ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিয়ে হয় শোনা যায় না বিয়ের গীত

আজমাল হোসেন মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০২, ৩১ মার্চ ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিয়ে হয় শোনা যায় না বিয়ের গীত

বিয়ের গীত গাইছেন একদল মহিলা

আজমাল হোসেন মামুন : ‘বিয়ের গীত’ গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। একটা সময় ছিল যখন বিয়ে বাড়িতে আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে দলবেঁধে নারীরা গান গাইত। হাসি-আনন্দে মেতে উঠত বিয়ে বাড়ির সবাই। অনেক সময় বিয়ে বাড়ি তো বটেই গ্রামজুড়ে বিয়ের গীতের কারণে উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যেত। ছোট-বড় সকলেই হতো এ সব গানের শ্রোতা। এখন আর এমন খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের বিয়ে বাড়িতে ‘বিয়ের গীত’-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চ শব্দের যান্ত্রিক সাউন্ড বক্স। সেখান থেকে ভেসে আসে বিদেশি গানের সুর। গ্রামের মানুষও এখন সেই সুরে গা ভাসিয়েছেন। ফলে বিয়ে বাড়িতে এক সময় যে গীত শোনা যেত,  দলবেঁধে নারীরা যে গান গাইত তা প্রায় অতীত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।  

১৫-২০ বছর আগেও দেখেছি, গ্রামের কোনো বাড়িতে বিয়ে হলে নারীরা দলবেঁধে সারা রাত গীত গাইত। শুনতে বেশ ভালো লাগত। মাঝে-মধ্যে সেখানে আমরা যেতাম। দেখতাম তাদের আনন্দ। এখন আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা এসব ‘গীত’ পছন্দ করে না বললেই চলে। তার মানে তারা যে গান পছন্দ করে না তা নয়। তারা গানের সঙ্গে নাচেও বটে! তারা আসলে হিন্দি গান অথবা ব্যান্ড সংগীতের তালে তালে নাচতে ভালবাসে!

গ্রামে বিয়ের আসরে দেখা যেত বরযাত্রী বা ডুলিবিবিরা এলে কনে পক্ষের মেয়েরা দলবেঁধে গাইত : ‘ডুলিবিবি আইসাছে পান খাইবার লালচে।’
অথবা যখন কনে বা বরকে কিছু খাওয়ানো হতো তখন গাইত : ‘বসবো না, বসবো না, ছিঁড়া ছোপে আমরা বসবো নারে, আরশের বাবা কি জানে নারে।’
শালিকারা গাইত : ‘দুলা ভাই গিয়েছে শহরে, আনবে নাকের নথরে, সেই নথ নাকে দিয়ে নাক ঘুরিয়ে নাচবো রে।’

মাঝেমধ্যে গীত গাইতে গাইতে নাচত মহিলারা।  সে সব গীতের সুর এত করুণ ও আবেগধর্মী যে, কেউ শুনলে সহজে ভুলতে পারত না। এই গীত যারা গান তারা এখনও হারিয়ে যাননি। গ্রামে খোঁজ করলে নিশ্চয়ই তাদের পাওয়া যাবে। কিন্তু কেউ তাদের খোঁজ করেন না বা রাখেন না। আজকাল বিয়ে হলেই ব্যান্ডদল ভাড়া করে নেওয়া হয়। এতে ব্যয়ও বেশি। কিন্তু গ্রামের সেইসব সহজ-সরল গায়কদের ডাকা হয় না। তাদের চাওয়া- পাওয়াও খুব বেশি নয়। তাদের নামমাত্র বখশিশ দিলেই খুশি থাকে।

বিয়ের ৪-৫ দিন আগেই বিয়ের গীত শুরু হয়ে যেত। ঢেঁকিতে ধান ভাঙার সময় শুরু হতো গীত। কারণ সেই ধান দিয়ে বর বা কনের জন্য তৈরি করা হতো ঐতিহ্যবাহী খাবার। এই খাবারকে বলা হতো ‘থুবড়া’। ‘থুবড়া’র তালিকায় রসগোল্লা, ক্ষীর, ফিরনি এবং বিভিন্ন পিঠা বিশেষ করে ভাপা পিঠা ছিল। আদর করে কনে এবং বরকে খাওয়ানোর সময়ও গীত গাওয়া হতো। অনেক সময় দূরের গ্রাম থেকেও গীত শোনা যেত।

বরের আগমন, কনেকে গোসল করানো, কনে বিদায় দেওয়া- অর্থাৎ বিয়ের একেক আয়োজনে একেক ধরনের গীত গাওয়া হতো। বরকে বরণ করার সময় যে গীত গাওয়া হতো তা আনন্দপ্রধান। আবার কনের বিদায়ের সময় গীতে দুঃখ বেদনা ফুটে উঠত। এভাবেই হৃদয়ের আবেগ-উৎকণ্ঠা, দুঃখ-কষ্ট, হাসি–কান্না, আনন্দ-বিরহের প্রকাশ ঘটে বিয়ের গীতে। সাধারণত কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের নারী গোল হয়ে একসঙ্গে বসে খালি গলায় বিয়ের গীত পরিবেশন করত। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওয়ানি’ মধ্যবয়সী মহিলাদের ডাক পড়ত। এদের অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর। গানে তারাই সুর দিতেন। এটা তারা বংশানুক্রমে নিজেরা আয়ত্ব করত। তখন শোনা যেত :

কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাপ দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে।’

বোনেরা গাইত :
‘হামার ভাইয়ের হলদি মাখিবার, মনে নাহি ছিলরে
জোর বেজোর হলদি মাখলে, জোনাকু শালার বহিনরে।’

বর বা কনেকে থুবড়া হিসেবে ক্ষীর খাওয়ার সময় দলবেঁধে মহিলারা গাইত :
‘আলুয়ার চালে কাঞ্চন দুধে ক্ষীরোয়া পাকালাম
সেই না ক্ষীরোয়া খেতে গরমি লেগেছে।
কোথায় আছ বড়ভাবি পাক্কা হিলোয়রে।’

বিয়ে শেষে নিজ বাড়িতে ফিরে আসার সময় বরের প্রতি লক্ষ্য করে গীত গাইত :
‘কী গহনা আনিছেন দুলা মিয়া দেখানতো হামাকে
সবই জিনিসি আনিছি গুলজান বিবি নথুয়া ছারিছি দেশে।’

বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কনেকে হাজার স্মৃতি, বেদনা ভুলে যেতে হচ্ছে । যেতে হচ্ছে নতুন বাড়িতে। গুছিয়ে নিতে হবে সংসার। তখন গীতের মাধ্যমে বলা হতো :
‘মন বিন্দাইলাম বনে বনে, আরো কান্দন কান্দে গো মায়-ও বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়-ও নিরলে বসিয়া।’

এ ধরনের অসংখ্য বিয়ের গীত মা-বোনেরা মুখস্থ করে রাখত। গীত গাওয়ানিদের সেই কদর আজ আর নেই। আমরা অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি আমাদেরই গৌরবময় সংস্কৃতি।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়