ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

স্মৃতিতে বুয়েটের দিনগুলো

সৌমেন শিকদার শুভ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১০ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মৃতিতে বুয়েটের দিনগুলো

বিকেল হচ্ছে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। চারপাশে ভেজা আর ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এক কথায় যাকে স্নিগ্ধ বলি। জানালার পাশে বসে বসে পাশের বাড়ির নারকেলগাছটার পাতা গোনার চেষ্টা করছি। বাসায় বন্দি আজ ক’দিন! ভুলে গেছি। দু’মাসের মতো হবে প্রায়, এতটুকু মনে আছে।

হঠাৎ করেই আজকে আমার বুয়েটের কথাগুলো মনে পড়ছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাগ-বালিশ হাতে হলে আসা, ক্লাস, ফার্স্ট ইয়ারে গণরুম, হলের ক্যান্টিন, ক্যাম্পাস, ক্যাফে, ইসিই বিল্ডিং, হলের মাঠ, কনসার্ট, ডে-ফেস্ট, পেনাং, পিএল, টার্মফাইনাল, হলফেস্ট, বন্ধু, আড্ডা, প্রেম, ট্যুর আরও কত কী!

আস্তে ভাই, আস্তে। থামি, এভাবে চলতে থাকলে বুয়েটিয়ানরা স্মৃতির সমুদ্রে তলা না পেয়ে হাবুডুবু খাবে, আর নন-বুয়েটিয়ানরা ‘কিচ্ছু বুঝছি না’ এর মরুভূমিতে জল খুঁজে বেড়াবে। আর তাড়া কিসের! সময় তো অনেক হাতে।

বুয়েট বললে প্রথম মাথায় আসে-হল আর ক্যাম্পাস। আমার জন্য দ্বিতীয়টার প্রায়োরিটি একটু বেশি। সেই বাচ্চাকাল থেকে তো ওখানেই কাটিয়ে দিলাম কত সময়। ফার্স্ট ইয়ারের রাতগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি ওএবি বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে, না হয় ইএমই বিল্ডিংয়ের সামনের ফুটপাতে। আর সেকেন্ড ইয়ার থেকে তো হাফ-ওয়ালকে ঘর বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলাম। অডিটরিয়ামের প্লিন্থ কয়দিন পর। আর ওই যে, গত বছর। ওই ১২ ফেব্রুয়ারি। কী ছোট্ট একটা জায়গা! দুইটা বেঞ্চের কতো আবেগের কর্নার। ওইখানে কত দিন-রাত কাজ ছাড়া বসে-শুয়ে থেকেছি, তার হিসাব কে রেখেছে?

আচ্ছা, কত দিন আমি ওই কর্নারে যাই না, গান শুনি না, বৃষ্টিতে ভিজি না! ইসিই বিল্ডিংয়ে ক্লাস ছাড়া তো থাকা হয় না। ডিপার্টমেন্টের ফেস্ট আসলে ভিন্ন কথা। দেড় দিনের ফেস্টের নামে কয়দিন পড়ে থাকি ইসিই বিল্ডিংয়ে। নয় তলা বা প্লিন্থ। নয়তো মাঠ। কত গল্প!

যত জায়গায় ঘুরঘুর করি না ক্যান! রাতে তো ঘুম দরকার। হল ছাড়া গতি নেই। সেই ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউকসু ২০১ এ তুলে দিলো, তারপর ২০৫, ৪০৬ আর শেষে ৪০৫ এ স্থির। যতটুকু সম্ভব, ওতটুকু সেরা দুই রুমমেটের সঙ্গে। এই রুমে বসে বসে রাত ২টা-৪টায় সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-ফুটবল নিয়ে কতো আলোচনা-মারামারি! কত দিন হয়ে গেলো এসব নাই!

