাদও নির্মাণ শেষ হয়নি। অথচ ভবনের কাজ ৪০ ভাগ শেষ হয়েছে বলে তথ্যবোর্ডে দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) লক্ষ্মীপুর অফিস ও প্রকল্পের প্রসপেক্টাস থেকে জানা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন সহায়তায় মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার শেল্টার প্রজেক্ট- এর আওতায় লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩৪টি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পায় নাভানা। চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর। কাজের তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরকে। প্রকল্পের আওতায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৭টি, রামগতিতে ১০টি, কমলনগরে ৬টি, রায়পুরে ৮টি এবং রামগঞ্জ উপজেলায় ৩টি সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল ভবন নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত কাজ শেষ করতে পারেনি নাভানা।
সরেজমিনে দেখা যায় অধিকাংশ ভবনের পিলার এবং ১ তলা নির্মাণ করেই কাজ আটকে আছে। অবশিষ্ট কাজ কখন শেষ হবে এ বিষয়ে সুনিদির্ষ্ট তথ্য এলজিইডির জেলা অফিসের কর্মকর্তারাও জানেন না। অথচ কমলনগর উপজেলার প্রায় সবগুলো বিদ্যালয়ের একই অবস্থা।
নাম প্রকাশ না-করার শর্তে, নাভানা কনস্ট্রাকশনের একজন প্রকৌশলী জানান, কাজের শুরু থেকেই রড, সিমেন্ট, বালু, পাথরের টানাটানি ছিল। এত সংকটে বড় প্রকল্পের কাজ করা যায় না। যে কারণে প্রকল্প থেকে অনেক প্রকৌশলী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। বর্তমানে যারা যুক্ত তাদের অনেকের বেতন ভাতা ৩-৪ মাস বাকি।
প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী এএইচএম মাহবুবুর রহমান এ জন্য কর্তৃপক্ষের গাফলতিকে দায়ী করে বলেন, ‘বিষয়টি উর্ধ্বতনদের জানানো সত্ত্বেও কোনো অগ্রগতি নেই। আমার কাছে নির্দেশনা না থাকায় কাজ এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মুনছুর আলী চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভবনগুলো কে বা কারা নির্মাণ করছে জানি না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করছে না। তবে স্কুল খুললে অস্থায়ীভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চালিয়ে নেওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহ আলম পাটওয়ারী বলেন, নাভানার সঙ্গে প্রকল্পের চুক্তি বাতিলের জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
কাজের এমন হ-য-ব-র-ল আগে কোথাও দেখেননি বলেও জানান শাহ আলম।
লক্ষ্মীপুর/তারা