ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘সুস্থ এক সকালে আড্ডায় মেতে উঠতে চাই’

মাইদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ৯ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘সুস্থ এক সকালে আড্ডায় মেতে উঠতে চাই’

সরকারি তিতুমীর কলেজ

‘প্রভাতের নিস্তব্ধতা গলিজুড়ে’ সকালে ঘুমের আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতে, ঘুম চোখেই প্রস্তুত হয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বের হয়ে যেতাম। জনপদ থেকে তুরাগ বাস ধরে, যেতাম পুলিশ ফাঁড়ি। তুরাগ বাসে উঠে মোবাইল ডাটা চালু করার সাথে সাথেই ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে বন্ধুদের ম্যাসেজ, কে কোথায় আছিস?

দুই-একজনকে কল দিয়ে জাগানো লাগতো! ৭টা ২৫ মিনিটে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে সম্পর্কে (কলেজ বাস) উঠতেই আলাদা আমেজ। ততক্ষণে গেটে কয়েকজন গান শুরু করে দিত। কেউ পড়ালেখায় ব্যস্ত, কেউ বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা, তো কেউ ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতেই লিংক রোডের জ্যাম পেরিয়ে ৮টার দিকে বাস কলেজে প্রবেশ করতো। তিতুমীর লেখাটা চোখে পড়তেই সব আড্ডা-ব্যস্ততা ছেড়ে নামার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে যেত।

ক্যাম্পাসে এসে সবাই এক হতেই সময় দীর্ঘায়িত না করে যেতাম প্রধান ফটকের অপর পাশে টংয়ের দোকানে। শুরু হতো প্রাণবন্ত চায়ের আড্ডা। এরপর বিজ্ঞান ভবনের ১৩১৫ নম্বর রুমে ক্লাস করা, ক্লাস শেষে রুমে, মাঠে ক্যাম্পাসের অলিতে-গলিতে বসতো আড্ডার আসর, ভাঙা গলা মিলিয়ে শুরু হতো গান ‘তোরা আছিস, তোরা ছিলি, তোরাই থাকবি’।

ঠিক যেক এক মধুর স্মৃতিতে পরিণত হয়েছিল ক্যাম্পাসের শুরুর লাইফটা। তবে, সেটা দীর্ঘায়িত হতে না হতেই বিপত্তি বাঁধলো মহামারি করোনা। ১৭ মার্চ লঞ্চে উঠে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর আজ ৩ মাসের বেশি আটকে আছি বাড়িতে। মেসেঞ্জার গ্রুপে ভুরি ভুরি মেসেজের মাধ্যমে আড্ডা চললেও তাতে তৃপ্তির খোরাক জমে না।

তাইতো আরেকটা সকাল চাই! যে সকালের দু’দিন আগেই লঞ্চে করে ঢাকায় পা রাখবো আমি, করোনার অন্ধকার কাটিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক রাজধানীর সদরঘাটে নেমে মাস্কবিহীন মুখে প্রাণভরে নিশ্বাস গ্রহণ করবো।

দীর্ঘ দিন পর ক্যাম্পাসে যাবো, সে জন্য হয়তো আগের রাতে নানা কল্পনায় ঘুমতে ঢের দেরি হবে। মোবাইলের অ্যালার্মের শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বের হবো!

তখনো যাত্রাবাড়ী থাকবে নীরব, জনমানবহীন গলি পেরিয়ে তুরাগ বাসে উঠবো দৌড়ে। সেদিন ছাত্র ভাড়া না দিয়ে পুরো ভাড়া দিবো কন্ডাকটরকে, মামাও সেদিন থাকবে আনন্দ মেজাজে, কারণ তার বাসে এখন আর দূরত্ব মেনে কম মানুষ নিতে হয় না, কানায় পূর্ণ তার বাস।

সেদিন থাকবে না কোনো সামাজিক দূরত্বের বালাই, কারও মুখে থাকবে না মাস্ক পরা। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বাসে উঠেই জড়িয়ে ধরবো বন্ধুদের। বাসে সিট খালি থাকা সত্ত্বেও আমি আর আমার বন্ধু গেটে দাঁড়িয়ে গলা মেলাবো ‘আমরা করবো জয় একদিন’।

ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে দৌড়ে মাঠে গিয়ে বসে পড়বো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করবো এত দিনে আমার পরশ না পাওয়া ঘাসগুলোকে। বিজ্ঞান ভবনের সামনে গিয়ে মামাকে জিজ্ঞাসা করবো, কেমন আছেন? জানি মামাও সেদিন খুব ভালো থাকবে, এত দিন পর আমাদের পেয়ে মামাও খুশিতেই থাকাবেন।

ততক্ষণে বন্ধুরা একে একে সবাই এসে জমা হবে শহীদ মিনারের সামনে। সবাইকে  নিয়ে যাবো আবারও চায়ের আড্ডায় মেতে উঠতে। টংয়ের মামাকে বলবো চিনি বেশি দিয়ে রঙ চা দিতে। বন্ধু মহলে চা-খোর খেতাব পাওয়া আমি হয়তো অনেক দিন মামার চা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দু’কাপ তৃপ্তি নিয়ে পান করে ফেলবো।

৮টা ৪০ মিনিট হওয়ার আগেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে দাঁড়াবো সামনের সারিতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য। আমাদের সামনে দাঁড়ানো থাকবে শিক্ষকবৃন্দ। সবাই গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবো, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।

এরপরেই দৌড়ে চলে যাবো ক্লাস রুমে, ক্লাসে এত দিন পর অভিভাবকতূল্য শিক্ষক এবং ভালোবাসার সহপাঠীদের পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হবো। এক বেঞ্চে বসবো গাদাগাদি করে। ক্লাস শেষে রুমেই সবার সঙ্গে জুড়ে দেবো আড্ডা।

সেদিন ক্যাম্পাস থাকবে কানায় কানায় পূর্ণ, সবাই ব্যস্ত থাকবে এত দিন পর বন্ধু, বড় ভাই-বোনদের পেয়ে মাঠে, বেলায়েত চত্বরে, ছাত্র সংসদের সামনের গোল চত্বর সবজায়গায় আড্ডায় মশগুল। সেখানে বেশির ভাগেরই কথা হবে লকডাউনের আনন্দ-দুঃখের স্মৃতি নিয়ে। বরকত মিলনায়তনে বসবে বিতর্ক ক্লাবের যুক্তিতর্কের মেলা, এত দিন পর ক্যাম্পাসে এসে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার চেয়ে বাঁধন সদস্যদের দেখা যাবে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রক্তের খোঁজে বের হতে।

সেদিন রক্ত দিতে ভয় পাওয়া ছেলেটাও আনন্দে রক্ত দেওয়ার সাহসটা করে ফেলবে। ফলে বাঁধনের ভাইয়া আপুদের রক্তদাতা খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। ক্লাস শেষে বিজ্ঞান ভবন থেকে বের হতেই অডিটোরিয়াম থেকে ভেসে আসবে শুদ্ধস্বরের গান-‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে। আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি, শক্ত হাতে রে।’

ছাত্র সংসদের সামনে থেকে শুরু হওয়া ছাত্রলীগের স্লোগানে মুখরিত হবে ক্যাম্পাসের অলিগলি। সাংবাদিক সমিতির ক্যাম্পাস প্রতিনিধিদের দেখা যাবে খবর সংগ্রহে ব্যস্ত।

সেদিন জমে থাকবে এক রাজ্যের কথা, তাই ক্লাস শেষ হলেও বাসায় আসবো না, আড্ডা দেবো বিকেল পর্যন্ত। বন্ধুমহলে কেউ যদি বলে বাসায় যেতে হবে, তার সে আকুতিতে ভ্রুক্ষেপ কেউ করবে না, বাধ্য হয়ে থাকতে হবে তাকেও। সেদিন বিচরণ করবো ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটা অলি-গলিতে। হঠাৎ মাঠে বসে সবাই একসঙ্গে ধরব গান। এভাবেই কেটে যাবে দিনটি।

শিগগিরই সুস্থ হয়ে ওঠো হে ধরা। আমি ফিরতে চাই ব্যস্ত শহরে। আমি আবারও ফিরতে চাই প্রিয় ক্যাম্পাসে, ক্লাস করতে চাই ১৩১২ নম্বর রুমে বসে, আড্ডায় মেতে উঠতে চাই বড় ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে তিতুমীরে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।

 

ঢাকা/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়