বুয়েটের প্রোগ্রাম। এইটা নিয়েই তো একবেলা কথা বলা যায়। ফার্স্টইয়ারে উত্তেজনা এত বেশি ছিল যে, এক/দুইটা বাদে প্রতি ডিপার্টমেন্টের, প্রতি হলের, প্রতি ক্লাবের প্রোগ্রামে গিয়ে বসে থেকেছি। এইগুলো না থাকলে আসতাম কী করে এতদূর! আর টার্ম শেষে সব ঝেড়ে ফেলার জন্য র‌র‌্যাগকন্সার্ট। মাঝখানে কত শখের নিজেদের একটা ব্যাচপ্রোগ্রাম।

আর কন্সার্ট! কোন কোন ব্যান্ড শুনে ফেলেছি না বলে, কোন কোন ব্যান্ড বাদ আছে ওটা গোনা সোজা হবে। দিন-দুনিয়া ভুলে আলোর ঝলকানিতে, ব্যান্ডের সাথে চিৎকারে গলা মেলাই না কত দিন!

এত কিছু তো করলাম, পড়াশুনাটাও দরকার। সকালে উঠে নিজেকে আর নিজের কপালকে গালি দিতে দিতে ঘুম ঘুম চোখে ক্লাসে দৌড়, গিয়ে ঢুলুনিটা, কিংবা ল্যাবে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা- আমার কাছে খুব যে খারাপ লাগে, তা কিন্তু না। শুধু সিটি আর ল্যাব রিপোর্টগুলো না থাকলেই বোধহয় জীবনটা অনেক সহজ হতো। ওগুলো ও মেনে নিলাম। কিন্তু টার্ম শেষে ল্যাবটেস্ট, প্রজেক্ট, কুইজ, ভাইভাগুলো! কনসার্ট কী এমনি এমনি দরকার পরে একটা?

পিএলে লাইব্রেরিতে নাহলে হলে গ্রুপস্টাডির নামে স্টাডি বাদে সব কিছু হয়ে যায়। আর গভীর রাতে যখন মস্তিষ্কের বদহজম হয়, তখন? তখন আর কি- দলবেঁধে পুরান ঢাকা! সব হারিয়ে আছে, যখন পরীক্ষার গ্যাপের চার-পাঁচটা দিনমাত্র; খাওয়া-ঘুম তখন বিলাসিতা! সময় বাকি কেবল ৬০ ঘণ্টা- আর সিলেবাস অর্ধেক!

ভাবলেও ক্যামন লাগে, শেষ টার্মব্রেকটা কাটিয়ে এসেছি। পিএল আছে একটা। ৫টা পরীক্ষায় ১০ হলুদ-নীল খাতার পরে মুক্তি!

বুয়েটে এসে একটা কাজ করেছি অনেক, ট্যুর। সেই ১-১ এর টার্ম ফাইনালের পরে সিলেট গেলাম, এরপর থেকে তো বন্ধ একটু পেলেই হলো- কখনো প্ল্যান করে, কখনো কোনো প্ল্যান ছাড়াই! বন্ধ পেয়েছি ৭দিন, ঘুরতে চল! ভাল্লাগতেছে না, ঘুরতে চল। ওই জায়গাটা যাওয়া হয়নি, ঘুরতে চল। ঘোরার রেঞ্জ বাড়তে বাড়তে সিনিয়র হয়ে দেশ থেকে বিদেশে। কোথায় যাওয়ার আগে প্ল্যানিং; যাওয়ার পরে প্ল্যানিং না মেলার থ্রিল আর জীবন থেকে শত বা হাজার কিলোমিটার দূরে জীবন নিয়ে গল্প। এই ২৩ বছরের জীবনে নিজেকে যতটুকু চিনেছি, ট্যুরে গিয়ে তার সিংহভাগ।

বুয়েটে ক্লাস শুরুর পর পরই দেখি কতক বন্ধুবান্ধব জোড়া বেঁধে গেছে। আর সিনিয়রদের প্রেমের মিষ্টিমধুর অত্যাচার তো ছিলই। এসব দেখে তো আমিও হতাশ। ‘জুটবো না আমি কারো কপালে? না! বুয়েটে এত দুর্ভাগ্য নিয়ে কোনো মেয়ে আসেনি। এই সেক্টরটা পুরোটা এখনো আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো। প্রেমে ঝগড়া আসে, হাসি আসে, হাফওয়ালে বসে থাকা আসে, লাইব্রেরিতে একসাথে পড়া আসে? পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কনসার্ট দেখা আসে, আর বাধ্যতামূলক কি কান্না আসে? জানি না ভাই, সিঙ্গেল মানুষদের প্রেমট্রেম নিয়ে এত কথা বলা উচিৎ না।

