ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সম্ভাবনার আরেক নাম পাটশিল্প

তামান্না শারমিন তিথি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০২০  
সম্ভাবনার আরেক নাম পাটশিল্প

পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়। পাট বাংলার ঐতিহ্য। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের এক সফল ইতিহাস ও মিশে আছে আমাদের নিজস্বতা। এদেশের অর্থনীতিতে বহু বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল পাটশিল্প। প্রাচীন কাল থেকে আমাদের পাটশিল্প ছিল অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান হাতিয়ার ছিল এই পাট। এমনকি স্বাধীনতার পরেও দুই’এক বছর আমাদের পাট শিল্পের গৌরব ছিল অক্ষত।

বাংলাদেশের ভূমি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্যে খুবই উপযোগী। ৯০ দশকে এদেশে পাট উৎপাদন হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমশ সেই পাটের জমির পরিমাণ কমতে কমতে ৩০-৪০ বছর ধরে ৪ বা সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। পরবর্তীতে পরিবেশ সচেতনতা, প্রাকৃতিক আঁশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে সেই জমির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ লাখে এসেছে। তবে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তার উৎপাদন পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। যেখানে আগে ১২ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৬০-৬৫ লাখ বেল পাট পাওয়া যেতো, সেখানে বর্তমানে মাত্র ৭-৮ লাখ হেক্টর জমিতেই প্রায় ৮৪ লাখ বেল পাট পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশি কাঁচাপাট, পাটজাত পণ্য প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানাসহ আরও কিছু দেশে রপ্তানি করা হয়।

বর্তমানে কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের পোশাক, বস্ত্র, চামড়াশিল্পসহ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর রপ্তানি আয়ে যখন ধস নেমেছে, তখনই আমাদের পাট রপ্তানিতে লাগে উন্নয়নের ছোঁয়া। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১৯৫.৪ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের এই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। আবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছর ২০২০-২১ এর প্রথম মাস তথা জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৯১ কোটি ডলার আয় করেছে, যার মাঝে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ডলার এসেছে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। 

২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা আমাদের অর্থনীতির উজ্জ্বল দিক নির্দেশ করে।

পাট বরাবরই বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার পরশে তার গৌরব অনেকটা মলিন হয়ে গেছে। বর্তমানে পরিবেশ সচেতনতার জন্য আবারও এই সম্ভাবনাময় পাটশিল্পের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। পাট থেকে তৈরি জুট জিওটেক্সটাইল বাঁধ নির্মাণ, ভূমিক্ষয় রোধ, পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশের উন্নত পাট এখন বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ি নির্মাণ, কম্পিউটারের বডি, উড়োজাহাজের পার্টস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। 

তাছাড়া ইনস্যুলেশন,  ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পেও বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত বাংলাদেশের পাট। পাটকাঠি থেকে তৈরি চারকোল খুবই উচ্চমূল্যের, যা দিয়ে আতশবাতি, কার্বন পেপার, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারিসহ নানা জিনিস তৈরি করা হয়। আবার এই অ্যাকটিভেটেড চারকোল থেকে অনেক প্রসাধনসামগ্রীও তৈরি করা যায়। 

পরিবেশবান্ধব ও যথাযথ উপযোগিতার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা খাদ্যশস্য মোড়কীকরণে পাটের থলে ও বস্তা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। আবার পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জবি, শোপিস, ওয়ালমেট, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, শিকা, সুতাসহ নানা পাটজাত পণ্য যেমন আকর্ষণীয়, তেমন পরিবেশবান্ধবও। আবার সম্প্রতি শুকনো পাট পাতা অর্গানিক চা উৎপাদনও শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে তার পরিচিতি তুলে ধরতে পারলে তা চায়ের বিকল্প সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে।

আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পাটশিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এ শিল্প বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচায়ক। কর্মসংস্থান, অর্থ উপার্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি এই দেশের ঐতিহ্য ও নিজস্বতা রক্ষায় পাটশিল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাট শিল্পের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়