বরিশাল-ঢাকা ৩ ঘণ্টা, ৫ মিনিটে পদ্মা সেতু পার
শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
২৫ জুন সকাল ১০ টার দিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটি কোটি মানুষের বহু প্রতীক্ষিত এই সেতুটির কারণে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার সঙ্গে সেতুবন্ধন হবে উত্তরবঙ্গের। এর ফলে সড়কপথে বরিশাল থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে রাজধানী ঢাকায়। এছাড়া পদ্মা সেতু পার হতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট।
দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। উন্নয়নের মহাসড়কে নাম লেখানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে বরিশাল ও খুলনা জনপদ। তাইতো এখন আনন্দের জোয়ার বইছে পুরো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে।
রাজনৈতিক অবস্থান আর দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রায় সবাই খুশি পদ্মা সেতুর কারণে। সবার অপেক্ষা প্রহর এখন স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেওয়া এই সেতু পার হওয়ার।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই আনন্দের ঢেউ বয়ে চলেছে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-বরিশাল-খুলনাসহ পুরো উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে। আনন্দের জোয়ারে ভাসছে গোটা বাংলাদেশ।
একটা সময় ছিল বরিশাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত ফেরির সংখ্যা ছিল ৯-১০টি। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সময়ে একের পর এক সেতু নির্মাণে এখন কেবল পদ্মা ছাড়া আর কোনো ফেরি নেই ঢাকা-কুয়াকাটা পর্যন্ত ২৮২ কিলোমিটার সড়কে।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতু দেখতে আসা কুয়াকাটার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়াকাটা থেকে সড়কপথে ঢাকা যাওয়াটা একসময় স্বপ্ন ছিল আমাদের কাছে। পদ্মা নদী ছাড়া অন্য সব নদীতে সেতু হওয়ায় এখন ৮ থেকে সাড়ে ৮ ঘণ্টায় ঢাকা-কুয়াকাটা যাতায়াত করতে পারছি। আর এখন পদ্মা সেতু চালু হলে এ সময় আরও অন্তত ৩ ঘণ্টা কমবে।’
মাওয়ায় আসা বরিশালের রেন্ট-এ-কার চালক রহিম মিয়া বলেন, ‘বরিশাল থেকে বাংলাবাজার হয়ে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। বাংলাবাজার পৌঁছতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। এরপর শিমুলিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা সেতুতে পৌঁছানো যায় ৪০ মিনিটে। কেবল ফেরি চেপে পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে লেগে যায় ৩-৪ ঘণ্টা। সেতু চালু হলে মাত্র ৫ মিনিটেই পদ্মা পাড়ি দিতে পাররো। আগে ঢাকা যেতে সময় লাগতো ৭-৮ ঘণ্টা, সেখানে এখন মাত্র ৩ ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাব রাজধানী ঢাকাতে।’
বরিশাল অঞ্চলের মতো খুলনা বিভাগের ১০ এবং ঢাকা বিভাগের ৫ জেলা থেকেও রাজধানী যেতে এখনকার তুলনায় ৩ ঘণ্টা সময় কম লাগবে বলে জানান এসব অঞ্চলের মানুষ।
এমন অনেকে আছেন যারা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আর থাকতে চান না ঢাকায়।
শরীয়তপুরের বাসিন্দা ইমরুল কয়সার বলেন, ‘সেতু চালু হলে বাড়িতে চলে আসব। সকালে ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার বিকালে ফিরবো। এটা যে কত আনন্দের তা বলে বোঝাতে পারবো না।’
সড়কপথে যোগাযোগ প্রশ্নে বৈপ্লবিক পরিবর্তনই কেবল নয়, আরও অনেকভাবে দক্ষিণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু তার খানিকটা বিবরণ দিলেন বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইমানুল হাকিম। তিনি বলেন, ‘এই একটি সেতু ২১ জেলার কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্য কীভাবে বদলে দেবে তা আমরা এখন বুঝতে পারছি না। পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানীর সঙ্গে কম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন হলে গুরুত্ব বাড়বে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের। পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে নিজের অবস্থানকে আরও শক্ত করবে কুয়াকাটা। যোগাযোগে জটিলতার কারণে এতদিন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের যথাযথ মূল্য পায়নি এ অঞ্চলের মানুষ। সেই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে। যুগ যুগ ধরে আমরা দেখেছি রাজধানী ঢাকা ও এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে বহু শিল্প কলকারখানা হবে। এতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে, কমবে বেকারত্ব।’
পদ্মা সেতু ঘিরে সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ ভাবনায়ও যে এখন কতটা আনন্দ তা বরিশালগামী গৌরনদীর বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনের কণ্ঠে। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে গিয়াস বলেন, ‘নদীর ওপারে উঠতে পারলেই ঢাকা, অথচ সেই নদী পার হতে ফেরির অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যে কতটা কষ্টের তা কেবল আমরাই জানি। এখন তো আর বসে থাকতে হবে না। ফুস করে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাব ঢাকা শহরে।’
মাওয়ায় ঘুরতে যাওয়া মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা এনজিও কর্মী রিয়াজউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে কেবল বরিশাল এবং খুলনা বিভাগের সঙ্গেই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ছিল না রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো পদ্মা নদী। বরিশালে যাওয়ার কথা শুনলেই আঁতকে উঠতো ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ। যেন বরিশাল-খুলনা সৌরজগতের বাইরে। অথচ দেখুন ঢাকা থেকে যেখানে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩০০ এবং সিলেটের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার সেখানে বরিশাল মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে। কেবল এই পদ্মা নদীর কারণে যাতায়াত প্রশ্নে বরিশাল-খুলনা ছিল এক আতঙ্কের নাম। কিন্তু সেই আতঙ্ক জয় করতে যাচ্ছি আমরা।‘
মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ-হাসান তুহিন বলেন, ‘একটি সেতুর কারণেই বলতে গেলে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে ছিল বরিশাল-খুলনা বিভাগের ২১ জেলার মানুষ।’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। একই সাথে চলতে থাকে রোডওয়ে, রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো সহ অন্য কাজ। সেতুর মূল আকৃতি দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
মাসুদ
আরো পড়ুন