কিন্তু এই শেষ দিকে এসে গুণে গুণে দেখতেছি; আঙ্গুলে আঙ্গুলে গুঁজে প্রেম করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু চার বছরের নীলপদ্মের হিসাব মিলছে না। হারিয়ে ফেলেছি কয়েকটা কোথায় জানি!

আর বাকি রইলো কী? রইলো মানুষগুলো। যারা না থাকলে বুয়েট কেবল একটা জায়গাই থেকে যেত। বুয়েট হয়ে উঠতো তো আর না। পাবলিক তো অনেকগুলো নিয়েই শুরু করেছিলাম, কমেছে অনেকে। আরও জুটেছে অনেকগুলো! গল্প করার, খেতে যাওয়ার মানুষ কেউ। কেউবা পড়তে বসার, খেলা দেখার। ট্যুরে যাওয়ার গ্রুপ। আবার ঝিমধরে ক্লাসে পাশে বসার কেউ।

ফেস্টে কামলা খাটার সহযোদ্ধা। অহেতুক বিষয় নিয়া ঘণ্টা ধরে তর্ক করার জন্য কেউ। ওই কর্নারে ক্যাম্পাসে আনন্দ-উৎসব করতে, আবার খিচড়ে থাকা মনমেজাজে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ঝাল মেটানো। সবাইকে নিয়ে আলাদা আলাদা করে বলার যোগ্যতা আমার নেই। বুয়েটের আবেগ কখনো বুয়েটের জন্য আসে না। মানুষগুলোর জন্য। এই চেহারাগুলো দেখি না কত দিন! ভালো লাগে বলেন?

র‍্যাগটার্ম? ইচ্ছা ছিল প্রচন্ড আনন্দ-উৎসব করে বের হয়ে যাবো, যাতে সারাজীবন এই কটা দিনে ফিরে তাকানো যায়। শুরুটা তো ওরকমই হয়েছিল! হলুদ পৌনঃপুনিক রঙ করা, পহেলা বৈশাখ, র‍্যাগ কর্নারে করে বুধবারের রাতগুলো, নিজের প্রথম র‍্যাগকন্সার্ট। তারপরে আসলো বিভীষিকা! এক জুনিয়রের জীবন বেঁচে বুয়েটের পুনর্জন্ম! সেই নতুন বুয়েটেও তো নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চেয়েছিলাম আমরা। আর দেখো কী অবস্থা আজকে?

কোত্থেকে কী অদৃশ্য দৈত্য এসে ঘাড় ধরে বের করলো সবাইকে। ২৬ মার্চ গেলো, পহেলা বৈশাখ গেলো। এত এত সাধের র‍্যাগওয়াল- সেটাও অসম্পূর্ণ অবস্থায় রেখে পালিয়ে আসলাম। ঘরে চার দেয়ালের ভেতরে। বাইরে দৈত্যের তাণ্ডবলীলা চলছে। দুর্ভাগ্য বুঝি, নিজেরটা মেনে নিতেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়।

এসব শেষে যেদিন আবার সুদিন আসবে, যেদিন বুক ভরে নির্ভয়ে শ্বাস নিতে পারবো; সেদিন ওই ৭৭ একরের ক্যাম্পাসে সবাই ফিরবে কিনা, জানি না। শুধু জানি, দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে গেলে আমি আর একটু বেশি করে বাঁচবো। একটু বেশি সময় আড্ডা দেবো। একমুহূর্ত বেশি জড়িয়ে ধরবো। ওই সুসময়ে একটু বেশি করে ভালোবাসবো।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।



বুয়েট/দীপ্ত/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়