ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাসের সিটে কলেজের প্রথম ক্লাস  

খালিদ কামাল উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ৩১ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:৪১, ৩১ অক্টোবর ২০২০
বাসের সিটে কলেজের প্রথম ক্লাস  

আমি মাধ্যমিক পাস করি ঢাকার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও ঝুঁকি নিতে চাইনি। আজ সেই ঝুঁকি নেওয়াই শিখছি, ব্যবসায়ের ঝুঁকি।

প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর একটা স্বপ্ন থাকে সে কলেজে ওঠে অনেক কিছু করবে। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখে সে। আমিও দেখেছি। স্বপ্ন শুধু এপ্লাস পেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াকে বলে না। এটা হচ্ছে সেই স্বপ্ন, যেটা অন্তরের তৃপ্তি আনে। জীবনকে উপভোগ করার স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে যেন ভবিষ্যতের উপর ব্যাঘাত না ঘটে। একজন ভালো শিক্ষার্থী হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়া খুবই প্রয়োজন। বাস্তবতা থেকে বলছি। 

যাইহোক, পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়, সেদিন রাতের বাসেই বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। তার কিছু দিন পরে এই মহামারির দুঃসংবাদ। সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয় অল্প কয়েক দিনেই। ভেবেছিলাম তেমন কিছু হবে না। ডেঙ্গুর মতো এটাও চলে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। কী পরিমাণ মানুষ এতে মারা যাচ্ছিল, তা প্রতিনিয়ত শুনছিলাম খবরে। এক মাস দু’মাস করে যখন আমার ফলাফলের সময় আসলো, শুনলাম ফলাফল প্রকাশ হতে দেরি হবে। মে মাসের ৩১ তারিখে ফল প্রকাশ হলো। সন্তুষ্টজনক না হলে কীভাবে মেনে নিতে হয় তার অভ্যাস নিজে থেকেই করে রেখেছিলাম। তাই মন খারাপ না করে মেনে নিয়েছি। ৩.৮৯ এসেছিল। স্বপ্ন যেখানে আদমজী কলেজ, বাস্তবতা তার মানবিক বিভাগেও না। 

বাবা খুব করে বলছিলেন আগের জায়গাতেই ভর্তি হতে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। মূলত আমি আমার মানসিক শান্তির জন্য ওখানে ভর্তি হইনি। কলেজ থেকে না, এক স্যারের বাসায় থাকতাম তার বাসা থেকে। অনেক যুদ্ধের পর বাবাকে না বলেই কলেজে আবেদনের প্রস্তুতি নেই। কলেজে আবেদনের তারিখ আসলো। প্রথম পর্যায়ের আবেদনে চান্স পেয়ে গেলাম বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকাতে। বাবা শুনে খুব খুশি হলেন। বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমার সঙ্গে আরও দু’জন নৌবাহিনী কলেজে চান্স পেয়েছে। সাদমান আর তিথি। 

ঢাকা চলে গেলাম ভর্তি হওয়ার জন্য। খুব আনন্দ হলেও হতাশা ভরা মুখ নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কলেজ খুললে খুব মজা করব ভেবে পাগলের মতো হাসতে থাকা আমি, আজ গম্ভীরমুখ করে আছি, কারণ কলেজ কবে খুলবে তার কোনো হদিস নেই। নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার চেয়ে বেশি কৌতূহল থাকে কলেজের নবীন বরণের দিনের।

মোবাইলের অ্যালার্মে সকাল সকাল ঘুমটা ভাঙবে না। বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে কলেজের জন্য তৈরি হওয়া হবে না। একগাদা বই ভরা ব্যাগটা আর কাঁধে ঝুলবে না। দেরি হলে ৮টার আগে কলেজ গেটে প্রবেশের জন্য সেই দৌড়ঝাঁপটা হবে না। ঘুম ভরা চোখ নিয়ে সকালবেলার সেই বিরক্তিকর অ্যাসেম্বলি ছাড়া কি ক্লাস শুরু হয়! কলেজ বাঙ্ক দেওয়া, কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসে অংশ নেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, লেকচার চলাকালীন জমিয়ে গল্প করা হবে না। ভাবতে ভাবতে আমার সিরিয়াল আসলে ভর্তি হয়ে বাসায় ফিরলাম। তারপর বাড়ি।

অক্টোবরের ৪ তারিখে অনলাইনে নবীন বরণ হবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪ তারিখ সকাল ১০টায় মোবাইল নিয়ে বসে পড়ি। কি আর করার, মিটিংয়ে জয়েন করে বসে আছি সবাই। কারো কোনো খোঁজ নেই। বিরক্ত হয়ে ২ ঘণ্টা বসে ছিলাম। এক পর্যায় খুব বিরক্ত হয়ে সবাই বের হয়ে যাই। ক্লাস শুরু হলে জানতে পারি প্রিন্সিপাল স্যার সব সেকশনে কথা বলে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবরের ৫ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু হয়। প্রথম ক্লাসটা করি বাসে বসে। আমি আবার ঢাকা যাচ্ছিলাম বই কিনতে। অনলাইনে যেন মনটা জমছে না। শিক্ষকরাও অনলাইনে ক্লাস নিয়ে খুশি নন। ফাঁকিবাজি করলে মারবে, বকা দেবে সেই সুযোগও নেই। ক্যামেরার আড়ালে নিজের বাড়িই। কিন্তু শিক্ষকের চোখের আড়ালে এক অন্য জগত। 

বই কিনেছি ঠিকই, কিন্তু শুধু সাজিয়ে রেখেছি। স্কুলের খুব অকপট ছাত্রটাও কলেজে উঠে জীবনকে উপভোগ করতে শেখে। তার ও আর জীবনটাকে উপভোগ করা হলো না। এখন হয়তো অবসর, বসে থাকি, তাই মাঝে মাঝে স্কুলের স্মৃতি ভরা দিনগুলো মনে পড়ে খুব। কিন্তু কলেজ খোলা থাকলে এক নতুনের ভিড়ে যেন অতীতকে ভুলে যেতাম। স্কুলে মাঠ ছিল না, অডিটোরিয়াম ছিল না। দেখেশুনে অমন কলেজেই ভর্তি হয়েছি, যেখানে মাঠ ও অডিটোরিয়াম আছে। মাঠে খেলাধুলা আর অডিটোরিয়ামের উজ্জ্বল লাইটিংয়ে বড় বড় অনুষ্ঠান। এগুলো আর হলো না। তবে আশা করছি নতুন বছরের শুরুটা যেন প্রভু সুসংবাদ দিয়ে শুরু করান। 

এই বিশ্ব মহামারি যেন চিরতরে শেষ হয়ে যায়। যেন সব হতাশা আর গম্ভীরমুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে যায়। যেন অলস মস্তিষ্ক আর শরীরগুলো কাজ করতে শুরু করে। বিএন কলেজ প্রাঙ্গণটা আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠবে ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে, যেমনটা ফুল গাছ হয়ে ওঠে বেশ লম্বা সময় শেষে শিকড়ে পানি পাবার পর। স্কুল কলেজ একজন শিক্ষার্থীর জন্য শেকড়স্বরূপ। এখান থেকে সে নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখে ধীরে ধীরে অনেক উপরে বেড়ে ওঠে। চারদিকে নিজের নাম উজ্জ্বল করে। এমনই একটা স্বপ্ন আমার। 

আমার স্বপ্ন আমি একজন বড় ব্যবসায়ী হব। সেই স্বপ্ন পূরণে আমার শিক্ষক ও বন্ধুরা আমার সহায়ক হবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকা।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়