ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ: এক টুকরো স্বর্গ

অন্বয় দেবনাথ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ২৬ আগস্ট ২০২১  
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ: এক টুকরো স্বর্গ

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। ইট-কাঠ-পাথরে ঘেরা ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে এক টুকরো শান্তির নিবাস। যেখানে প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যায় দ্বিধাহীনভাবে। গাছপালা, পুকুর এবং খেলার মাঠে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ এই কলেজের বৈশিষ্ট্য। 

১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পাবলিক স্কুলের অনুরূপ বিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল স্থাপনের কাজ শুরু করেন। শেরেবাংলা নগরের পাশে মোহাম্মদপুর এলাকায় এক মনোরম পরিবেশে ৫২ একর জমির উপর এর স্থান নির্বাচন করা হয়। বিদ্যালয়ের ইমারত, খেলার মাঠ, ছাত্রদের হাউস (হোস্টেল), প্রশাসনিক ভবন, শিশু পার্ক, মসজিদ, মিলনায়তন এবং অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, শিক্ষক ও বিভিন্ন পদের কর্মচারীদের বাসস্থান ইত্যাদি তৈরির কাজ পর্যায়ক্রমে হাতে নেওয়া হয়। 

প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ এখনো চলছে। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রাদেশিক সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোর্ড অব গভর্নরস গঠন করে বিদ্যালয়টিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করেন। বাংলাদেশে মোট ২টি স্বায়ত্তশাসিত কলেজ রয়েছে। তার মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পুনরায় বিদ্যালয়টির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে এ বিদ্যালয়কে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।

বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে৷ আর এই ৫২ একরের স্বর্গেই কেটেছে আমার কলেজ জীবন। ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে কলেজ থেকে বিদায় সবই ছিল স্বপ্নের মতো। কলেজে যেদিন ভর্তি হতে যাই, সেদিন চারপাশের পরিবেশ দেখে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কলেজে ঢুকতেই চোখে পড়বে বাগান এবং বাম পাশেই রয়েছে এক বিরাট বটবৃক্ষ। অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী বৃক্ষটি। তবে সবচেয়ে নজর কেড়েছিল ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের পাশের চিড়িয়াখানাটি। কম করেও ২০টির মতো হরিণ আছে সেখানে৷ কলেজের মধ্যে যে হরিণ থাকতে পারে, এটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। 

রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৬টি আবাসিক ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি বড়দের এবং ২টি জুনিয়র সেকশনের। কলেজ লেভেল হওয়ায় আমার স্থান হয় নজরুল ইসলাম হাউসে। এই হাউসেই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মেঝো ছেলে শেখ জামাল। বাবা-মাকে ছেড়ে সেবারই ছিল আমার প্রথম বাইরে থাকা। অবশ্য বেশি দিন থাকা হয়নি হাউসে। ১ মাস থাকার পরেই বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই এক মাস আমার জন্য ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। 

হাউসের নিয়ম অনুযায়ী একদম ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাদের সবাইকে শরীর চর্চা করতে হতো। মর্নিং, ডে দুই শিফটের সব শিক্ষার্থী এখানে অংশ নিতো। এমন প্রাণবন্ত পরিবেশে সকালের হাওয়ায় শরীর চর্চা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতাই বটে। শরীর চর্চা শেষে ফ্রেশ হয়ে হাউসেই খাওয়া-দাওয়া করে আমরা বেরিয়ে পড়তাম কলেজের উদ্দেশে। আমাদের কলেজ ভবন কাছেই ছিল। সবাই লাইন ধরে কলেজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতাম৷ কলেজ শেষে দুপুরে আবার হাউসে ফিরে গোসল করে সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম। যেন সবাই এক পরিবারেরই অংশ। এরপরের সময়টায় নিজেদের কাজেই ব্যস্ত থাকতাম সবাই। 

কেউ নিজের রুমে বসে পড়াশোনা করতো, কেউবা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু যে যাই করুক বিকালে আবার সবাই দল বেধে খেলার উদ্দেশ্যে মাঠে যেতাম৷ আমাদের কলেজে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১২টি খেলার মাঠ আছে। এছাড়া আছে দুইটি বাস্কেটবল গ্রাউন্ড। বিশাল মাঠের মধ্যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটতো আমাদের বিকেলবেলা। 

সন্ধ্যার মধ্যে খেলা শেষে সবাই ফিরে আসতাম হাউসে। এরপর দল বেধে মুসলিম বন্ধুরা নামাজের উদ্দেশ্যে কলেজের মসজিদে যেত। নামাজ শেষেই ছিল আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা। সন্ধ্যা ৭টায় রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটির সাথে প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সেটার সাথেও মানিয়ে নিতাম। মজাই লাগতো। একসঙ্গে এতজন মিলে খাবার খাওয়ার অনুভূতিই ছিল আলাদা। 

খাবার খাওয়া শেষে আবার কলেজ ড্রেস পরে বেরিয়ে পড়তাম কলেজের উদ্দেশ্যে। সেখানেই হতো আমাদের রাতের পড়াশোনা। কলেজের শিক্ষকরাই সেখানে পড়াতেন। রাতে আবার হাউসে ফিরে থাকতো নাস্তার ব্যবস্থা। এরপর কেউ ঘুমিয়ে পড়তো, কেউবা নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা করতো। আবার অনেকে কমন রুমে টিভি দেখায় ব্যস্ত হয়ে যেত। তবে আমাদের কাছে সবচেয়ে মজার দিন ছিল বৃস্পতিবার। ওইদিন সবাই দল বেধে সন্ধ্যায় কমন রুমে সিনেমা দেখতাম৷ 

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো হাউসে মোবাইল কিংবা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে ছিল কঠোর বিধিনিষেধ। বর্তমান যুগে মোবাইল ছাড়া তরুণ সমাজ এক মুহূর্ত কাটাতে না পারলেও হাউসে থাকাকালীন যে কীভাবে সময় চলে যেত, টেরই পেতাম না। পড়াশোনার পাশাপাশি বিন্দুমাত্র বিনোদনের অভাব ছিল না আমাদের। 

এভাবেই কখন যে দেখতে দেখতে দেড় বছর পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। স্বপ্নের মতো কেটেছে আমার এই দেড় বছর। এখনো যখন কলেজের পাশের রাস্তা দিতে যাই, তখন মনের কোণায় স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে ওঠে৷ জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে ৫২ একরের স্বর্গে কাটানো দিনগুলো।

লেখক: সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ।

/মাহি/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়