হঠাৎ পেলাম নীলপরির দেখা
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

করোনার কারণে দীর্ঘ নয়মাস ফটোগ্রাফি বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন পর অতি প্রিয় সবুজবন সাতছড়ি থেকে আবার বার্ড ফটোগ্রাফি শুরু হলো। কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে খুব ভোরে রওনা হয়ে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে গিয়েছিলাম। তখনও কুয়াশার আবরণ ভেদ করে সূর্যের আলোকচ্ছটা নেমে আসেনি। একটু আগেই ফজরের নামাজ শেষে মুসল্লীরা রাস্তায় নেমেছেন। আমিও একটি সিএনজি নিয়ে হবিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে ছুটলাম সাতছড়ির দিকে।
বনের প্রবেশ পথ দেখে বুঝতে পারলাম দীর্ঘদিন মানুষের পা পড়েনি। তীব্র শীত উপেক্ষা করে ধীর গতিতে টাওয়ারের দিকে রওনা হলাম। চারদিকে চিরচেনা পাখির কলতানে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। টাওয়ারে যখন উঠলাম তখনও সূর্য উঁকি দেয়নি। কুয়াশার চাঁদরে সুবজ বন আচ্ছাদিত। চিরচেনা মান্দার গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। গাছটিতে কিছুদিন পরেই ফুল ফুটবে। শীতের ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে টাওয়ারে একা দাঁড়িয়ে আছি। হরেক প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে বন মুখরিত। হরিয়াল প্রজাতির কিছু পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। সিপাহী বুলবুলি ও বাংলা বুলবুল পাখির নৃত্য দেখছি। বেশ কিছু ফুলঝুরি পাখি খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত। এমন সময় চোখের সামনে মান্দারের পাতাবিহীন ডালে একটি পাখি উড়ে এসে বসলো। বহুদিন পাখিটির খোঁজে ছিলাম। কিন্তু কখনও দেখা পাইনি। কাঙ্ক্ষিত পাখিটির দেখা পাওয়ায় উত্তেজনা বেড়ে গেল।
Asian Fairy Bluebird বা নীলপরীর দেখা এত সহজে মিলবে যা কিনা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল! উত্তেজনা কমিয়ে পাখিটির বেশ কিছু ছবি তুললাম। আলোক স্বল্পতায় তেমন ভালো মানের ছবি হয়নি। তারপরও পাখিটির ছবি তুলতে পারায় আরেকটি স্বপ্নপূরণ হলো।
নীলপরী IRENIDAE পরিবারের ছোট আকারের ফলভুক বৃক্ষচারী পাখি। Irena গণের এই প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে দেখা যায়। এটি প্রায় ২৫ সেমি দৈর্ঘ্যের কালো ও নীল রঙের পাখি। এদের পা খাটো। ঠোঁট খাঁজ কাটা, বলিষ্ঠ, মাথার তুলনায় খাটো, বাঁকা ও আগায় সামান্য খাঁজ আছে। নাকের ছিদ্র ডিমের মতো গোলাকার ও সামনে পালকে আংশিক ঢাকা। ঘাড়ের পেছনে কয়েকটি চুলের মতো সরু পালক আছে। ডানা বড় ও গোলাকার। লেজ বেশ লম্বা। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় পার্থক্য আছে। ছেলেপাখির কালো ডানা ও লেজ ছাড়া মাথার চাঁদি থেকে কোমর পর্যন্ত পিঠ উজ্জ্বল বেগুনি-নীল। নীলচে লেজতলা-ঢাকনি ছাড়া দেহের নিচে কালো। মেয়ে পাখির নীল-ধূসর কালচে ডানার পালক ও কিছুটা বাদামি-কালো ঠোঁট ছাড়া দেহ অনুজ্জ্বল নীল-সবুজ।
নীলপরী চিরসবুজ ও আদ্র চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। সচারচর জোড়ায় অথবা ছোট ঝাঁকে থাকে। ফুল ও ফল গাছ এবং ঝোঁপে এরা খাবার খুঁজে খায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ফুলের মধু, ডুমুর ও অন্যান্য পাকা ফল। খাদ্যাভাবে মাঝে মাঝে পোকাও খায়। খাওয়ার সময় এরা লেজ ঝাকায় ও ইউয়িট ইউয়িট শব্দে ডাকে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে ঘন ঝোঁপে গাছের চেরা ডালে মাটি থেকে প্রায় ৪-৬ মিটার উচ্চতায় পত্রগুচ্ছের উপর মূল ও পাতা বিছিয়ে মাচার মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ২/৪টি ডিম পাড়ে এবং একাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাবা ছানাদের পরিচর্যা ও সংসারের যাবতীয় কাজ করে।
নীলপরী বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে বাস করে। এরা লোকালয়ে আসে না। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এদের বিস্তৃতি রয়েছে। এরা বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে বণ্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: নীলপরী
ইংরেজি নাম: Asian Fairy Bluebird
বৈজ্ঞানিক নাম: Irena Puella (Latham,1790)
বি.দ্র: লেখক ছবিটি সাতছড়ি বন থেকে তুলেছেন
হাসনাত/তারা
- ৮ মাস আগে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পেলাম বুনো টুনির দেখা
- ৮ মাস আগে পাখির নাম ‘রঙিলা দোয়েল’
- ৮ মাস আগে বাচ্চা হারিয়ে মা দুধরাজ পাখির হাহাকার
- ৯ মাস আগে পুকুর পাড়ে পেলাম ‘কালোবুক দামা’র দেখা
- ৯ মাস আগে যেভাবে খুঁজে পেলাম ‘কালো বাজ’ পাখি
- ৯ মাস আগে অনেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম নীল ফক্কির
- ৯ মাস আগে সীমানা নির্ধারণ করে বাস করে জল মোরগ
- ৯ মাস আগে হঠাৎ দেখি সুরেলা কণ্ঠের সাদা লেজ রবিন!
- ১০ মাস আগে প্রজননকালে গান গায় ‘লালডানা কোকিল’
- ১০ মাস আগে উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি
- ১ বছর আগে ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি
- ১ বছর আগে মহাবিপন্ন পাখি ‘বন বাচকো’
- ২ বছর আগে ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
- ২ বছর আগে গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস
- ২ বছর আগে বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি
- ২ বছর আগে টুপি মাথায় ‘মৌলবি হাঁস’
- ২ বছর আগে সুরের পাখি সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসী
- ২ বছর আগে দেখতে সবুজ বাঁশ ঘুঘু
- ২ বছর আগে বাইক্কা বিলের জলময়ূর
- ২ বছর আগে নগরে পাকড়া খঞ্জন
- ২ বছর আগে পাখির নাম হট্টিমা
- ২ বছর আগে লালচে কাঠঠোকরার লুকোচুরি
- ২ বছর আগে প্রথম দেখাতেই পাপিয়ার প্রেমে পড়েছিলাম
- ২ বছর আগে অনেক কষ্টে পেলাম সাদা-কোমর মুনিয়ার দেখা
আরো পড়ুন